শিবুর তিন জন্মের তিন স্ত্রী এবং নৃত্যকালীর তিন জন্মের তিন স্বামীর ডবল ত্র্যহস্পর্শযোগ ঘটে নাই বটে, কিন্তু ভারত জুড়িয়া যাহা চলিতেছে, তাহা যুগপৎ জলস্তম্ভ, দাবানল ও ভূমিকম্প অপেক্ষা কিছু কম নহে। লোকসভা নির্বাচনের ঢাকে কাঠি পড়া ইস্তক কেবলই তরজার বোল শোনা যাইতেছে। অতি নিম্ন স্তরের তরজা। যুযুধান দুই শিবিরের দুই প্রধান সেনাপতি পরস্পরকে আক্রমণ করিবেন, তাহাতে বিস্মিত হইবার কারণ নাই। কিন্তু দেশ জুড়িয়া তাঁহারা যে হুঙ্কার এবং প্রতি-হুঙ্কারে মাতিয়াছেন, তাহাতে দেশ কোথায়? যে ভারতের অধিকার অর্জন করিতে তাঁহারা রণপ্রমত্ত, সেই ভারত ভাল নাই। তাহার অর্থনীতি বিপাকে পড়িয়াছে। সেই বিপদ সাময়িক না দীর্ঘমেয়াদি, তাহা লইয়া তর্ক চলিতে পারে। কিন্তু যে দশ কোটি ভারতবাসী ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনেই প্রথম ভোট দিবেন, তাঁহাদের ভবিষ্যৎ আপাতত মলিন। তাঁহাদের কী হইবে, কোন পথে অর্থনীতির স্বাস্থ্যোদ্ধার হইবে, এই প্রশ্নগুলির প্রাথমিক উত্তরও নরেন্দ্র মোদী বা রাহুল গাঁধীর হুঙ্কারে পাওয়া যায় নাই। হ্যাঁ, নরেন্দ্র মোদী বলিয়াছেন, তিনি হিন্দু ও মুসলমান, উভয়ের উন্নতিকল্পেই যত্নবান হইবেন। রাহুল গাঁধী বলিয়াছেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরিলে আম আদমির জন্য আরও বেশি কাজ করিবে। কিন্তু মেঠো নির্বাচনী ভাষণের অঙ্গ হিসাবেও এই কথাগুলি বড় বেশি অন্তঃসারশূন্য। তাঁহাদের তরজায় ভারত অনুপস্থিত। তাঁহাদের মনেও, সম্ভবত।
ভারতীয় রাজনীতিতে রাহুল গাঁধী, তাঁহার পারিবারিক পরিচিতি বাদ রাখিলে, মূলত বেফাঁস কথার জন্যই খ্যাত। দারিদ্রকে নিছক ‘একটি মানসিক অবস্থা’ হিসাবে বর্ণনা করাই হউক, অথবা পঞ্জাবের তরুণ প্রজন্মের সত্তর শতাংশকেই নেশাসক্ত বলিয়া দাগাইয়া দেওয়াই হউক, রাহুল গাঁধী ভাবিয়া কথা বলেন বলিয়া মনে হয় না। নরেন্দ্র মোদীর ক্ষেত্রেও তেমন দাবি করা মুশকিল। পটনার জনসভায় যখন তিনি দাবি করিয়া বসেন যে তক্ষশীলা বিহারের অংশ অথবা আলেকজান্ডার গঙ্গার তীরে বিহারিদের হাতে পরাস্ত হইয়াছিলেন, তখন সংশয় জাগিতে পারে— তাঁহার এই ভ্রান্তি কি নেহাতই ইতিহাস জ্ঞানের অভাব, নাকি বিহারে জনপ্রিয়তা অর্জনের একটি হীন প্রচেষ্টা? যাহাই হউক, তাহা বিপজ্জনক। মোদীর ভাষণে ভ্রান্তি (অথবা, মিথ্যা) অবশ্য এই প্রথম নহে। এনডিএ-র আমলে আর্থিক বৃদ্ধির হার আট
শতাংশের ঊর্ধ্বে ছিল বা গুজরাতে মহিলাদের অপুষ্টির কারণ তাঁহারা ‘অধিক মাত্রায় ফ্যাশন সচেতন’ এই কথাগুলি নরেন্দ্র মোদীই বলিয়াছিলেন। অন্য এক ক্ষেত্রে তিনি দাবি করিয়াছিলেন, চিনে নাকি শিক্ষাখাতে জাতীয় আয়ের ২০ শতাংশ ব্যয় করা
হয়! যাঁহারা আর কয়েক মাসের মধ্যে দিল্লির মসনদে আসীন হইতে পারেন, তাঁহাদের মধ্যে ভাবনার, শিক্ষার, বিবেচনার এত অভাব দেখিলে গা ছমছম করে।
দুই শিবিরের দুই নায়ক লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতিপর্বকে হাস্যকর এবং শোচনীয় স্তরে নামাইয়া আনিলেন। অথচ, এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়াই ভারতীয় গণতন্ত্রের বৃহত্তম বিতর্কটি চলিতে পারিত। রাহুল গাঁধী এবং নরেন্দ্র মোদী, দুই জনের নাকি উন্নয়নের দুইটি বিকল্প মডেল আছে। ভারতীয় অর্থনীতিকে তাহার বর্তমান সংকট হইতে উদ্ধার করিতে কোন মডেল কী সমাধানসূত্র দেয়, ভারত জানিতে চাহিয়াছিল। সাধারণ মানুষ নির্বোধ নহেন। উন্নয়নের তর্কে তাঁহাদের বিলক্ষণ অধিকার আছে। বিশেষত, তাঁহাদের ভাল থাকা, না-থাকা যখন এই নেতাদের অর্থনৈতিক দর্শনের উপর নির্ভরশীল, তখন নিজেদের পথের কথা খুলিয়া বলা নেতাদের কর্তব্য ছিল। কিন্তু নেতারা সেই পথ মাড়াইলেন না। বলিবার মতো কিছু নাই বলিয়াই কি? |