ভারসাম্যের সূক্ষ্ম খেলা চাপানউতোরেও!
বিজেপি খোলাখুলি তোপ দাগছে নীতীশ কুমারের বিরুদ্ধে। বিহারের পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকায় মোটেই খুশি নয় কেন্দ্রও। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয় এই যুক্তিতে, দিল্লির সমালোচনাটা আসছে ঘুরপথে। কারণ, নীতীশ নিজে নরেন্দ্র মোদীর কট্টর বিরোধী এবং লোকসভা ভোটে তাঁকে ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরে রাখার রাস্তা খোলাই রাখতে চান কংগ্রেস নেতৃত্ব। সে কারণে নীতীশকে চাপে রাখলেও সরাসরি তাঁর সম্পর্কে কোনও কঠোর মন্তব্য করা হচ্ছে না কংগ্রেসের তরফে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব অনিল গোস্বামী বরং বলছেন, তদন্ত ঠিক পথেই চলছে। গাঁধী ময়দানে আজও উদ্ধার হয়েছে টাইমারহীন ৫টি প্রেশার বোমা, যা মানুষের পায়ের চাপ পড়লেই ফাটত। এ পর্যন্ত মোট ১৮টি বোমার হদিস মিলল সেখানে। এই ঘটনায় পাকড়াও করা হয়েছে ৬ জনকে।
ঘরোয়া ভাবে কিন্তু কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আমলারা নীতীশ সরকারের সমালোচনা করতে ছাড়ছেন না। তাঁদের বক্তব্য মাওবাদী ও ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের মতো জঙ্গি সংগঠনগুলির মোকাবিলায় ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে নীতীশ সরকারের পুলিশ ও প্রশাসন।
বিজেপি-র যাবতীয় অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্য এ রকম রাখঢাকের প্রশ্ন নেই। বিজেপি অভিযোগ তুলছে, মোদীর জন্য নিরাপত্তার যথেষ্ট ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দে কিন্ত আজ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, মোদীকে এসপিজি নিরাপত্তা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে মাওবাদী বা জঙ্গি দমনে সরকারের ব্যর্থতার দিকগুলি নিয়ে বিহারের মুখ্যমন্ত্রীকে সতর্ক করে দিতে চাইছে মনমোহন-সরকার। নীতীশ কাল দিল্লিতে শিন্দের সঙ্গে বৈঠক করবেন। সেখানে এই বিষয়টি উঠবে বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ পুলিশ ও প্রশাসনের ঢিলেঢালা মনোভাবে বিহার সরকারেরই মুখ পুড়ছে বলে মনে করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তাদের অভিযোগের তির মূলত বিহারের ডিজি অভয়ানন্দের দিকে। তাঁদের বক্তব্য, ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের (আইএম) পাণ্ডা ইয়াসিন ভটকলের গ্রেফতারের পরই বিহার পুলিশের ঢিলেঢালা মনোভাব স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। দ্বারভাঙ্গা থেকে শুরু করে বিহারের বিভিন্ন এলাকাতেই আইএম-র জাল বিছানো রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভটকলকে নিজেরা জেরা না করে সরাসরি এনআইএ-র হাতে তুলে দেয় বিহার পুলিশ। মাওবাদী মোকাবিলায় বিহারের ভূমিকাতেও সন্তুষ্ট নন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এবং সিআরপিএফ কর্তারা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা যা বলছেন না, সেটাই বলে দিয়েছেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব রাজকুমার সিংহ। বিহারের এই প্রাক্তন আইপিএস অফিসারের দাবি, ডিজিপি পদে থাকার যোগ্যই নন অভয়ানন্দ। অবিলম্বে তাঁকে সরানো হোক। তাঁর মতে, “মোদীর উপর যেখানে সন্ত্রাসবাদী হামলার আশঙ্কা রয়েছে, সেখানে আরও পেশাদারিত্বের সঙ্গে নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করা যেত।”
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের দাবি, ২৩ অক্টোবর নির্দিষ্ট ভাবেই পটনার জনসভায় হামলা নিয়ে রাজ্য প্রশাসনকে সতর্ক করা হয়েছিল। ডিজিপি অভয়ানন্দ কিন্তু যুক্তি দিয়েছেন, “এগুলি সাধারণত রুটিন বার্তা হয়। নির্দিষ্ট ভাবে কিছু বলা থাকে না। মোদীর নিরাপত্তার আশঙ্কা নিয়ে সেখানে নির্দিষ্ট ভাবে কিছু বলা ছিল না।” কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শিন্দে নিজেও আজ বলেছেন, “আগামী দু’তিন দিনের মধ্যেই হামলা হতে পারে বলে আমরা সতর্ক করেছিলাম। কেন্দ্রের তরফে নির্দিষ্ট তথ্যও দেওয়া হয়।”
শিন্দে নিজেই আজ পটনায় যাবেন বলে ঠিক করেছিলেন। কিন্তু আজ রাজগিরে নীতীশের অনুষ্ঠান ছিল। নীতীশ নিজেই বাম ও আঞ্চলিক দলগুলির সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী সম্মেলনে যোগ দিতে বুধবার দিল্লি আসছেন। দিল্লিতেই শিন্দের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি। তাই শিন্দে পটনা সফর বাতিল করলেও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব অনিল গোস্বামী, এনআইএ-র প্রধান শরদ কুমার আজ পটনায় আসেন। রাজ্যের মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব এবং ডিজিপি-র সঙ্গে বৈঠক করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব। এর পর গাঁধী ময়দান, পটনা জংশনে যান তিনি। পটনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আহতদের সঙ্গেও কথা বলেন। বুদ্ধগয়া বিস্ফোরণের পর বিহারে এই জঙ্গি-হামলা কী রাজ্য সরকারের ব্যর্থতাই তুলে ধরছে? জবাব এড়িয়ে যান স্বরাষ্ট্রসচিব। বিহারে ‘অ্যান্টি টেররিস্ট স্কোয়াড’ (এটিএস) গঠনের বিষয়ে তিনি বলেন, “রাজ্য সরকার এ নিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। এখনও কোনও অফিসার নিয়োগ করা হয়নি। রাজ্য চাইলে কেন্দ্রীয় সরকার তাদের সাহায্য করবে। প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হবে।”
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ দিন মোদীকে এসপিজি নিরাপত্তা দেওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিলেও বিজেপি-র বক্তব্য, পটনা-বিস্ফোরণেই প্রমাণ হয়ে গিয়েছে, তাদের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী সন্ত্রাসবাদী হামলার নিশানা। তাঁর নিরাপত্তার বন্দোবস্ত আরও কঠোর করা প্রয়োজন। দু’দিন পরে কানপুরে সভা করবেন মোদী। উত্তরপ্রদেশ পুলিশ এ দিন জানিয়েছে, সন্ত্রাসবাদীরা ওই সভাতেও হামলা চালাতে পারে। মাস দুয়েকের মধ্যেই মোদীর পশ্চিমবঙ্গ সফরে আসার কথা। সেই প্রসঙ্গেই বিজেপি সাংসদ শাহনওয়াজ হুসেন মঙ্গলবার কলকাতায় বলেন, “পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি কোনও বিজেপি-শাসিত রাজ্যে যান, তা হলে রাজধর্ম মেনেই তাঁর নিরাপত্তার ব্যবস্থা হবে। মমতার রাজ্যে মোদী এলেও সেই রাজধর্ম পালন করা হবে বলেই আমরা আশা করি।” ভাগলপুরের সাংসদ শাহনওয়াজের কথায়, “নীতীশ আসলে মোদীকে ঈর্ষা করেন! তাই নিরাপত্তায় ঢিলে দিয়েছিলেন। এটা অপরাধমূলক গাফিলতি! এরও তদন্ত হওয়া উচিত!”
বিহারে গিয়ে সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে বিঁধে মোদী যে সব মন্তব্য করেছিলেন, রাজগিরের ‘অধিকার সভা’ থেকে তার আবার পাল্টা বলেছেন নীতীশ। বিজেপি-ও এ দিনই দেশের ২৮টি শহরে নীতীশের পাল্টা বক্তব্য প্রচার করেছে! তারই অঙ্গ হিসেবে শাহনওয়াজ কলকাতায় প্রশ্ন তোলেন, কেন সে দিন গাঁধী ময়দানে মেটাল ডিটেক্টর রাখা হয়নি, সতর্কতা থাকা সত্ত্বেও কেন ময়দানে নজরদারি ছিল না এ সবের জবাব মুখ্যমন্ত্রী নীতীশকে দিতে হবে। কংগ্রেসের আঁচল ধরবেন বলে জেডিইউ নেতা সমঝোতা করে ফেলেছেন, এমন কটাক্ষও করেন শাহনওয়াজ।
|