একটি অঘটন খুলে দিল নতুন এক সম্ভাবনার দরজা।
মুজফ্ফরনগরে গোষ্ঠী সংঘর্ষের জন্য আগেই বিজেপি-র বিরুদ্ধে আঙুল তুলেছিলেন রাহুল গাঁধী। এ বার পটনা বিস্ফোরণের জন্য সরাসরি নরেন্দ্র মোদীকে দায়ী করে আক্রমণে ঝাঁপাল কংগ্রেস। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের অভিযোগ, “বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী গোটা দেশে যে ভাবে বিভাজন ও ঘৃণার আগুন ছড়াচ্ছেন, তার জেরেই সন্ত্রাসবাদের জন্ম হচ্ছে।” এই আক্রমণ প্রত্যাশিতই। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, নরেন্দ্র মোদীর পাশাপাশি পটনা বিস্ফোরণের জন্য এখন নীতীশ কুমার সরকারকেও দায়ী করছে কংগ্রেস। আসন্ন ভোটে লালু প্রসাদের সঙ্গে জোট গড়ার দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে কংগ্রেসে। গত কালের বিস্ফোরণ সেই দাবি আরও জোরালো করে তুলেছে। এমনকী, লালু-নীতীশ-রামবিলাসকে বিজেপি-বিরোধিতার এক সূত্রে গেঁথে তোলার কৌশল নিয়েও বাড়ছে জল্পনা।
কংগ্রেসে যাঁরা লোকসভা ভোটে লালু প্রসাদের সঙ্গে জোট গড়ার পক্ষে সওয়াল করে যাচ্ছিলেন, তাঁরা এখন আরও বেশি সরব হওয়ার সুযোগ পেয়ে গিয়েছেন। তা ছাড়া নীতীশের পক্ষে এখন বিজেপি শিবিরে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। এই অবস্থায় বিহারেও উত্তরপ্রদেশের কৌশলকে কাজে লাগানোর কথা ভাবতে শুরু করেছেন কংগ্রেসের নেতারা। বিজেপি-বিরোধিতার প্রশ্নকে সামনে রেখে মুলায়ম সিংহ যাদব ও মায়াবতীর মতো কট্টর শত্রুকেও কেন্দ্রে এক শিবিরে ধরে রাখা ও তাঁদের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে চলার পরীক্ষা বেশ কিছু দিন ধরেই দিয়ে চলেছে কংগ্রেস। এ বার কী লালু-নীতীশ-রামবিলাসকে এক সূত্রে গাঁথার চেষ্টা চালাবে কংগ্রেস? নীতীশ সরকারের সমালোচনা করে তাঁকে চাপে রাখার মধ্য দিয়ে কংগ্রেস সেই কাজটাই শুরু করে দিল বলে মনে করছেন জাতীয় ও বিহার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নেতাদের অনেকে।
সেই পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবেই নীতীশের সমালোচনা করে কংগ্রেস ও কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে কিছুটা চাপে রাখতে চাইছে বলে ইঙ্গিত মিলেছে দলীয় সূত্রেও। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে বলা হচ্ছে, মোদীর পটনা জনসভায় জঙ্গি হানার আশঙ্কা জানিয়ে সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্য অনেক আগেই দেওয়া হয়েছিল বিহার সরকারকে। বিহার সরকারকে পাঠানো সেই নোটও আজ ফাঁস করে দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের তরফে বলা হচ্ছে, নীতীশকে দায় নিতেই হবে। নিরাপত্তা ব্যর্থতার জন্য ব্যাখ্যা দিতে হবে তাঁকে।
ক’দিন আগেও যে নীতীশকে কংগ্রেসের পাশের টানার জন্য তৎপরতা দেখা গিয়েছে, তা সে বিহারকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়াই হোক কিংবা কেন্দ্রীয় নানা আর্থিক সাহায্য জোগানো তার পরেও কেন তাঁকে এই রকম আক্রমণ? দলীয় সূত্রে ইঙ্গিত, গত কাল মোদীর সভার বিপুল ভিড়ই নতুন ভাবে ভাবাচ্ছে কংগ্রেস নেতৃত্বকে। এমন ভিড় এক বারের জন্যও দেখাতে পারেননি রাহুল বা তাঁর টিম। এই অবস্থায় বিহারে শরিক বাছাইয়ের প্রশ্নে দুর্নীতির দায়ে জেলবন্দি লালুর বদলে রাহুল গাঁধীর প্রথম পছন্দ ছিলেন নীতীশ। কিন্তু কালকের বিস্ফোরণের পরে নীতীশের ব্যর্থতার দিকটিই তুলে ধরছে সব দল। এই অবস্থায় কোণঠাসা নীতীশকে সঙ্গী করে লালুকে উপেক্ষা করাটা বোধ হয় আর লাভজনক মনে করতে পারছেন না কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা। এটাও মাথায় রাখতে হচ্ছে, নীতীশের বিরুদ্ধে যে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার হাওয়া রয়েছে, সেটা লালুর ক্ষেত্রে নেই। বরং ক্ষমতায় না থেকেও বিহারে নিজেদের ভোট ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে লালুর কথা তাঁদের ভাবতেই হচ্ছে। এরই পাশাপাশি বিহারে ধর্মনিরপেক্ষ ত্রিশক্তিকে একজোট করে কংগ্রেসের পাশে আনা গেলে সেটা হবে ঢের বেশি লাভজনক। নিজেদের শিবিরে জোড়ার রাজনীতি নিয়ে এই নয়া ভাবনার পাশাপাশি বিজেপি-র বিরুদ্ধে আজ বিভাজনের রাজনীতি করার অভিযোগ আরও তীব্র করে তুলেছে কংগ্রেস।
২৪ নম্বর আকবর রোডে কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের তরফে সাংবাদিক বৈঠক করে দলীয় মুখপাত্র পি সি চাকো আজ বলেন, কেন্দ্রে প্রধান বিরোধী দল মনে করছে মেরুকরণের রাজনীতি করে তাঁদের রাজনৈতিক মুনাফা হবে। তাঁরা বরাবরই এই মারাত্মক কাজটাই এটা করে থাকেন।
পটনা বিস্ফোরণের পর গত কাল কৌশলগত ভাবেই চুপ ছিলেন কংগ্রেস নেতারা। মুজফ্ফরনগরে গোষ্ঠী সংঘর্ষের জন্য যে রাহুল গাঁধী বিজেপি-কে দায়ী করছিলেন, তিনিও গত কাল মোদী বা বিস্ফোরণ নিয়ে টুঁ শব্দও করেননি। কিন্তু ঘরোয়া আলোচনায় কংগ্রেস নেতারা এ-ও জানাচ্ছিলেন, বিস্ফোরণের ঘটনার স্পর্শকাতরতা অনুভব করে চুপ রয়েছেন রাহুল। কিন্তু তিনি বা কংগ্রেস এ ভাবে চুপ থাকবে না। বরং কংগ্রেস অচিরে দেশকে এটাই জানাবে, ঘৃণার রাজনীতি নিয়ে যে আশঙ্কা জানাচ্ছিলেন রাহুল, সেটাই সত্য প্রমাণিত হল।
এর ২৪ ঘণ্টা না কাটতেই পটনা বিস্ফোরণ নিয়ে আজ সকাল থেকে সরব হন কংগ্রেস নেতৃত্ব। শুরুতে দলের সাধারণ সম্পাদক দিগ্বিজয় সিংহ বলেন, “পটনা বিস্ফোরণের পর সুবিধাই হবে বিজেপি-র।” আর তার পরেই কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের তরফে মোদীর তীব্র সমালোচনা করা হয়। কোনও রাখঢাক না রেখে কংগ্রেস নেতাদের অভিযোগ, সনিয়া-রাহুল গরিবদের আর্থ সামাজিক ক্ষমতায়নের জন্য যখন প্রচারে নেমেছেন, তখন তা থেকে নজর ঘোরানোর জন্যই বিস্ফোরণ ঘটানো হচ্ছে। কারণ খাদ্য সুরক্ষার মতো প্রকল্প যে ভাবে গোটা দেশে সাড়া ফেলেছে তাতে ভয় পাচ্ছেন বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী। তাই গোটা দেশে ঘুরে ঘুরে তিনি চড়া সুরে বিভাজনের রাজনীতি করছেন। লোকসভা ভোটের এত আগে থেকে এমন সব ভাষায় প্রচার করছেন, যা ভারতের মতো পরিণত গণতন্ত্রে অচল। দেশে সদ্ভাবের পরিবেশ তিনি বিষিয়ে দেওয়ার কারণেই সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ ঘটছে।
কিন্তু বিস্ফোরণের প্রসঙ্গে নীতীশকেও ছাড়ছে না কংগ্রেস। কংগ্রেস সূত্রে খবর, আসলে মোদীর সভার ভিড় দেখার পরে কংগ্রেসের এক শীর্ষ সারির নেতা বলেছেন, “বিহারে উচ্চবর্ণের ভোট পায় বিজেপি। কাল কিন্তু গাঁধী ময়দানে শুধু উচ্চবর্ণের নয়, পিছিয়ে পড়া এবং অনগ্রসর যাদবরাও ছিলেন। বিজেপি যদি উচ্চবর্ণের পাশাপাশি পিছিয়ে পড়াদেরও ভোট পায় তা হলে বিহারে তারা নিঃসন্দেহে ভাল ফল করবে।” তাঁর কথায়,“মোদীর সভা কংগ্রেসকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে লালুর সঙ্গে এখনই জোট গড়া উচিত। লালুকে জামিনে মুক্ত করার ব্যবস্থা করে এখনই বিজেপি-বিরোধী প্রচারে তাঁকে সামিল করা উচিত। যাতে যাদব ও অনগ্রসর শ্রেণি মোদীর দিকে না চলে যায়।” এই সমীকরণের কারণেই সম্ভবত আজ নীতীশের বিরুদ্ধে সমালোচনা শুরু করেছে কংগ্রেস।
মোদীর সভায় বিস্ফোরণে নীতীশের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত হয়েছে জেডিইউ-এর প্রথম সারির নেতারাও মানছেন সে কথা। আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরেছে নীতীশের। পাল্টে গিয়েছে তাঁর শরীরি ভাষা। তীব্র সমালোচনার মুখে আত্মরক্ষা করতেই যেন বেশি ব্যস্ত তিনি।
জোট ছাড়ার জন্য বিজেপি নীতীশকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যা দিয়েছিল আগেই। কালকের বিস্ফোরণ তাদের হাতে নতুন অস্ত্র তুলে দিয়েছে। বিজেপি-র সুশীল মোদী আজ বলেন, “এটা নীতীশ সরকারের গাফিলতি। প্রশাসন ব্যর্থ সেই কারণেও।” একই সঙ্গে তাঁর অভিযোগ, “নরেন্দ্র মোদীকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয় শত্রু হিসেবে দেখছেন নীতীশ। এটাই দুর্ভাগ্য। সেই কারণে নিরাপত্তার বিষয়টি এতে গুরুত্ব পায়নি।” বিজেপি-র সিপি ঠাকুর বলেন, “এটা তো আমাদের কাছে যেমন দুঃখের, তেমনি রাজনৈতিক দিক থেকে এটা আমাদের কাছে প্রচার করার সুযোগ করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী।”
এখন পর্যন্ত যা পরিস্থিতি তাতে কিন্তু রাজ্যের মানুষের কাছে বিস্ফোরণের ঘটনা এবং নীতীশের পুলিশের ব্যর্থতা নিয়ে নানা রকমের প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। যারা বিজেপি-বরোধী তারাও কিন্তু নিরাপত্তার প্রশ্নে নীতীশের সমালোচনা করতে কেউ ছাড়ছে না। নীতীশের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে তাঁর ইস্তফার দাবি করেছেন লোক জনশক্তি পার্টির নেতা রামবিলাস পাসোয়ান।
আরজেডি-র রাম কৃপাল যাদব এ দিন বলেন, “রাজ্যে নিরাপত্তা নেই, লালু প্রসাদ অনেক দিন ধরেই এ কথা বলছিলেন। আজ সেটা প্রমাণ হয়ে গেল।” এ দিন লালুপত্নী রাবড়ী দেবীর সঙ্গে মুসলিম মহিলাদের একটি দল দেখা করতে এলে তিনি বলেন, “এখন নরেন্দ্র মোদীর মুসলিম প্রীতি জেগে উঠেছে। গোধরা-কাণ্ডের সময় সেটা তাঁর মনে ছিল না।” বুদ্ধগয়া-বিস্ফোরণের পরে গত কালের ঘটনাতেও দেশের সামনে বিহারের ভাবমূর্তি আরও এক বার খারাপ হল বলেও নীতীশের দিকে আঙুল তুলেছে আরজেডি। আর কংগ্রেস তাঁদের দেখতে চাইছে এক শিবিরে। |