রাহুল-তোপেই সম্প্রতি লুটিয়ে পড়েছে দাগিদের পদ বাঁচানোর অর্ডিন্যান্স। নয়তো পশুখাদ্য মামলায় হাজতবাসে থাকলেও সাংসদ পদটা অন্তত খোয়াতে হত না লালুপ্রসাদকে। রাঁচি জেলের মশার কামড়ে এমনই অবস্থা যে প্রবীণ যাদব নেতার স্বাস্থ্য নিয়ে সংশয়ে খোদ জেলর সাহেবও! অথচ লোকসভা ভোটে সেই লালুকেই ফের জোট-বন্ধু করতে দলের মধ্যে এখন জবর চাপে রাহুল গাঁধী। কংগ্রেসের বিহার ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একটা বড় অংশ এ ব্যাপারে বুঝিয়ে চলেছেন সনিয়া গাঁধীকেও। যাতে মাকে দিয়েও চাপ বাড়ানো যায় ছেলের ওপর।
তাঁদের যুক্তি, আপাতদৃষ্টিকে লালুকে যতই বেহাল মনে হোক না কেন, তাঁকে ও রামবিলাস পাসোয়ানকে নিয়ে জোট গড়লে জাত সমীকরণে বিহারে ফের কেল্লা হতে পারে। ঠিক যেমনটি হয়েছিল বছর দশেক আগে। ২০০৪-এর লোকসভা ভোটে বিহারের ৪০টি আসনের মধ্যে ২৯টিই জিতেছিল এই জোট।
যদিও কংগ্রেস সূত্রে খবর, রাহুল এখনও নীতীশ কুমার ও রামবিলাসকে নিয়ে জোট গড়লে কী পরিণতি হবে, তারই সাত-পাঁচ অঙ্ক কষছেন। তবে কিছুটা ঝুঁকে রয়েছেন নীতীশের দিকেই। আর এখানেই তাঁর সঙ্গে মতের অমিল হচ্ছে দলের বিহার ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সিংহভাগ প্রবীণ নেতার। শাকিল আহমেদ, দিগ্বিজয় সিংহ, সি পি জোশী, জয়রাম রমেশের মতো নেতারা সকলেই চান জোট হোক লালুর সঙ্গে। রাঁচির জেলে
বসেই জোটের জন্য লাগাতার কংগ্রেসকে বার্তা পাঠিয়ে চলেছেন আরজেডি-প্রধানও।
তবে গত লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের সঙ্গে আসন রফায় বসে এই লালুই এক সময় প্রবল দর হেঁকেছিলেন। তাতে ক্ষিপ্ত রাহুল শেষমেষ আলোচনার টেবিল ছেড়েই উঠে আসেন। ফলে একাই ভোট লড়ে আরজেডি। সেই ক্ষত এখনও ভোগাচ্ছে লালুকে। লোকসভা ভোটে মাত্র ৪টি আসন পেয়ে তখন থেকেই জোটের মর্ম বুঝেছেন যাদব কুলপতি। কিন্তু তিনি বুঝলে কী হবে! সুযোগ পেলেই দলের ঘরোয়া আলোচনায় এখনও সেই দর কষাকষির দৃষ্টান্ত দেন রাহুল। বলেন, ভিক্ষে করে আর জোট হবে না। শুধু রাহুল কেন, লালুকে ‘সবক’ শেখাতে কংগ্রেসের বিহার ও দিল্লির নেতারাও এককাট্টা ছিলেন একটা সময়। ২০১০-এ বিহার বিধানসভার ভোটে লালু জোট চাইলেও তাঁরা রাহুলের ‘একলা চলো’ নীতিকেও সমর্থন জানান। এমনকী, বিহারের এক নেতা তথা কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য সে সময় সনিয়াকে জানিয়েছিলেন, লালুর সঙ্গে জোট হলে দশ
জনপথের সামনে দাঁড়িয়েই ‘জহর’ খেয়ে নেবেন।
রাজনীতির দায় এমনই যে, জেলে যাওয়ার দু’দিন আগে কংগ্রেসের সেই নেতাকেই পটনা থেকে ফোন করে লালু তাগাদা দেন জোটের জন্য। আরজেডি সভাপতি তাঁকে বলেন, “কী যে করেন আপনারা! জোট এখনই ঘোষণা করে দেওয়ার জন্য একটু চাপ দিন না!” জবাবে কংগ্রেস নেতাটি হেসে বলেছিলেন, “এঁদের (সনিয়া-রাহুল) তো আপনি জানেন। সিদ্ধান্ত নিতে কত সময় নেন! তা ছাড়া দেখুন না দু’দিনের মধ্যে যা হবে (তত ক্ষণে লালুর জেলযাত্রা অনিবার্য হয়ে উঠেছে), তাতে যাদব আবেগে আপনার ভোট আরও দু’শতাংশ বেড়ে যাবে।” শুনে লালু প্রসাদ নাকি বেদম হেসেছিলেন।
তবে এই হাসি-মজার বাইরে মোদ্দা কথাটি হল, এক সময় জোট রুখতে বিষ খেতে চাওয়া ওই নেতার মতো কংগ্রেসের অনেকেই এখন বলছেন, লালুর সঙ্গে জোট না করাটা জেনেশুনে বিষপানের সামিল হবে। কংগ্রেসের শীর্ষ সারির এই নেতাদের যুক্তি, ২০০৪-এ লোকসভা ভোটে যখন আরজেডি-র সঙ্গে জোট হয়, তখন বিহারে লালু-সরকারের বয়স ১৫ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। যাদবদের ক্ষমতায়ন নিয়ে আবেগ অনেকটাই হালকা হয়ে এসেছে। কারণ, যাদবদের অনেকেই তত দিনে ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছেন, পারস্পরিক রেষারেষি শুরু হয়ে গিয়েছে পুরোদমে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি আলাদা। যাদবরা ক্ষমতার বাইরে। লালুপ্রসাদ জেলে যাওয়ার পর তাঁরা আরও শঙ্কায় রয়েছেন। ফলে ফের যাদব আবেগের উত্থান শুরু হয়েছে বিহারে।
এই পরিস্থিতিতে লালুকে সঙ্গী করলে কী লাভ, তার একটা হিসেবও কষছেন কংগ্রেস এই নেতারা। যার মূল কথাটি হল, ক্ষমতায় না থাকলেও লালুর ভোট কিন্তু কমেনি বিহারে। বিধানসভার আসনসংখ্যার হিসেবে আরজেডি এখন প্রান্তিক শক্তি। কিন্তু ভোট শতাংশের হিসেবে বিজেপি এবং জেডিইউ-এর ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে আরজেডি। ২০১০-এর বিধানসভা ভোটে নীতীশের সংযুক্ত জনতা দল পেয়েছিল সাড়ে ২২% ভোট। বিজেপি পেয়েছিল সাড়ে ১৬% ভোট। লালুর দল পেয়েছিল প্রায় ১৯ শতাংশ ভোট। কংগ্রেস ও রামবিলাসের লোকজনশক্তির ঝুলিতে এসেছিল যথাক্রমে ৮% ও ৭% ভোট। বিরোধী ভোট এ ভাবে ভাগাভাগি হওয়াতেই ২০০৪ সালে নীতীশ-বিজেপি জোট বাড়তি সুবিধা পেয়ে যায়। কিন্তু সেই জোট এখন নেই। এখন যদি কংগ্রেস, আরজেডি ও রামবিলাসের দল এককাট্টা হয়, তা হলে অঙ্কের হিসেবেই বিহার জয় হতে পারে।
কিন্তু রাহুল প্রশ্ন তুলছেন, এই একই ধরনের জোট অঙ্ক নীতীশ ও রামবিলাসকে সঙ্গেও নিয়েও তো হতে পারে। তা ছাড়া লালুপ্রসাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির দাগ এখন আরও স্পষ্ট ও প্রমাণিত। এর জবাবে কংগ্রেস নেতারা তাঁকে বোঝাচ্ছেন, প্রথমত সংযুক্ত জনতা দলের ভোট অন্য শরিকের কাছে স্থানান্তরিত হয় না। তাই জেডিইউ-কে সঙ্গে নিয়ে লড়ে লাভ নেই। তা ছাড়া, নীতীশের রেখচিত্র এখন নিম্নমুখী। কিন্তু আরজেডি-র সঙ্গে জোট গড়লে কংগ্রেস যে যাদব ভোট পায়, তার অতীত অভিজ্ঞতা রয়েছে। তা ছাড়া, লালুপ্রসাদের রেখচিত্র যে উর্ধ্বগামী তা সম্প্রতি বিহারে সবক’টি উপনির্বাচনেও দেখা গিয়েছে। কংগ্রেস নেতৃত্বের আরও যুক্তি, দুর্নীতির দাগের বিষয়টি বড় কথা নয়। ঝাড়খণ্ডে শিবু সোরেনের বিরুদ্ধেও তো দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি তাঁর ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার সঙ্গে জোট গড়ে সেখানে সরকার গঠন করেছে কংগ্রেস।
সেই যুক্তিতে লালুপ্রসাদেই বা
অসুবিধা কোথায়?
কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “রাহুল যে এসব বুঝছেন না তা নয়। তা ছাড়া দলের বেশির ভাগ নেতাই যখন লালুর দিকে ঝুঁকে রয়েছেন, তখন রাহুলের পক্ষে একা উল্টো পথে হাঁটা কঠিন হবে। বরং হতে পারে শেষমেষ ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি হবে এ বার। তা শুধু বিহারে জোট সমীকরণে নয়, ভোট ফলাফলেও।”
|