|
|
|
|
পিছিয়েই যাচ্ছে বর্ষা, সঙ্গে ঠেলা নিম্নচাপ |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
ক্যালেন্ডারে কার্তিক। কিন্তু বৃষ্টি ছাড়ছে কই!
কালীপুজোর সাত দিন আগেও দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে এমন ধারাপাত সাম্প্রতিক কালে দেখা যায়নি। আবহাওয়া দফতরের তথ্য বলছে, চলতি অক্টোবরের শুরু থেকে তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত দক্ষিণবঙ্গে স্বাভাবিকের থেকে প্রায় দেড় গুণ বেশি বৃষ্টি হয়েছে! সরকারি মতে যে সময় বিদায় নেওয়ার কথা, বর্ষা মাঠ ছেড়েছে তারও বারো দিন পরে। কিন্তু সে যেতে না যেতেই বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা নিম্নচাপের বৃষ্টি ভাসিয়ে দিচ্ছে অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশার সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গকেও। আবহবিদেরা বলছেন, সদ্য হয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় ‘পিলিনের’ রেশ ধরে এখনও বাতাসে জলীয় বাষ্প যথেষ্ট। সঙ্গে যোগ হয়েছে বাংলাদেশের কাছে থাকা ঘূর্ণাবর্ত। এরাই জোর বাড়িয়েছে নিম্নচাপের। ত্র্যহস্পর্শে দেড় দিন ধরে সচিন তেন্ডুলকরের মতো ব্যাটিং করল বৃষ্টি।
কলকাতা শহরে এর ফল হয়েছে মারাত্মক। এ বারের বর্ষায় এই শহর হাবুডুবু খেয়েছে দু’দিন। কিন্তু শনিবার যে ভাবে নাকাল হলেন কলকাতাবাসী, তার কাছে সে দু’দিন কিছু নয় বলেই সোজাসাপ্টা জানাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। আলিপুর বডিগার্ড লাইন, ঠনঠনিয়ার মতো যে সব জায়গায় জল জমে, সেগুলি তো আছেই, ভিআইপি রোড-গোয়াবাগানের মতো যে সব এলাকা চট করে ভাসে না, সেখানেও এ দিন জল ঠেলেছেন বাসিন্দারা। তবে ভোর থেকে পুরসভা সব ক’টি পাম্প চালানোয় এবং দুপুরের পরে বৃষ্টির দাপট কমায় সন্ধ্যার মুখে পরিস্থিতি কিছুটা ভাল হয়।
এমন হেমন্ত দিনেও ছাতা মাথায় হাঁটু বা কোমর জল ভেঙে কাজে বেরোনো হতাশ আমবাঙালির জিগ্গাসা, বৃষ্টির হলটা কী!
প্রশ্ন উঠেছে,
• বর্ষা কি তবে পিছিয়ে যাচ্ছে?
• বঙ্গোপসাগরেই বা এত নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড় কেন? |
 |
জলমগ্ন রাস্তায় আটকে পড়েছে টাকার গাড়ি। বিপাকে নিরাপত্তাকর্মীরা।
শনিবার আমহার্স্ট স্ট্রিটে সুমন বল্লভের তোলা ছবি। |
বর্ষার যে চরিত্র বদলাচ্ছে, তা নিয়ে কয়েক বছর ধরেই সরব আবহবিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদদের একাংশ। নদী-বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র বলছেন, ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ-এর সাম্প্রতিক রিপোর্টে বলা হচ্ছে, ভারতে বর্ষা পিছিয়ে যাচ্ছে। শুখা মরসুমে কম বৃষ্টি হবে। নিয়মমাফিক বর্ষাকাল পেরিয়ে বৃষ্টি চলবে। যেমনটা হয়েছে এ বছর। কল্যাণবাবুর কথায়, “আমার জীবদ্দশায় অক্টোবরে এমন বৃষ্টি দেখিনি।” কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের শিক্ষক লক্ষ্মীনারায়ণ শতপথী বলেন, “২৫-৩০ বছরের তথ্য ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, বর্ষাকাল পিছোচ্ছে। বেশির ভাগ বছরেই ভরা বর্ষায় (অর্থাৎ জুলাইয়ে) পর্যাপ্ত বৃষ্টি হচ্ছে না।”
তবে উল্টো মতও আছে। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ বলছেন, “বর্ষার চরিত্র সামগ্রিক ভাবে বদলে যাচ্ছে এ কথা এত সহজে বলা সম্ভব নয়।” গত কয়েক বছরের উদাহরণ দেখিয়ে তাঁরা বলছেন, গত চার বছরে অক্টোবর মাসে দক্ষিণবঙ্গে এমন বৃষ্টির দেখা মেলেনি। ২০১১ সালে অক্টোবর মাসে তো বর্ষার ঘাটতি পৌঁছে গিয়েছিল ৭৮ শতাংশে। কিন্তু এ বারে? এই বছর যে বর্ষা কিছুটা হলেও বদলে গিয়েছে, সে কথা মেনে নিয়েছেন তাঁরা। আবহবিজ্ঞানীদের বক্তব্য, পিলিনের দাপটেই স্লগ ওভারে এত ধুন্ধুমার ব্যাটিং করেছে বর্ষা।
কিন্তু তাতেও তো শেষ হচ্ছে না খেলা। আম-বাঙালির এই প্রশ্ন নিয়েই শনিবার ফেসবুকে আঙুলের ডগায় ঘুরেছে ছড়া, “গ্রীষ্ম-শরৎ-শীত/ বর্ষার কাছে চিৎ।”
আম-বাঙালির এমন ভাবনা যে সঙ্গত, তা মেনে নিয়েছেন মৌসম ভবনের এক প্রবীণ বিজ্ঞানীও। তিনি বলছেন, “আমাদের খাতায়-কলমে বর্ষা বিদায় নিয়েছে। কিন্তু বৃষ্টি কমেনি। তাই সাধারণ মানুষ মনে করছেন বর্ষা থেকে গিয়েছে।” তিনি জানান, শুক্রবার রাত থেকে যে বৃষ্টি কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গে শুরু হয়েছে, তার কারণ তেলঙ্গানার উপরে দাঁড়িয়ে থাকা নিম্নচাপ। চলতি সপ্তাহেই তামিলনাড়ু উপকূলের কাছে তৈরি হয় ওই নিম্নচাপটি। পরে তা উপরের দিকে উঠে এসে হাজির হয় অন্ধ্র উপকূলে। সাধারণত, বর্ষার পরবর্তী সময়ে (অক্টোবর-নভেম্বরে) দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ তৈরি হলে তা তামিলনাড়ু ও সংলগ্ন অন্ধ্র উপকূলে বৃষ্টি ঘটায়। পরে স্থলভূমির উপর দিয়ে তা চলে যায় আরব সাগরের দিকে।
আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ জানান, নিম্নচাপটির তামিলনাড়ু-অন্ধ্র উপকূল দিয়ে স্থলভূমিতে ঢুকে আরব সাগরের দিকে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বায়ুপ্রবাহের অদল-বদলে তা অন্ধ্র উপকূল বরাবর উপরের দিকে উঠতে থাকে। কেন?
আবহবিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা, এখন উত্তর-পূর্ব দিক থেকে মৌসুমি বায়ু বইছে (যাকে বর্ষার ফেরত যাওয়া বলে)। সেই বায়ুপ্রবাহের বাধাতেই নিম্নচাপটি স্থলভূমি হয়ে আরব সাগরের দিকে যেতে পারেনি। হাজির হয়েছে অন্ধ্র উপকূলে। ফলে তৈরি হয়েছে একটি শক্তিশালী নিম্নচাপ অক্ষরেখা। তা ওড়িশা, দক্ষিণবঙ্গ হয়ে অসম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। তার সঙ্গে জুড়েছে বাংলাদেশ ও সন্নিহিত এলাকার একটি ঘূর্ণাবর্ত। এবং পিলিন-পরবর্তী বাতাসে জলীয় বাষ্পের প্রভাব। এই তিনের দাপটেই দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। |

তামিলনাড়ু-অন্ধ্রপ্রদেশ হয়ে নিম্নচাপের
যাওয়ার কথা ছিল আরব সাগরের দিকে।
|

কিন্তু উত্তর-পূর্ব দিক থেকে আসা হাওয়ার
বাধায় তা চলে আসে অন্ধ্র উপকূলে।
|

ফলে ওড়িশা, বাংলা হয়ে অসম পর্যন্ত তৈরি হয় নিম্নচাপ অক্ষরেখা। |
|
কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল (জলবায়ু) বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় শনিবার বলছেন, “অক্ষরেখাটি প্রায় ৫ হাজার কিলোমিটার এলাকায় বিস্তৃত। ফলে এর শক্তিও অন্যান্য অক্ষরেখার চেয়ে অনেক বেশি।”
আইপিসিসি-র রিপোর্টটিতে বর্ষার চরিত্র বদলের কথা ছাড়াও বলা হয়েছে, সমুদ্রতলের তাপমাত্রা বাড়ছে। তাতেই ঘনঘন নিম্নচাপ এবং কিছু ক্ষেত্রে ঘূর্ণিঝড়ও তৈরি হচ্ছে। এক আবহবিদ জানান, সাধারণত সমুদ্রতলের উষ্ণতা ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলেই নিম্নচাপ তৈরি হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। আবহবিজ্ঞানীরা বলছেন, বর্ষা বিদায়ের পরে ঘূর্ণিঝড় বা নিম্নচাপের ফলে প্রবল বৃষ্টি বিরল, কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। ১৯৯৯ সালে সুপার সাইক্লোনের মতো প্রবল ঘূর্ণিঝড়ও ওড়িশার উপরে আছড়ে পড়েছিল অক্টোবর মাসের শেষে। তবে সে বারেও এমন বৃষ্টি হয়নি দক্ষিণবঙ্গে।
তা হলে এ বারে হচ্ছে কেন?
এ বারে নিম্নচাপটি শুক্রবার থেকে প্রায় একই এলাকার উপরে দাঁড়িয়ে ছিল। ফলে তার শক্তিও বেড়েছে। তার ফলেই অন্ধ্রপ্রদেশ-ওড়িশা-পশ্চিমবঙ্গে এমন টানা বৃষ্টি। মৌসম ভবনের এক পদস্থ কর্তা বলেন, “নিম্নচাপের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে পরিমণ্ডলের উপরিস্তরের বায়ুপ্রবাহ। গত কয়েক দিনে উপরিস্তরে বায়ুপ্রবাহে কিছু অদল-বদল ঘটার ফলেই সেটি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল।”
তবে শনিবার রাতে উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণের পরে কিছুটা হলেও আশার কথা শুনিয়েছেন আবহবিদেরা। গোকুলবাবু বলেন, “নিম্নচাপটি তেলঙ্গানা ও সংলগ্ন এলাকায় দাপট দেখিয়ে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়বে। রবিবার থেকে দক্ষিণবঙ্গে আবহাওয়ার উন্নতি হবে। সোমবার থেকে পরিষ্কার আকাশের দেখা মিলবে বলে আশা করা যায়।”
সাধারণত, পুরোদস্তুর শীত পড়ার আগে একটু বৃষ্টি হয়। প্রশ্ন উঠেছে, এই বৃষ্টির পিছু নিয়েই তড়িঘড়ি শীত আসবে? আবহাওয়া দফতর কিন্তু তা নিশ্চিত করে বলছে না।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, “বৃষ্টির প্রভাব কাটলেই বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কমবে। ভোরের দিকে থাকবে একটু হিম-হিম।”
|
পুরনো খবর: বিপর্যস্ত অন্ধ্র-ওড়িশায় মৃত ২১, ব্যাহত রেল চলাচল |
|
|
 |
|
|