তৃতীয় ফ্রন্টের লক্ষ্যেও মমতার লড়াই সেই সিপিএমের সঙ্গেই
হল দু’টি ‘তৃতীয় ফ্রন্ট’ গঠনের কাহিনি!
এক দিকে আগামিকাল দেশের রাজধানী শাহি দিল্লির তালকাটোরা স্টেডিয়ামে সিপিএম কাণ্ডারী প্রকাশ কারাটের তৃতীয় ফ্রন্ট গঠনের চেষ্টা। অন্য দিকে উনিশ শতকের রেনেসাঁ শহরে বসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেষ্টা একটি আঞ্চলিক ফ্রন্ট গঠনের।
প্রকাশ কারাটের সম্মেলনের ঘোষিত উদ্দেশ্য সাম্প্রদায়িকতা রুখতে (পড়ুন নরেন্দ্র মোদীকে) অকংগ্রেসি অবিজেপি শক্তিগুলিকে নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ মঞ্চ গঠন। ক’দিন আগেও বিজেপি-র সঙ্গী, অধুনা মোদীর সব থেকে বড় সমালোচক বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার আগামিকাল এই উপলক্ষে দিল্লি আসছেন। সিপিএমের ডাকে সাড়া দিয়ে থাকবেন মুলায়ম সিংহ যাদব, জয়ললিতা, নবীন পট্টনায়ক এমনকী এনসিপি-র প্রতিনিধিরাও। সিপিএমের কিছু নেতা এতে আহ্লাদিত। ক’দিন আগেও নীতীশ কুমার আর মুলায়ম সিংহ যাদবের হাত ধরে ফেডারেল ফ্রন্ট গঠনে সক্রিয় হয়েছিলেন মমতা। নীতীশ-মমতা কথাবার্তা কিছুটা এগিয়েওছিল। নবীন এবং জয়ললিতাকেও কাছে টানার চেষ্টা করেছিলেন মমতা। সে চেষ্টা তবে অঙ্কুরেই বিনষ্ট?
তৃণমূল বা মমতার প্রধান সাংগঠনিক সেনাপতি মুকুল রায় কিন্তু সেটা মনে করছেন না। তাঁর কথায়, “পুডিংটা খেতে ভাল কিনা, সেটা না খেয়েই ঘোষণা করা যায় কি? বিরিয়ানির স্বাদ নিতে গেলেও তার প্রাথমিক শর্ত, সুষ্ঠু রন্ধন প্রণালী দিয়ে সেটাকে খাওয়ার উপযুক্ত করে তুলতে হবে।” তৃণমূল নেতৃত্বের ব্যাখ্যা, সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে সিপিএম তথা বামেদের শক্তিকতটুকু? পশ্চিমবঙ্গে গত পঞ্চায়েত এবং পুর নির্বাচনগুলিতে সিপিএমের শতকরা ভোট ধারাবাহিক ভাবে কমেছে। তাদের সাংগঠনিক শক্তি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। রাজ্যে ৪২টি আসনের মধ্যে এখন সিপিএমের আসন ৯। এ বারের লোকসভা নির্বাচনে এই আসন সংখ্যা কোথায় দাঁড়াবে, সেটা আগে সিপিএম দেখুক। তার পরে এ সব করুক।
তৃণমূল নেতৃত্বের বক্তব্য, মমতার কৌশল হল, এখনই দিল্লি এসে সিপিএমের মতো লাফঝাঁপ না-করে পশ্চিমবঙ্গে যে কোনও মূল্যে নিজেদের আসন বাড়িয়ে নেওয়া। তৃণমূল নিজের আসন বাড়িয়ে নিতে পারলে তাদের সঙ্গে অন্য আঞ্চলিক দলগুলির হাত মেলানোর সম্ভাবনা প্রকৃতির নিয়মেই বেড়ে যাবে। এর আগে অসম-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলে তৃণমূল অনেক প্রার্থী দিয়েছে। উত্তরপ্রদেশের কিছু আসনেও তৃণমূল নির্বাচন লড়েছে। এ বারও লোকসভা নির্বাচনে শুধু উত্তরপ্রদেশ নয়, কেরল, তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যে প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তাব দলের অন্দরে রয়েছে। যুক্তি হল, দেশের অনেক আসনে প্রার্থী দিলে নির্বাচন কমিশনের কাছে সর্বভারতীয় দলের স্বীকৃতি পেতে সুবিধা হবে। কিন্তু পাল্টা যুক্তিটি হল তৃণমূলের পশ্চিমবঙ্গে যে দাপট, তা অন্য রাজ্যে নেই। সুতরাং গোটা দেশে প্রচুর প্রার্থী দিয়ে অহেতুক হার স্বীকার করার মধ্যে কোনও গৌরব নেই। তাই তৃতীয় ফ্রন্ট গঠনের জন্যও পশ্চিমবঙ্গে শক্তি বাড়াতে তৎপর মমতা।
পাশাপাশি মমতা নিজে অন্ধ্রপ্রদেশের জগন্মোহন রেড্ডি, জয়ললিতা, উত্তরপ্রদেশের অখিলেশ যাদব এমনকী নীতীশ কুমারের সঙ্গেও যোগাযোগ রেখে চলছেন। ক’দিন আগেই দার্জিলিং যাওয়ার পথে মমতার কাছে ফোন এসেছিল জগনের। মমতা তাঁকে বলেন, ‘তুমি যেমন তেলঙ্গানাকে সমর্থন করতে পার না, তেমনই আমি গোর্খাল্যান্ডকে সমর্থন করতে পারি না। অখণ্ড অন্ধ্রের মতো আমিও অখণ্ড বাংলা চাই।’ এই বিষয়টিতে মমতা ও জগনের মধ্যে ঐকমত্য স্পষ্ট। আবার নরেন্দ্র মোদীর মোকাবিলায় এবং বিহারের সাম্প্রতিক সঙ্কট থেকে মুক্তি পেতে নীতীশ আগামিকাল সিপিএমের ডাকা সম্মেলনে সশরীরে হাজির হচ্ছেন বটে, কিন্তু সিপিএম নেতারা জানেন, নীতীশই হোন বা মুলায়ম তৃতীয় ফ্রন্ট গঠনের প্রশ্নে এঁরা নির্ভরযোগ্য নন।
বস্তুত সবটাই নির্ভর করছে ২০১৪ সালের নির্বাচনে কার কাছে কত সংখ্যা থাকবে, তার উপর। রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, আসলে ভারতের রাজনীতির ব্যবস্থাটি এখন যে রকম, তাতে আজ পর্যন্ত কখনওই কংগ্রেস অথবা বিজেপি এই দু’টি প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের সাহায্য ছাড়া কেন্দ্রে কোনও সরকার গঠন সম্ভব হয়নি। ’৭৭ সালের মোরারজি দেশাইয়ের সরকারে সমর্থক ছিল জনসঙ্ঘ (পরবর্তী কালে বিজেপি)। ’৮৯-এ ভি পি সিংহের সরকারে বিজেপি ছিল সমর্থক দল। আবার দেবগৌড়া, গুজরাল, চন্দ্রশেখর প্রতিটি সরকারের সমর্থক ছিল কংগ্রেস।
প্রকাশ কারাট বা সীতারাম ইয়েচুরি যে এ সব জানেন না, তা নয়। এর আগের লোকসভা নির্বাচনে তাঁরা অতি উৎসাহী হয়েছিলেন মায়াবতীকে সামনে রেখে তৃতীয় ফ্রন্টের সরকার গঠনের। সেই স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়। ইয়েচুরি সে দিনও মনে করতেন এবং আজও মনে করেন, বিজেপি-র মতো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রুখতে কংগ্রেসের সহায়তা নিতেই হবে। তাই পার্টি কংগ্রেসের দলিল অনুযায়ী তৃতীয় ফ্রন্ট গঠন না করে তৃতীয় বিকল্পের অনুসন্ধান করার দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যে যাওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। এ বার অবশ্য কারাট ঠেকে শিখেছেন। এ বার তাই কারাট-ইয়েচুরির মধ্যে মতপার্থক্য কম। সিপিএমের আপাতত রণকৌশল, যে হেতু পশ্চিমবঙ্গে দলের অবস্থা করুণ, তাই জাতীয় স্তরে ধর্মনিরপেক্ষতার বামপন্থী বিশ্বাসযোগ্যতাকে মূলধন করে জোট গঠনের চেষ্টা করা উচিত। তাতে ভবিষ্যতে দরকার মতো সেই জোট কংগ্রেসের সমর্থক গোষ্ঠীতে পরিণত হতে পারে।
মুলায়ম, নীতীশ, জয়ললিতা সকলেই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। সিপিএমের লক্ষ্য, মমতাকে বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ মিলিজুলি সরকার গঠনের চেষ্টা করা। যে কোনও মূল্যে জাতীয় রাজনীতি থেকে মমতাকে অপ্রাসঙ্গিক করে রাখাটা সিপিএমের কাছে জরুরি। সিপিএম চায় পরিস্থিতি এমন হোক, যাতে মমতা কংগ্রেসের সঙ্গে ২০১৪ এ জোট করতে না পারেন। পশ্চিমবঙ্গের ৩০% সংখ্যালঘু ভোটের দিকে তাকিয়ে বিধানসভার আগে এনডিএ-র শরিক হওয়াটাও মমতার পক্ষে কঠিন। সব মিলিয়ে মমতা যাতে জাতীয় রাজনীতিতে ব্রাত্য হন, সেটাই লক্ষ্য সিপিএমের।
মমতা আবার মনে করছেন, গোটা দেশে তীব্র কংগ্রেস বিরোধী হাওয়া রয়েছে। আবার মোদীর নেতৃত্বে জোট সরকার গঠন গড়াও কঠিন। এই অবস্থায় যে আঞ্চলিক দলের আসন বেশি হবে, তাকে বাদ দিয়ে কেন্দ্রে সরকার গড়া যাবে না। তাই মমতা আপাতত দিল্লিতে সম্মেলন করার চেয়ে জেলায় ভোট বাড়াতে বেশি ব্যস্ত। গণতন্ত্রে শেষ কথা বলে সংখ্যা। কার ঝুলিতে কত সংখ্যা আসবে সেটা অজানা হলেও, মমতা ও কারাট তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ার লক্ষ্যে লড়াইয়ে ব্যস্ত।

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.