রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বিশ্বাসভঙ্গ’ করেছিলেন মুলায়ম সিংহ যাদব। কিন্তু রাজনীতিতে পুর্নচ্ছেদ বলে কিছু হয় না। উত্তরপ্রদেশের এই প্রবীণ সমাজবাদী নেতা মমতাকে জানিয়েছেন, ‘যা হয়ে গিয়েছে, হয়ে গিয়েছে। এখন ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আমাদের রাজনৈতিক বোঝাপড়া অনেক বেশি জরুরি।’
মুলায়মের কাছ থেকে আঘাত পেয়েও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু তাঁর সম্পর্কে কোনও কটূ মন্তব্য করেননি। বরং কিরণময় নন্দের মতো সপা-র রাজ্যসভার সদস্যের মাধ্যমে সম্পর্কটা অটুট রেখেছেন। মহাকরণে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী তথা মুলায়ম-পুত্র অখিলেশ যাদবের সঙ্গে আজ মমতার বৈঠকের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত এটাই।
যে দিন অখিলেশ-মমতার বৈঠক হল, সেই দিনই সপা-র মঞ্চ থেকে মুলায়মের সামনে মনমোহন সিংহের সরকারকে তুলোধোনা করেন দলের নেতারা। মুলায়মও তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ার ডাক দেন। বস্তুত, মূল্যবৃদ্ধি থেকে বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি এমন নানা বিষয়ে মমতা ও মুলায়ম একই সুরে কংগ্রেসের সমালোচক।
মুলায়মের এই তৃতীয় ফ্রন্ট গঠনের চেষ্টাকে কী চোখে দেখছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব? কংগ্রেসের মুখপাত্র সত্যব্রত চতুর্বেদী বলেন, “মুলায়ম আসলে ২০১৪ সালের কথা ভেবে নিজের জনসংযোগ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন।” এবং এই প্রেক্ষিতেই তাঁর মন্তব্য, “ভারতের রাজনীতিতে যদি দেবগৌড়া প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, তা হলে মুলায়মই বা কেন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখবেন না? ভারতীয় সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখা নিয়ে তো কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই।” কিন্তু মুলায়ম বা মমতা, কেউই যে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে বিজেপির সঙ্গ নেবেন না, সে কথা উল্লেখ করে তাঁর মন্তব্য, “কংগ্রেসের মতো একটা বড় দলকে বাদ দিয়ে তৃতীয় ফ্রন্ট, চতুর্থ ফ্রন্ট, পঞ্চম ফ্রন্ট, কোনও কিছুই হতে পারে না, সেটা ওঁরাও জানেন।” |
কংগ্রেস নেতা এ কথা বললেও আজ কিন্তু মমতা-অখিলেশের বৈঠক নিয়ে অসীম আগ্রহ ছিল দিল্লির। মুলায়ম শিবির বলছে, মমতা যেমন বিহারের পরস্পরবিরোধী দুই শক্তি লালু ও নীতীশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলছেন, সেই পথে চলেছেন মুলায়মও। নিজে দিল্লিতে প্রকাশ কারাটের সঙ্গে বৈঠক করছেন, সিপিএমের সঙ্গে যৌথ ভাবে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিচ্ছেন, আবার পুত্রের মাধ্যমে মমতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের চেষ্টা চালাচ্ছেন। সপা-র সাধারণ সম্পাদক মোহন সিংহ আজ কলকাতায় বলেছেন, “আমরা মমতাকে সঙ্গে চাই। আবার বামপন্থীরাও আমাদের স্বাভাবিক মিত্র।” দলের আর এক নেতা রেহমানি বলেন, “রাজনীতিতে তো এটাই স্বাভাবিক। সকলেই সকলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন। কিন্তু সরকার কে গড়বে, সেটা বলবে সংখ্যা।”
মুলায়মের মতো বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারও মমতার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। নীতীশ আজ বলেন, “আমরা উন্নয়নের প্রশ্নে একটা পূর্বাঞ্চলীয় সঙ্ঘ গঠন করতে পারি, যেখানে মমতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। আমরা সমবেত ভাবে কেন্দ্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধে সরব হতে পারি।” দিল্লিতে অনেকে বলছেন, এটা মুখ্যমন্ত্রীদের ট্রেড ইউনিয়ন-বাদ। আপাতত আঞ্চলিক দলগুলি সমবেত ভাবে একটা মঞ্চ তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। যার লক্ষ্য ২০১৪-র লোকসভা ভোট। তখনই ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস হওয়ার সম্ভাবনা।
মমতা-মুলায়ম, দু’জনেই মনে করছেন, কংগ্রেসের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব এবং জনপ্রিয়তা কমছে। বিশেষত কয়লা কেলেঙ্কারির পরে। এই অবস্থায় শরিক বা সমর্থক হিসেবে সরকারের সঙ্গে থেকে ‘গরল’ পান করা উচিত, নাকি আগেই সমর্থন প্রত্যাহার করে দ্রুত অন্তর্বর্তী ভোটের পথে হাঁটা উচিত, এই প্রশ্ন মুলায়ম-মমতা দু’জনের মাথাতেই রয়েছে। দু’টি দলই তাই পরিস্থিতি যাচাই করে চলেছে। এবং দুই নেতৃত্বই মনে করছেন, যত তাড়াতাড়ি লোকসভা ভোট হবে, ততই তাঁদের ভাল ফলের সম্ভাবনা বেশি।
মমতা-মুলায়ম, দু’জনেই সমর্থন প্রত্যাহার করলে কি সরকারের পতন অনিবার্য? সংখ্যার হিসেবে মায়াবতীও যদি সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দেন, তা হলে মনমোহন সরকারের পতনের যথেষ্ট সম্ভাবনা। সে ক্ষেত্রে বামেদের সাহায্য নিয়েও সম্ভবত সরকার বাঁচাতে পারবেন না সনিয়া গাঁধী। তবে মুলায়মের সঙ্গে মিলে মায়াবতীও সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দেবেন কি? সরকার বাঁচাতে কি অন্য ছোট দলগুলির সাহায্য জোগাড় করতে পারবে কংগ্রেস? এই প্রশ্নগুলি নিয়ে দু’টি দলের ভিতরেই কথা চলছে। যদিও প্রকাশ্যে দু’পক্ষই বলছে যে, ‘আমরা সরকারের পতন চাই না। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি রোধে এবং দুর্নীতি দমনে ব্যবস্থা চাই।’
আসলে মমতা ভালই জানেন, কংগ্রেস বা বিজেপি, এই দুই বড় দলের সমর্থন ছাড়া কেন্দ্রে শুধু আঞ্চলিক দল নিয়ে সরকার গঠন করা সম্ভব নয়। পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু সমাজের ‘মসিহা’ মমতার পক্ষে বিজেপির সঙ্গে প্রত্যক্ষ সমঝোতা এখন কার্যত অসম্ভব। সে জন্যই কেন্দ্রকে চাপ দিয়ে রাজ্যের দাবি আদায়ের কৌশল নিয়েছেন তিনি এবং মুলায়ম দু’জনেই। আবার, ঐক্যবদ্ধ থেকে লোকসভা নির্বাচনে একটা নির্ধারক শক্তির ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চাইছেন।
আজ কলকাতা সাক্ষী থাকল এই রাজনৈতিক মহড়ার। |