এ কলকাতার নীচে আছে আর একটা কলকাতা।
সেখানকার ছানা-পোনা, ধেড়ে-ধাড়িরা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে শহরময়। তাদের দেদার বংশবৃদ্ধিতে চিন্তিত খোদ পূর্ত দফতরের কর্তারাও। তাদের দৌরাত্ম্যে কখনও ফাটল ধরছে ঢাকুরিয়া সেতুতে, কখনও বা গর্ত তৈরি হচ্ছে রেড রোডে। আবার কখনও বা ফাটল ধরছে ধর্মতলার রাস্তায়। সোমবারও এসপ্ল্যানেড (ইস্ট) রাস্তা ফাটিয়ে ফেলেছে তারা।
এই মূষিকবাহিনীর দৌরাত্ম্যে কলকাতা কি তবে ‘হ্যামেলিন’ হয়ে উঠতে চলেছে!
পূর্ত দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, এসপ্ল্যানেড থেকে ভিক্টোরিয়া পর্যন্ত শহরের ব্যস্ত এলাকার রাস্তার নীচে ইঁদুরের এক বিরাট সাম্রাজ্য রয়েছে। এখন এই সাম্রাজ্য ক্রমশ বিস্তার লাভ করে ছড়িয়ে পড়ছে দক্ষিণে। ঢাকুরিয়া, বন্ডেল রোড এলাকার মাটির নীচে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ইঁদুরবাহিনী।
পূর্ত দফতরের কর্তারা জানিয়েছেন, ইঁদুরেরা রাস্তার নীচের মাটি আলগা করে বাসা বাঁধে। টানা ভারী বৃষ্টি হলে রাস্তার উপরের পিচের আস্তরণ নরম হয়ে যায়। এর ফাঁক দিয়ে বৃষ্টির জল রাস্তার নীচে থাকা ইঁদুরের গর্তে ঢুকে পড়ে। ফলে রাস্তায় ফাটল তৈরি হয়। এর মধ্যেই শহরের ঢাকুরিয়া ব্রিজ, বন্ডেল গেট উড়ালপুলের নীচে ইঁদুরের উপদ্রব সামলাতে কালঘাম ছুটে গিয়েছে পূর্ত দফতরের কর্তাদের। |
প্রাণী বিশেষজ্ঞদের মতে, এই শহরের মাটির নীচে অনেক মেঠো ইঁদুর রয়েছে। শহরের উপচে পড়া ডাস্টবিন এবং পথেঘাটে গজিয়ে ওঠা খাবারের দোকানের সৌজন্যে সহজেই প্রচুর চর্ব্য-চোষ্য মেলে তাদের। বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য জানাচ্ছেন, অন্য প্রাণীদের তুলনায় ইঁদুরদের খুব কম খাবার দরকার হয়। যে কোনও পরিবেশে সহজেই মানিয়ে নিতে পারে তারা। আর বংশবিস্তার! জুওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার প্রাক্তন যুগ্ম অধিকর্তা সুজিত চক্রবর্তী বলেন, ‘‘একটি মেঠো ইঁদুর বছরে পঁয়ষট্টিটা বাচ্চার জন্ম দিতে পারে। জন্মের দু’মাস পর থেকেই এরা সন্তান উৎপাদনে সক্ষম হয়।” ইঁদুরসমাজে জন্ম নিয়ন্ত্রণের কোনও ব্যবস্থাও নেই!
একাধিক প্রাণী বিশেষজ্ঞ জানান, বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে চল্লিশের দশক পর্যন্ত এই শহরে ধেড়ে ইঁদুরের রমরমা ছিল। এরা আকারে খুব বড় ছিল। এদের থাকার জায়গা ছিল হাইড্র্যান্টের মধ্যে। কিন্তু ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর থেকে অজ্ঞাত কারণে কমতে থাকে ধেড়েদেরও বাড়বাড়ন্ত। মহানগরে ভিড় জমতে শুরু করে মেঠো ইঁদুরদের। মেঠো ইঁদুর মূলত ধানখেতে থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু এরা যে কোনও পরিবেশেই দিব্যি মানিয়ে নিতে পারে। ১৯৬০ সালে কলকাতায় এবং হাওড়ার গুদাম নিয়ে সমীক্ষা করতে গিয়ে এক ইংরেজ সাহেবও এদের বাড়বাড়ন্ত টের পেয়েছিলেন।
নেচার এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফ সোসাইটির সম্পাদক বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী বলেন, “আশির দশক থেকেই কার্জন পার্ক থেকে মেঠো ইঁদুর শহরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। মাটির নীচে সুড়ঙ্গ কেটে এরা সহজেই অনেক দূর চলে যেতে পারে। যাওয়ার পথ সহজ ছিল বলেই এরা দক্ষিণের বিভিন্ন এলাকায় দ্রুত সাম্রাজ্য বিস্তার করে। তবে শহরের উত্তরেও এদের দাপট কম নয়।”
প্রাণী বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, পুরসভা অবিলম্বে এদের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না করলে ভবিষ্যতে শহরে এরা বড় বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে। এদের নিয়ন্ত্রণের অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু লাভ হয়নি। কারণ দ্রুত বংশবিস্তারের ক্ষমতার জন্যই এদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন কাজ।
নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রায় একই সময়ে শহরে রয়েছে চলচ্চিত্র উৎসব, ইডেনে টেস্ট ম্যাচ, ছটপুজো। এর মধ্যে রাস্তায় তলায় ইঁদুরবাহিনীর এই গর্ত বিপাকে ফেলেছে পূর্ত দফতরের কর্তাদের। দেরি না করে রবিবার রাত থেকেই শহরের রাস্তাগুলো সারাইয়ের কাজ শুরু করা হয়েছে বলে পূর্ত দফতরের কর্তারা দাবি করেন। সংশ্লিষ্ট দফতরের এক কর্তা বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে দিন তিনেকের মধ্যে এই ফাটলগুলো ঠিক করে ফেলা। চলচ্চিত্র উৎসব, ইডেনে টেস্ট, ছটপুজোর সময়ে যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, সে দিকে নজর রাখা। কিন্তু মাটির তলায় ইঁদুর কী ঘটাবে, তা সিদ্ধিদাতাই জানেন!”
এ বার কি কলকাতারও দরকার পড়বে বাঁশিওয়ালাকে? |