বর্ষার মতিগতি তো বদলাচ্ছেই। পাশাপাশি ভারতের জলবায়ুতে লাগা পরিবর্তনের ঢেউ শীতের কাঁপুনিতেও টান ধরাতে পারে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক পরিবেশবিদদের একটি মহল। আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংগঠন ‘ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ বা আইপিসিসি-র পঞ্চম তথা সাম্প্রতিকতম রিপোর্টে এমনটাই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। ওই রিপোর্টের দাবি: পরিবেশ দূষণের জেরে জলবায়ুর চরিত্র পাল্টাচ্ছে। এবং তার পরিণামে আগামী দিনে তামাম উত্তর ভারত জুড়ে শীতকালে রাতের গড় তাপমাত্রা বাড়ার সমূহ সম্ভাবনা।
ঘটনাচক্রে গত ক’বছর ইস্তক ভারতে বর্ষার চরিত্র বদল নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন পরিবেশবিদ ও আবহবিজ্ঞানীদের একাংশ। তাঁদের মতে, বর্ষার ভাবগতিক দিন দিন পাল্টাচ্ছে, আগমন-বিদায়ের ক্ষেত্রে কোনও নির্ঘণ্ট বা নিয়ম-নীতির ধার সে ধারছে না। এমনকী, ক্যালেন্ডারে বর্ষাকাল পেরিয়ে গেলেও একের পর এক নিম্নচাপের ধাক্কায় বানভাসি পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। শুক্রবার রাত থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত হয়ে যাওয়া ভারী বৃষ্টিতে হাতে-নাতে যার প্রমাণ পেয়েছে কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গ। আর হেমন্তের দিনে এ হেন ঢালাও বর্ষণ শীতের পথে কাঁটা বসারই ইঙ্গিত বলে আবহ-বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদদের একাংশের দাবি। |
আশঙ্কার চার অধ্যায়
|
• ফসলের ক্ষতি • ভূগর্ভস্থ জলে টান
•
পতঙ্গবাহিত রোগের প্রকোপ • বন্যার বাড়াবাড়ি |
|
তা হলে কি এ বার থেকে শীতকালে লেপ-সোয়েটার তুলে রাখতে হবে?
আবহবিদেরা অবশ্য ততটা আশঙ্কার কথা শোনাচ্ছেন না। ওঁদের বক্তব্য, পরিবর্তন হচ্ছে ঠিকই, তবে তা ধীরে ধীরে। তবে সাধারণ অভিজ্ঞতায় যে শীতের কামড় আলগা হওয়ার একটা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, সেটা মোটামুটি অনেকেই মেনে নিচ্ছেন। যেমন নদী-বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র বলছেন, “ছোটবেলায় চাদর জড়িয়ে মহালয়া শুনেছি। এখন তো দিন দশেকের বেশি কড়া শীতই পড়ে না!” বস্তুত ইদানীং শীতের অধিকাংশ সময়ে তাপমাত্রা আগের তুলনায় চড়ে থাকছে। “আইপিসিসি-র বিজ্ঞানীরা এ কথাটাই বলছেন। পাঁচ দিন রাতে কড়া শীত পড়ল, আর বাকি দিনগুলোয় রাতের তাপমাত্রা বেশি থাকল, তা হলে কিন্তু শীত পড়েছে বলা যাবে না। বরং মরসুমের শেষে হিসেব কষলে দেখা যাবে, গড় তাপমাত্রা বেড়ে গিয়েছে।” মন্তব্য এক আবহ-বিজ্ঞানীর।
শীতকালের বাতাসে দিনের ও রাতের তাপমাত্রায় ফারাক যত বাড়বে, ঠান্ডা মালুম হবে তত বেশি। কিন্তু আবহ-বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, আইপিসিসি-র সাম্প্রতিক রিপোর্টে রাতের গড় তাপমাত্রাবৃদ্ধির কথা বলা হলেও দিনের ক্ষেত্রে তেমন কোনও ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি। ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, তাতে খুব একটা হেরফের হবে না। ফলে ফারাকটা কমবে, অর্থাৎ ঠান্ডা কমবে। আবহবিদদের একাংশের আরও বক্তব্য: বাতাসে জলীয় বাষ্পের উপস্থিতির উপরেও শীতের তাপমাত্রা অনেকটা নির্ভর করে। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে জলীয় বাষ্পের মাত্রা বাড়লে কুয়াশার সৃষ্টি হয়, ঠান্ডা কমে। একই ভাবে বর্ষা বিদায়ের পরেও নাগাড়ে বৃষ্টি হতে থাকলে বাতাসে জলীয় বাষ্প কমবে না। এই কারণেও শীতের প্রকোপ কমতে পারে। তাতে অন্য বিপর্যয়েরও আশঙ্কা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র-বিজ্ঞান (ওশানোগ্রাফি) বিভাগের অধ্যাপক সুগত হাজরার মতে, “শীতকালে রাতের তাপমাত্রা বাড়লে ফসলেরও ক্ষতি হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা।”
একই সঙ্গে বর্ষার পরিবর্তন নিয়েও রিপোর্ট দিয়েছে আইপিসিসি। যার বক্তব্য: ইদানীং ভারতীয় মূল ভূখণ্ডে বর্ষা ঢুকছে দেরিতে। তাই খাতায়-কলমে যখন ‘ভরা বর্ষা,’ তখন মধ্য ভারত-সহ নানা জায়গায় বৃষ্টি হচ্ছে না। আবার শেষ দিকে অতিরিক্ত বৃষ্টি হচ্ছে। বর্ষা বিদায়ের সময়টাও পিছিয়ে গিয়েছে। “বর্ষা যে পিছিয়ে যাচ্ছে, চলতি বছরেই তার প্রমাণ মিলেছে। বর্ষাকাল
পেরিয়ে গেলেও পরের পর নিম্নচাপ তৈরি হচ্ছে। সঙ্গে জোরালো বৃষ্টি।” বলেন সুগতবাবু।
১৯০১ থেকে ২০০২ পর্যন্ত দেশের বর্ষণ-তথ্য নিয়ে গবেষণা করেছেন কল্যাণবাবু। তাঁর দাবি, “এই একশো বছরে দেখা যাচ্ছে, জুনের বৃষ্টি ৪৮% মার খেয়েছে। অথচ বর্ষার শেষ লগ্নে, অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে বৃষ্টি বেড়েছে ৩৩%।” প্রবীণ এই নদী-বিশেষজ্ঞ জানাচ্ছেন, জুন মাসের বৃষ্টির পরিমাণের উপরে ধানের বীজতলা তৈরি ও ভূগর্ভস্থ জলস্তরের ঘাটতি পূরণ নির্ভর করে। ওই দফায় বৃষ্টি কমলে তা ভবিষ্যতে ফসল ও জলের সঙ্কট তৈরি করতে পারে, বাড়তে পারে বন্যার প্রকোপও। প্রসঙ্গত, মৌসম ভবনের পরিসংখ্যানও বলছে, চলতি অক্টোবরে (আবহাওয়া-ক্যালেন্ডার অনুযায়ী যা কি না বর্ষা-পরবর্তী কাল) দেশের বেশির ভাগ রাজ্যে অতিবৃষ্টি হয়েছে। যার দরুণ এক দিকে যেমন চাষের ক্ষতি হচ্ছে, তেমন পতঙ্গবাহিত রোগের প্রকোপও বাড়ছে বলে দাবি করছেন পরিবেশবিদদের একাংশ।
কিন্তু জলবায়ু এ ভাবে বদলাচ্ছে কেন?
আইপিসিসি-র বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা, পরিবেশ দূষণের দরুণ বাতাসে কার্বন ও সালফারযুক্ত এরোসল (বাতাসে ভাসমান কণা) বাড়ছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ। এক আবহ-বিজ্ঞানীর কথায়, “এই সব দূষণ যে আমাদের দেশেই হয়, এমনটা নয়। বায়ু্প্রবাহ ও ভৌগোলিক অবস্থানের সুবাদে উন্নত দুনিয়ার দূষণও এখানে প্রভাব ফেলছে।”
কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের বিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশ অবশ্য বর্ষা বা সামগ্রিক জলবায়ুতে ‘পরিবর্তনের’ তত্ত্ব এখনই মেনে নিতে চাইছেন না। তাঁদের বক্তব্য, ফি বছরই বর্ষার চরিত্র আগের বছরের চেয়ে কিছুটা অন্য রকম হয়। তাই সামগ্রিক ভাবে একে নির্দিষ্ট পরিবর্তন হিসেবে গণ্য করা যায় না। “গত চার বছরে দেশে কিন্তু অক্টোবরে স্বাভাবিকের তুলনায় কম বৃষ্টি হয়েছিল। এ বার অতিবৃষ্টি। ফলে বর্ষার চরিত্র বদলাচ্ছে বা পিছিয়ে যাচ্ছে এমনটা নির্দ্বিধায় বলা কঠিন।” মন্তব্য করেছেন মৌসম ভবনের এক প্রবীণ বিজ্ঞানী। |