নারীর পোশাক কী হইবে, তাহা কে নির্ধারণ করিবে? উদার গণতন্ত্র বলিবে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের এক্তিয়ার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি-নারীর। দুর্ভাগ্যবশত, বিশ্বের বহু সমাজে ও শাসনপ্রণালীতে পুরুষতন্ত্রের প্রাধান্য এতই প্রবল যে, নারীরা নয়, তাঁহাদের পরিবার বা সমাজ, প্রায়শ রাষ্ট্রও তাঁহাদের হইয়া এই সিদ্ধান্তটি লইয়া থাকে। হরিয়ানার খাপ-পঞ্চায়েত বা পশ্চিমবঙ্গের মহিলা কলেজের অধ্যক্ষা, সকলেই মহিলাদের পোশাক-আশাক, আচার-আচরণ স্থির করিতে ব্যস্ত। সেই উদ্যোগ সচরাচর নারীর শরীরকে আবৃত রাখিবার উদ্যোগ। কিন্তু নারীশরীর আবৃত রাখা চলিবে না এমন বিধানও কি প্রকারান্তরে তাহার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নহে? এই প্রশ্নের উপলক্ষ তুরস্ক সরকারের একটি সিদ্ধান্ত। পশ্চিমী আদর্শে গড়িয়া তোলা আধুনিক তুরস্কের রূপকার মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক হিজাবকে, সংগত ভাবেই, ইসলামি পোশাক গণ্য করিতেন। তাই তাঁহার ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কে এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ হয়। নব্বই বছর ধরিয়া তাহা বলবৎ ছিল।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠিয়াছিল, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ কি এ ক্ষেত্রে তুর্কি নারীর পোশাকের স্বাধীনতাকে, সুতরাং তাঁহার মানবাধিকারকেও লঙ্ঘন করে নাই? মৌলবাদের মতো ধর্মনিরপেক্ষতাও কি এ ক্ষেত্রে এক ধরনের গোঁড়ামি হইয়া ওঠে না? এই বিষয়ে তর্ক ও বিবাদ চলিতেছিল। আন্দোলনও। এই পরিপ্রেক্ষিতেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে উপর্যুপরি নির্বাচিত তুরস্কের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তায়ইপ এর্দোগান ২০০২ সালেই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন হিজাব সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের। তিনি কথা রাখিয়াছেন। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হইয়াছে। তুরস্কের যে নারীরা বহু কাল ধরিয়া হিজাব পরার অধিকারের দাবিতে আন্দোলন করিতেছিলেন, তাঁহারা স্বভাবতই এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাইয়াছেন। আবার, প্রত্যাশিত ভাবেই, এই সিদ্ধান্ত লইয়া প্রতিপ্রশ্নও উঠিয়াছে। তুরস্কের বিরোধী রাজনীতিকরা এই সিদ্ধান্তের মধ্যে অটোমান খলিফাদের যুগের ইসলামি মৌলবাদ ফিরাইয়া আনার সংকেত পাইতেছেন। ইসলামি মৌলবাদের বর্তমান আন্তর্জাতিক প্রসারের প্রেক্ষিতে প্রশ্নটি গুরুতর।
এই তর্ক প্রাসঙ্গিক। হিজাব বা অনুরূপ পোশাক যে ভাবে প্রচলিত হইয়াছে, তাহার পিছনে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতার প্রভাব অবশ্যই প্রবল। পুরুষশাসনের একটি অস্ত্র হিসাবেই ইহাকে কাজে লাগানো হইয়াছে। যে নারী ‘স্বেচ্ছা’য় হিজাব পরিতে চাহিতেছেন, তাঁহার ইচ্ছা কতখানি যথার্থ স্ব-ইচ্ছা এবং কতখানি সামাজিক অনুশাসনকে আত্মস্থ করিবার ফল, তাহাও অবশ্যই বড় প্রশ্ন। কিন্তু সেই বিতর্কের মোকাবিলা সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিসরেই করা দরকার, নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়া নহে। অবশ্যই পোশাকের যৌক্তিকতা বা ব্যবহারিকতার প্রশ্নটি বিচার্য। লক্ষণীয়, প্রধানমন্ত্রী এর্দোগান পুলিশ, সামরিক বাহিনী ও বিচারবিভাগে নিযুক্ত মহিলাদের ক্ষেত্রে হিজাবের উপর আগের নিষেধাজ্ঞাই অটুট রাখিয়াছেন, যেহেতু ওই সকল পেশায় হিজাব অসুবিধা সৃষ্টি করে। কিন্তু তাহাতে সামগ্রিক নিষেধাজ্ঞার যুক্তি প্রতিষ্ঠিত হয় না। বরং গণতন্ত্রে যে বহুত্ববাদ ব্যক্তির পছন্দের স্বাধীনতাকে শিরোধার্য করে, এ ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের মাধ্যমে তাহাকেই সম্মান জানানো হইয়াছে। ইহার পরেও হিজাবের সমালোচনা চলিতে পারে, চলা দরকার। কিন্তু তাহা গণতান্ত্রিক পরিসরেই কাম্য, রাষ্ট্রীয় নির্দেশিকার বৃত্তে নহে। |