অমল ধবল শরতের সঙ্গে মিশে আছেন দুই কন্যা। তাঁদের আগমন এবং বিদায় এই ঋতুতেই। এক জন হিমালয়দুহিতা পার্বতী, অন্য জন স্বামী বিবেকানন্দের মানসকন্যা নিবেদিতা। দু’জনেই এক দিকে একান্ত কোমলপ্রাণ, পরম মমতাময়। আবার অন্য দিকে রুদ্রতেজের মূর্ত প্রতীক।
পার্বতী-উমা-সতীকে আমরা যেমন কন্যা রূপে দেখি তেমনই দুর্গাকে দেখি মহাতেজা অসুরদলনীরূপে। তিনি অশুভ শক্তি বিনাশ করেন। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বলা আছে ‘চিত্তে করুণা সমরে চ নিষ্ঠুরতা’। দুষ্টের দলনের সঙ্গে দেবী শরণাগত আর্তকেও রক্ষা করেন। সাগরপারের দেশ থেকে আসা যে মেয়ে এ দেশকেই তাঁর আত্মভূমি করে নিয়েছিলেন, সেই নিবেদিতার মধ্যেও আমরা খুঁজে পাই এই দুই রূপ। শরতের আকাশে-বাতাসে তাই কোথায় যেন মিলেমিশে যায় দুই কন্যা তথা মাতার সৌরভ। তাঁরা মুছিয়ে দেন সব কালিমা, সব মালিন্য।
বিবেকানন্দের মানসকন্যা নিবেদিতাকে অখণ্ডের ঘরে ঋষি বিবেকানন্দের তেজসম্ভূতা সঙ্গত ভাবেই কল্পনা করা যায়। হৈমবতী উমার মতোই তিনি একাধারে ছিলেন ভারত-মানসকন্যা আবার রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে ‘লোকমাতা’। তাঁর অন্তর কৈলাসের শিবকে আরাধ্য গুরু রূপে বরণ করে তিনি ভারতের অগণিত পরাধীন সন্তান-সন্ততির জননীরূপে মূর্তিমতী ‘লোকমাতা’। আবার রবীন্দ্রনাথ নিবেদিতার ত্যাগ-বৈরাগ্যের জন্য তাঁকে ‘সতী’ আখ্যাও দিয়েছেন। |
আজ নিবেদিতার ১৪৭তম জন্মদিবস |
|
রবীন্দ্রনাথ ভারত তথা ভারতের মানুষের জন্য এই সতী নিবেদিতার তিল-তিল করে আত্মত্যাগের কাহিনিটি এই ভাবে বিশ্লেষণ করেন ‘ভগিনী নিবেদিতা দেশের (ভারতের) মানুষকে যেমন সত্য করিয়া ভালবাসিতেন, তাহা যে দেখিয়াছে সে নিশ্চয়ই ইহা বুঝিয়াছে যে, দেশের লোককে হয়তো আমরা সময় দিই, অর্থ দিই, এমনকী জীবনও দিই কিন্তু তাহাকে হৃদয় দিতে পারি নাই তাহাকে তেমন সত্য, অত্যন্ত সত্য করিয়া, নিকট করিয়া জানিবার শক্তিলাভ করি নাই।’... ‘শিবের প্রতি সতীর সত্যকার প্রেম ছিল বলিয়াই তিনি অর্ধাসনে, অনশনে অগ্নিতাপ সহ্য করিয়া আপনার অত্যন্ত সুকুমার দেহ ও চিত্তকে কঠিন তপস্যায় সমর্পণ করিয়াছিলেন। এই সতী নিবেদিতাও দিনের পর দিন যে তপস্যা করিয়াছিলেন, তাহার কঠোরতা অসহ্য ছিল তিনি অনেক দিন অর্ধাশন, অনশন করিয়াছেন। তিনি (কলকাতার বাগবাজারে) গলির মধ্যে যে বাড়িতে বাস করিতেন সেখানে বাতাসের অভাবে গ্রীষ্মের তাপে বীতনিদ্র হইয়া রাত কাটাইয়াছেন, তবু ডাক্তার বা বন্ধুবান্ধবদের সনির্বন্ধ অনুরোধেও সে বাড়ি পরিত্যাগ করেন নাই।...
‘ইহা যে সম্ভব হইয়াছে এবং এই সমস্ত স্বীকার করিয়াও শেষ পর্যন্ত তাঁহার তপস্যা যে ভঙ্গ হয় নাই, তাহার একমাত্র কারণ, ভারতের মানুষের প্রতি তাঁহার প্রীতি একান্ত সত্য ছিল, তাহার মোহ ছিল না। মানুষের মধ্যে যে শিব আছেন, সেই শিবকেই এই সতী সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করিয়াছিলেন। এই মানুষের অন্তর কৈলাসের শিবকেই যিনি আপন স্বামীরূপে লাভ করিতে চান, তাঁহার সাধনার মতো কঠিন সাধনা আর কার আছে?”
বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু ও তাঁর পত্নী লেডি অবলা বসু নিবেদিতাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা-ভক্তি করতেন। তাঁরা নিবেদিতার সঙ্গে হিমালয়ে কয়েক বারই এসেছেন। দেখেছেন হিমালয়ের প্রতি নিবেদিতার শ্রদ্ধা-ভক্তি, প্রেম-প্রীতি। নিবেদিতা হিমালয়কে ভালবেসে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। কারণ তিনি জানতেন, বিশ্বাস করতেন, হিমালয় তাঁর আরাধ্য দেবতা শিবের আবাসভূমি। এই বিশ্বাস বা দৃঢ়প্রত্যয় স্বামী বিবেকানন্দই তাঁর মানসকন্যার মধ্যে সঞ্চার করেছিলেন। স্বামীজি স্বয়ং নিবেদিতাকে নিয়ে হিমালয় পরিভ্রমণ করেছিলেন এবং সবশেষে তুষারলিঙ্গ অমরনাথ দর্শনে যান যেখানে তিনি স্বয়ং দেবাদিদেবের কাছে ইচ্ছামৃত্যুর বরলাভ করেন। নিবেদিতাকেও উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর আরাধ্য দেবতা শিবেরই চরণে। এ সবই ছিল নিবেদিতার কাছে পরম সত্য এবং অনুভূতিসাপেক্ষ।
দেবতাদের তেজঃসম্ভূতা হিমালয়কন্যা উমা ও বিবেকানন্দ-তেজঃসম্ভূতা মানসকন্যা নিবেদিতার বড় সাদৃশ্য তাঁদের কন্যাত্ব ও জননীত্ব মহিমাতেই। এবং উভয়েই মর্ত্যলোকে বরণীয়া ও আদরণীয়া হয়েছেন এই দ্বৈতসত্তার জন্য। কন্যা উমা যেমন স্বর্গে অসুর নিধন করে ‘দুর্গা’ হয়েছেন এবং মর্ত্যবাসী তাঁকে ঘরের মেয়ে রূপে বছরে একবার আহ্বান করেন শরৎকালে একাধারে কন্যা ও শক্তিময়ী জননীরূপে, নিবেদিতারও সেই রূপটি ফুটে উঠেছে তাঁর ভারতপ্রীতি তথা ভারতের অগণিত সন্তানসন্ততির প্রতি মমত্বে ও সমবেদনায় এবং সেই জন্যই বিদেশি শক্তি তথা দস্যু (নিবেদিতার ভাষায়) কবলিত ভারতমাতার শৃঙ্খলমোচনে তিনি ‘রণরঙ্গিণী’ হয়ে উঠেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে। বিপ্লবীদের কাছে তিনি মমত্ব ও বাৎসল্যে ভরা কন্যা ও জননীরূপেই, আবার সময়বিশেষে ‘দস্যু’ দমনে তিনি বুদ্ধি-শক্তি-সাহস জুগিয়ে রণরঙ্গিণী। শাসক ইংরেজ তাঁকে বহু বার কারারুদ্ধ করার চেষ্টা করেও সফল হয়নি। স্বয়ং মূর্তিমতী দুর্গার মতোই যখন তিনি অসুরদলনী জননী, তখন তাঁকে ধরার সাধ্য কোন অসুর শক্তির? তাঁর এই শক্তিরূপিণী ভাবটি তাঁর ফরাসি জীবনীকার লিজেল রেঁম-র লেখনিতে চমৎকার ফুটে উঠেছে। রেঁম লিখেছেন, ‘শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরী নারায়ণী নমোহস্তু’তে অহরহ নিবেদিতার এই প্রার্থনা। কোনও কিছুর দিকে দৃকপাত নাই। জানতেন, সরকার তাঁকে দ্বীপান্তরে পাঠাতে পারে, কিন্তু তিনি ভ্রূক্ষেপও করতেন না।
হিমালয়-কন্যা উমা বা পার্বতীর আরাধ্য শিব, স্বর্গলোকে অসুরদের তাড়িয়ে তিনি দুর্গতিনাশিনী দুর্গা হয়েছেন, স্বামীজির মানসকন্যা নিবেদিতার আরাধ্য শিব, পুণ্যভূমি ভারত থেকে পরদেশি শাসককে তিনি তাড়াতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তা সম্পূর্ণ করতে পারেননি। তবে ভারতবাসীর হৃদয়ে তিনি স্বাধীনতার আগুন জ্বেলে দিয়েছিলেন। তা আজও স্বাধীন ভারত ২৮ অক্টোবর তাঁর জন্মদিনে স্মরণে-মননে-গবেষণায় অম্লান রেখেছে। দুর্গা বা নিবেদিতা উভয়েই শক্তিময়ী, একজন দেবতেজে, আর এক অখণ্ডের ঘরের ঋষি বিবেকানন্দ-তেজে।
বিবেকানন্দের মানসকন্যাকে এক আদর্শ ভারতকন্যারূপেই তো দেখতে পাই, যার তুলনা আমরা সার্থক ভাবে দেখতে পাই হিমালয়ে উদ্ভাসিত ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণ’-এর ঋষির ধ্যানের মতো। ভাবরূপাত্মক বিশ্বসৃষ্টির অন্তরালে কোন শক্তিময়ী ব্রহ্মমায়ার লীলাখেলা চলছে মনুষ্যবুদ্ধিতে তা বুঝি কেমনে? তাই স্বামীজির মানসকন্যা বিচিত্র ভাবরূপে ধরা দিয়েছেন বিভিন্ন জনের কাছে, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র যেমন তাঁকে দেখতেন হৈমবতী উমারূপে, আর একদা বিপ্লবী ঋষি শ্রীঅরবিন্দের কাছে তিনি শক্তিময়ী শিখাময়ী আর রবীন্দ্রনাথের কাছে তিনি ছিলেন ভারতবাসীর একান্ত আপনজন, লোককল্যাণে নিরতা ‘লোকমাতা’।
অবশেষে একদিন স্বামীজির মানসকন্যা নিবেদিতা ধ্যানমগ্ন হয়েই হিমালয়-ক্রোড়ে দার্জিলিং-এ তাঁর আরাধ্য দেবতা মহাদেবের চরণে মিলিত হন প্রাণের অন্তিম আকুতিটুকু জানিয়ে ‘The boat is sinking but I shall see the sun.’
সে দিনটা ছিল ১৩ অক্টোবর ১৯১১। |