রাজনীতি সম্ভবের শিল্প’ কথাটি বহু-আলোচিত। বস্তুত, অতি-আলোচিত। ইহার এমন যথেচ্ছ প্রয়োগ দেখিলে অটো ফন বিসমার্ক সম্ভবত বিরক্তই হইতেন। কিন্তু সেই আলোচনায় প্রায় সর্বদাই ‘সম্ভব’ শব্দটি লইয়া বিচার চলিতে থাকে। ‘শিল্প’ তুলনায় কম গুরুত্ব পায়। লক্ষণীয়, রাজনীতিকে সম্ভব বা সম্ভাব্যতার বিজ্ঞান (সায়েন্স) বলা হয় নাই, বলা হইয়াছে শিল্প (আর্ট)। বিজ্ঞান যে পথে চলে, তাহা নিশ্চিতির পথ, তথ্য ও যুক্তির ভিত্তিতে নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছাইবার পথ। নূতন সিদ্ধান্ত আসিয়া পুরানো সিদ্ধান্তকে অপ্রমাণ করিতে পারে, কিন্তু তাহাতে বিজ্ঞানের মূল ধর্ম পালটায় না। এমনকী, বিজ্ঞান যখন ‘অনিশ্চয়তার সূত্র’ প্রতিষ্ঠা করে, তখনও তাহার সূত্রবদ্ধ রূপটি অক্ষুণ্ণ থাকে, অনিশ্চয়তা সেই সূত্রের দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হয়। শিল্প তাহার মৌলিক চরিত্রে অ-নিশ্চিত। চিত্রকলায় রং, তুলি আবশ্যক, সাহিত্য সৃষ্টির জন্য শব্দ। কিন্তু রং, তুলি নির্দিষ্ট করিয়া দিলেই শিল্পী কী সৃষ্টি করিবেন তাহা নিশ্চিত হয় না। শব্দের তালিকা সরবরাহ করিলেই সূত্রবদ্ধ কবিতা উৎপন্ন হয় না। রাজনীতি কোন পথে চলিবে, কোথায় পৌঁছাইবে, তাহার পিছনে বাস্তব পরিস্থিতির ভূমিকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি জানা থাকিলেই নিশ্চিত রাজনৈতিক পরিণাম নির্ণয় করা যাইবে, এমন ‘বৈজ্ঞানিক’ সূত্র হয় না, হইতে পারে না। কী সম্ভব, কী সম্ভব নয়, তাহার সৃষ্টিশীল নির্মাণই যথার্থ রাজনীতির কাজ। শিল্পকর্ম। কয়েক সপ্তাহ আগেও দার্জিলিঙের রাজনীতিতে রাজ্য বনাম গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার ক্রমবর্ধমান সংঘাতই একমাত্র পরিণতি বলিয়া গণ্য হইতেছিল। শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রীর পাহাড় সফরের শেষে যে দৃশ্য দেখা গেল, তাহা এই সে দিনও ‘অসম্ভব’ ছিল। ইহা যে সম্ভব হইয়াছে, তাহা রাজনীতির শিল্প-ধর্মেরই পরিচায়ক। এই সফল শিল্পকৃতির জন্য বিসমার্ক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অভিনন্দন জানাইতেন।
সংঘাতের বাস্তবকে, অন্তত আপাতত, সমন্বয়ের বাস্তবে রূপান্তরিত করিবার এই আপাত-অসম্ভব কাজটি কী ভাবে সম্পন্ন হইল? সরলমতি দর্শক বলিবেন: মিলনের মন্ত্রে। পাহাড় সফরে মুখ্যমন্ত্রী বিবাদ ভুলিয়া, কিংবা ‘ঝগড়া করিতে করিতেই’, উন্নয়নে ব্রতী হইবার ডাক দিয়াছেন, মোর্চা নেতারাও তাহাতে সাড়া দিবার অঙ্গীকার করিয়াছেন। জি টি এ’র বন্ধ চাকা ঘুরাইবার প্রস্তুতি চলিতেছে। পাহাড়ে পর্যটকের ভিড় এবং উন্নয়নের গতি, দুইই বাড়িবার সম্ভাবনা দেখা দিয়াছে। মিলনের মন্ত্র উচ্চারণেই ইহা সম্ভব হইল? সত্যই? মুখ্যমন্ত্রীও জানেন, বিমল গুরুঙ্গ এবং তাঁহার সহযোগীরাও জানেন, যে মন্ত্রে এই পরিবর্তন সাধিত হইল, তাহার নাম কঠোরতা। প্রশাসনিক কঠোরতা। রাজনৈতিক কঠোরতা। জ্যোতি বসু হইতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বামফ্রন্টের প্রশাসকরা দার্জিলিঙে আন্দোলনকারীদের মোকাবিলায় কোনও দিনই যথার্থ কঠোরতা দেখাইতে পারেন নাই, মাঝে মাঝে ‘রক্ত দিব তবু কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়িব না’ বলিয়া কাডারকণ্ঠে ফাঁকা আওয়াজ তুলিয়া আপন দুর্বলতাকেই হাস্যকর ভাবে বিজ্ঞাপিত করিয়াছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক দিকে প্রথম লগ্নেই কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপে মোর্চাকে দুর্বল ও সন্ত্রস্ত করিয়া ফেলিয়াছেন, অন্য দিকে পাহাড়ে দলীয় প্রভাব বিস্তারের কৌশল লইয়াছেন। কঠোরতার সহিত রাজনৈতিক কৌশলের কোনও বিরোধ নাই। সেই কারণেই, মোর্চা বেগতিক দেখিয়া সাদা পায়রা উড়াইবার সঙ্গে সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী প্রসন্ন মূর্তি ধারণে বিলম্ব করেন নাই। সমগ্র পর্বটিতে কুশলী রাজনীতির যে পরিচয় রহিয়াছে, বিমান বসুরাও তাহাকে প্রায় প্রকাশ্যে কুর্নিশ না করিয়া পারেন নাই। অতঃপর? মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই জানেন, সব সমস্যার সমাধান হইয়া যায় নাই। পাহাড়ের সমস্যার যথার্থ সমাধানের পথে অগ্রসর হইতে চাহিলে তাঁহাকে ভবিষ্যতেও প্রয়োজনে কঠোর হইতে হইবে। হয়তো আরও বেশি কঠোর। কিছুটা নির্মমও। বিসমার্কও তাঁহাকে সেই উপদেশই দিবেন। |