|
|
|
|
|
আব্বা আর আঙ্কল স্বর্গে এখন মাঞ্জা দিচ্ছেন
কিংবদন্তি শিল্পীর বিদায়ের পর মহম্মদ রফিপুত্র শাহিদ খুললেন
তাঁর স্মৃতির ঝাঁপি। শুনলেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত |
|
মহম্মদ রফি যখন মারা যান, তখন তাঁর বয়স মাত্র উনিশ।
আর তাঁর বাবা মহম্মদ রফির বয়স পঞ্চান্ন। হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলে যান রফিসাব।
ওই অল্প বয়সে শাহিদ ঠিক সে ভাবে বুঝতেও পারেননি যে মহম্মদ রফির ছেলে হওয়ার অর্থটা আসলে কতটা গভীর।
চুরানব্বই বছর বয়সে মান্না দে চলে গেলেন। এই বিদায়ে শাহিদের মনের ঈশান কোণে মেঘ জমে আছে তো বটেই। “আব্বাকে অসম্ভব ভালবাসতেন মান্না আঙ্কল। সে কথা বারবার শুনেছি। তবে কী জানেন? ছোটবেলা থেকেই ইন্ডাস্ট্রির কারও সঙ্গে আব্বা আমাদের সে ভাবে যোগাযোগ রাখতে দেননি। যদি গায়ক হওয়ার ইচ্ছে একটুও প্রকাশ করতাম, আব্বা তৎক্ষণাৎ বলতেন, ‘পড়তে বোসো’,” বলছেন শাহিদ।
ছোটবেলা থেকেই শাহিদকে লন্ডনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন রফিসাব। ওখানেই মানুষ হয়েছেন, পড়াশোনা করেছেন। “গোটা জীবনে আমি হয়তো সর্বসাকুল্যে দু’তিন বার রেকর্ডিং স্টুডিয়োতে গিয়েছি। ইন্ডাস্ট্রিতে কি হচ্ছে না হচ্ছে তার খবর আমরা একদমই রাখতাম না। ড্যাডও সেটা চাইতেন না,” বলছেন রফিপুত্র।
কেন অত গুণীশিল্পী হয়েও চাননি ছেলে হারমোনিয়াম নিয়ে বসুক? “সে যুগে আমাদের সেই সাহস ছিল নাকি যে, বাবার মুখে মুখে প্রশ্ন করব? তখন একটাই ধারণা ছিল বাবা যখন বলছেন তার মানে ঠিকই বলছেন। আব্বা একটা কথা বারবার বলতেন: ‘বরাবর হো ইয়া বেহতর হো!’ মানে যদি ওই লাইনেই যেতে হয় তা হলে হয় ওঁর মতো ভাল গাইতে হবে, নয়তো বা ওঁর থেকেও ভাল হতে হবে। হয়তো বা আব্বা বুঝেছিলেন যে, এই দুটোর কোনওটাই হবে না। তাই কোনও দিন আমাদের গান গাওয়ার জন্য উৎসাহ দেননি। সব সময় বলতেন পড়াশোনা করতে,” বললেন শাহিদ।
এখানেও কি মান্না দে-র সঙ্গে মহম্মদ রফির মিল? মান্না দে-ও তো কোনও দিন ওঁর কন্যাদের জোর করেননি সঙ্গীতকে কেরিয়ার হিসেবে বেছে নেওয়ার জন্য। “আসলে ব্যাপারটা হল জোর করে কোনও দিন শিল্পী হওয়া যায় না। বিখ্যাত বাবার সন্তান হলেও সেটা করা উচিত নয়। লোকে সর্বক্ষণ বলতে থাকবে ওই মাপের এক শিল্পীর সন্তান কিন্তু এই রকম গাইছে! যদি সত্যিকারের প্রতিভা না থাকে তা হলে ওই পরিস্থিতিতে যাওয়া কেন?” পাল্টা প্রশ্ন করেন শাহিদ।
সঙ্গীতকে কেরিয়ার না করলেও মান্না-রফির বন্ধুত্বের গল্প শাহিদ শুনেছেন। কথা বলতে বলতে তাঁর মনে পড়ে যায় রফি সাব-এর সেই উক্তি: “দ্য ওয়ার্ল্ড লিসনস টু মাই সঙস। অ্যান্ড আই লিসন টু মান্না দে।’ “ড্যাডকে নিয়ে একটা বই লেখা হচ্ছিল। যিনি লিখছিলেন তিনি মান্না আঙ্কলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন। এমন ভাবে ড্যাডের সম্পর্কে বলছিলেন যেন ড্যাড আশেপাশেই কোথাও আছেন। মান্না আঙ্কলের সঙ্গে রেকর্ড করলে ড্যাডের দারুণ ভাল লাগত। ‘বড়া মজা আয়া’এটা আব্বাকে অনেক বার বলতে শুনেছি। |
|
আজ যখন মান্না দে-র শেষ কাজ সম্পন্ন হয়েছে তখন মনে করার চেষ্টা করছি কোনও দিন আম্মি কি গল্প করেছেন মান্না আঙ্কলের সঙ্গে ড্যাডের প্রতিযোগিতা নিয়ে? না, একটা দৃষ্টান্তও সেই রকম নেই। অসংখ্য ডুয়েট। আর সবকটাতে দু’জনে দু’জনের পরিপূরক হয়ে উঠেছেন,” বলছেন শাহিদ।
আজও বান্দ্রার বাড়িতে তাঁর বাবার মিউজিক রুমে গেলে শাহিদের মনে পড়ে, ওঁদের দু’জনের কত অসাধারণ সব ডুয়েটের কথা। স্মৃতির গহনে ডুব দেন শাহিদ। “ওই যে ১৯৬৭-র সেই ‘অ্যায়সে ম্যায় তুঝকো ঢুন্ডকে লাউ কহাঁ সে ম্যায়,’ গানটা। ছবির নাম ‘বহু বেগম।’ রোশন সাব-এর কাওয়ালি। ড্যাডি আর মান্না আঙ্কলের গলায় গানটা শুনে আজও মনে হয় যেন একটা দরগাতে বসে গাইছেন দু’জনে। সেই একই ছবির আরও একটা গান। প্রদীপকুমার আর মীনাকুমারীকে নিয়ে পিকচারাইজ করা ডুয়েট ‘ওয়াকিফ হুঁ খুব ইশক্ সে।’ এ তো গেল কাওয়ালি। ভাবুন তো ‘পরভরিশ’য়ের সেই ‘মামা ও মামা’ গানটা! রাজ কপূর আর মেহবুব। কী কমিক টাইমিং! আরও মনে পড়ে ‘ও বাবু তেল মালিশ করালো বুট পলিশ’ কি স্পিরিট গানগুলোর।”
তবে শুধুমাত্র যে সঙ্গীতকে ঘিরেই স্মৃতি রয়েছে তা কিন্তু নয়। “গান ছাড়া ড্যাডের আরও তিনটে শখ ছিল। ঘুড়ি ওড়ানো, ক্যারম খেলা আর ব্যাডমিন্টন। মান্না আঙ্কল আর ড্যাড মিলে ঘুড়ি ওড়াতেন। ছোটবেলা থেকেই ড্যাডের ঘুড়ি ওড়ানোর শখ। যখনই রেকর্ডিং থাকত না তখনই ওঁরা ঘুড়ি নিয়ে ছাদে। কে কার ঘুড়ি কাটবেন এই নিয়েই চলত মজা,” বলে চলেন শাহিদ।
আজ তাঁর সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে কী উদার ভাবে মান্না দে তাঁর বাবার প্রশংসা করতেন। দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার পাওয়ার পর কেমন লাগছে জিজ্ঞেস করায় মান্না দে বলেছিলেন, মহম্মদ রফি, মুকেশ বা কিশোরকুমার কেউই তো এই পুরস্কার পাননি। তাই তিনি এই স্বীকৃতিতে দারুণ উৎফুল্ল হবেন না। এমনটাও মান্নাবাবু বহু বার বলতেন, “মহম্মদ রফি ওয়াজ এ বেটার সিঙ্গার দ্যান মি।” এ কথা শুনে ফোনের ওপারে শাহিদ খানিকক্ষণ নিঃস্তব্ধ। তার পর বলেন, “সহশিল্পীদের সত্যি কদর না করলে এমনটা বলা যায় না। ওই জমানার গায়কদের মধ্যে সেই সম্পর্কটা ছিল। দেখনদারি ছিল না। আর আমার আব্বা বলে বলছি না... ড্যাড পুরস্কারের ঊর্দ্ধ্বে চলে গিয়েছিলেন। এই সত্য বুঝতেন মান্না আঙ্কল।”
আজ স্বর্গের জলসাঘরে নিশ্চয়ই দেখা হবে এই দুই কিংবদন্তি শিল্পীর। আড্ডা চলবে ভোকাট্টা থেকে স্টুডিয়োপাড়ার গল্প নিয়ে। মেহফিল বসবে। হয়তো আবার দ্বৈতকণ্ঠে তাঁরা গান ধরবেন ‘হম বচপনকে দোনো ইয়ার/ইয়ার সে বন গয়ে রিস্তেদার...’ আর গানের মাঝে ব্রেক নিয়ে হঠাৎ কি দু’জনে চলে যাবেন ঘুড়িতে মাঞ্জা দিতে? আচ্ছন্ন গলায় শাহিদ শুধু বলেন, “নিশ্চয়ই।” |
|
|
|
|
|