|
|
|
|
|
আমায় তো ওরা তালা বন্ধ করে চাবি নিয়ে চলে যায়
মান্না দে-র গাওয়া বা তৈরি প্রায় একশো গানে মিউজিক অ্যারেঞ্জার হিসেবে কাজ করেছেন
শান্তনু বসু।
প্রয়োজনে গিয়েছেন তাঁর বেঙ্গালুরুর ডেরায়। পিতৃসম প্রবাদপুরুষের শেষ জীবনের
মর্মান্তিক সব
অভিজ্ঞতা কাছ থেকে দেখার পর আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলেন না |
|
ওই রকম নিথর করে দেওয়া খবরের মধ্যে আরও যন্ত্রণাদায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে টিভির সামনের ছবিটা! দেখছি একটা শাটার ফেলা গেটের সামনে পদ্মভূষণ মান্না দে-কে শোয়ানো। শবদেহকে ঘিরে তাঁর কন্যা আর জনাপাঁচেক দক্ষিণ ভারতীয় (টেলিভিশনে তাই মনে হয়েছে)। মাঝে মাঝে কয়েক জন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন।
দেখলাম সামান্য কিছু ফুলে সজ্জিত প্রবাদপ্রতিম মানুষটার দেহ ঢেকে দেওয়া হল পাল্কির মতো একটা ঢাকনা দিয়ে। গাড়ি এগিয়ে চলল হিব্বাল শ্মশানে। ম্যাড়মেড়ে সেই শেষ যাত্রায় সঙ্গী বলতে বাড়ির দুই বাঙালি বাদ দিয়ে দুশো থেকে পাঁচশো দক্ষিণ ভারতীয় মান্না-অনুরাগী। কোথায় বলিউড, কোথায় টলিউড, কোথায় ভারতবাসী, কোথায় বাঙালি! এই ভাবে সমাপ্তি? এটা কি ঠিক হল? দেশে-বিদেশে আজও যাঁর কোটি কোটি মুগ্ধ শ্রোতা, সেই মান্না দা-র কি এটা প্রাপ্য ছিল? এ তো এক জাতীয় ক্ষতি। কোন আদালত এর বিচার করবে?
মান্না দা মারা যাওয়ার পর, বহু বিশিষ্ট মানুষ শোকগাথা লিখেছেন। তাঁদের বক্তব্য জানিয়েছেন। সেখানে নতুন করে কিছু বলতে যাওয়া আমার মতো সামান্য সঙ্গীতকর্মীর কাছে ধৃষ্টতা। একই সঙ্গে আমার একেবারে নিজের বাবার মতো কাছের মানুষটাকে শেষ দিকে যে অসম্মানের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, সেটাও না-জানিয়ে পারছি না।
ইহকালে ওঁর একটা দুঃখ থেকেই গেল। শেষ অ্যালবামটা যে আর উনি এত চেষ্টাতেও করে উঠতে পারলেন না। সেই প্রকল্পের আমিও ছিলাম এক ভাগীদার। তাই এই অসম্পূর্ণতা আমাকেও বাকি জীবনে ঠোকরাবে।
সুলোচনা আন্টি তখন মারা গিয়েছেন সদ্য ক’দিন হল। একদিন মান্নাদা ফোন করে আমায় বললেন, “সুলুকে উৎসর্গ করে কয়েকটা গান করব ঠিক করেছি। তোমার হেল্প চাই।” আমি বললাম, “কী বলছেন! এ আমার পরম সৌভাগ্য। বলুন আমি কী করতে পারি।” তার পর উনি যা বললেন, তাতে তো আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা!
“দেখো, এই সময় আমার গান তো খরচা করে কেউ করবে না। তুমি আমাকে বলো, আমি যদি আটটা গান করি, কত খরচ হতে পারে?”
আমি কোনও জবাব দিতে পারিনি কিছুক্ষণ। আমার নিস্তব্ধতা ভেঙেছিল মান্নাদার ডাকে, “আছ লাইনে, না কেটে গেল?”
“আছি দাদা।”
“আরে জবাব তো দাও।”
“কী বলব দাদা, আপনি মান্না দে। আপনি পয়সা খরচ করে অ্যালবাম করবেন বলছেন!”
“তো, তাতে কী হয়েছে?”
“এটা কি আমাদের পক্ষে মানা সম্ভব?”
“এই, এই তোমাদের টিপিক্যাল বাঙালি মেন্টালিটির কথা। আমি আমার স্ত্রী-কে ডেডিকেট করে গান করব। কার দায় পড়েছে যে খরচ করে তারা কাজটা করবে? আজকের যুগ হল, ফেলো কড়ি মাখো তেল। আজকের দিনে সেন্টিমেন্টের কোনও ভ্যালু নেই।”
চুপ করে শুনে আমি বললাম, “আমায় কয়েকটা দিন সময় দিন। আমি দেখছি।”
এর পরের প্রসঙ্গ বেশ দীর্ঘ এবং বেদনাদায়ক। সে সব না হয় পরে বলা যাবে। এ সবের মধ্যেই একদিন নিছক আড্ডা মারতে গিয়েছিলাম একটা ক্যাসেট কোম্পানির কর্ণধার মহুয়া লাহিড়ির অফিসে। কথাপ্রসঙ্গে মান্নাদার প্রসঙ্গটা জানাতেই ও বলেছিল, “আমরা করব। মান্না দা-র ব্যাপার। তুমি এগিয়ে যাও।”
চলে গেলাম বেঙ্গালুরু। কথামতো হোটেলে পৌঁছে ফোন করলাম মান্নাদাকে। দু’চার কথার পরেই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কাল তুমি কখন আসবে?”
একটু অবাক হয়ে বললাম, “দাদা, আমি তো আজই আপনার সঙ্গে গান নিয়ে বসব বলেই দুপুরে চলে এলাম। আমি যদি সাড়ে পাঁচটা-ছ’টা নাগাদ যাই।”
একটু ইতস্তত হয়ে মান্নাদা জবাব দিলেন, “আজ তো চুমু (ছোট মেয়ে সুমিতা) কাজে চলে যাবে। তুমি কাল এসো।”
“কাউকে লাগবে না দাদা। আমি আর আপনি হলেই তো হবে। আমরা তো গান নিয়ে বসব।”
“অসুবিধে আছে, অসুবিধে।” |
|
চুপ করে রয়েছি। এ বার মান্নাদা নিজেই অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, “আমাকে তো তালাবন্ধ করে চাবি নিয়ে ও কাজে চলে যায়। আবার রাতে বারোটা-সাড়ে বারোটা নাগাদ ওরা আসে। এর মাঝে কেউ এলে ঘরে ঢুকতে পারবে না। তাই তোমায় বলছি। আজ বাদ দাও। কাল এসো।”
স্তম্ভিত আমি বললাম, “দাদা, এ ভাবে!”
“আর বোলো না, আর বোলো না। আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেল,” বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন মান্নাদা।
কথা না বাড়িয়ে ফোন রেখে ঘটনাটার বাস্তব চিত্রটাকে উপলব্ধি করবার চেষ্টা করলাম। ভারতবর্ষের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গায়ক, যিনি ২০১০ সাল অবধি দুনিয়া দাপিয়ে অনুষ্ঠান করে বেরিয়েছেন, বাড়ির বাজার থেকে টেলিফোন বিল
অবধি নিজে দিয়ে এসেছেন, শখ করে বিভিন্ন রান্না করেছেন, আজ ২০১৩ সালে সেই মানুষটাকে ঘরে তালাবন্দি করে রেখে তাঁর বাড়ির লোকেরা নিজেদের কাজে চলে যাচ্ছেন। ভাবা যায়! ওঁর নিজের মুখে না-শুনলে বিশ্বাসই করতাম না।
পরের দিন বাড়িতে বসে এই প্রসঙ্গ তোলায় মান্নাদা বলেছিলেন, “সুলুর চলে যাওয়ায় আমার জীবনে যে কী ক্ষতি হয়েছে, তোমায় বলে বোঝাতে পারব না। আমি তো অর্ধেক সময় বিছানা ছেড়ে উঠিই না। কী করব? কার সঙ্গে কথা বলব? শুয়ে থাকি আর কাঁদি। কাঁদতে কাঁদতে এক সময় চোখের জলে চোখ ভারী হয়ে যায়। তখন ঘুমিয়ে পড়ি। যে দিন ঘুম পায় না, একটা ওষুধ খেয়ে নিই। ঘুম এসে যায়। চুমু দুপুরের দিকে এসে একবার খেতে দেয়। আবার সন্ধের সময় এসে একটু চা দেয়। আর আমার রাতের খাওয়াটা রেখে যায়। ওরা তো ফেরে অনেক রাতে। ওদের কফিশপ বন্ধ করে ওরা আসে।”
“কী বলছেন? এটা কি কোনও জীবন?
“আর কী বলব বলো? জীবনটা যে কখনও এই ভাবে কাটাতে হবে এ কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। আমি খুব খারাপ আছি, খুব খারাপ। আমি আর একটুও বাঁচতে চাই না।” বুঝলাম মান্নাদাকে গানের মধ্যে না ঢোকালে মুশকিল হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ গান নিয়ে আলোচনা করার মাঝে একটা টেলিফোন এলে আমরা থামলাম। মান্নাদা ফোনটাকে কানে নিয়ে, হ্যালো হ্যালো বলেই চলেছেন। আর উলটো দিক থেকে কোনও জবাব উনি শুনতে পাচ্ছেন না। এই ব্যাপারটার সঙ্গে আমি এতই পরিচিত যে আমার কাছে কিছুই মনে হচ্ছে না। ফোনটাকে কেটে নিজেই অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠেন, “আরে! আমি কি একটা ফেকলু লোক, কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি না, কেউ আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে পারে না। এটা হচ্ছেটা কী?”
ভিতর থেকে ছোট মেয়ে সুমিতা এগিয়ে এসে বললেন, “কী ড্যাডি! এত উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছ কেন? যে ফোন করেছে তার প্রয়োজন হলে সে তোমাকে আরও দশ বার ফোন করবে। তুমি একটা ফোন নিয়ে এত চিৎকার কোরো না।”
মান্নাদার তীব্র প্রতিবাদী উত্তর ছিল, “চুমু, তুমি এ সব কথা বোলো না। তোমরা এ সব বুঝবে না। তোমরা কী ভাবো! মানুষ আমাকে অকারণে ফোন করে? যাদের ফোন অপ্রয়োজনীয় তাদের কি আমি এন্টারটেন করি? তোমার কি তাই মনে হয়?”
“ঠিক আছে ড্যাডি, তুমি উত্তেজিত হোয়ো না।”
“এই এক কথা। উত্তেজিত হোয়ো না। আমি কি এমনি এমনি উত্তেজিত হই? কোনও কারণ ছাড়া!” |
“আমি তো অর্ধেক সময় বিছানা ছেড়ে উঠিই না। কী করব? কার সঙ্গে কথা বলব?
শুয়ে থাকি আর কাঁদি। কাঁদতে কাঁদতে এক সময় চোখের জলে চোখ ভারী হয়ে যায়। কখন ঘুমিয়ে পড়ি” |
|
মান্নাদা যা বললেন, শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। “গত বছর আমার জন্মদিনে সকাল থেকে ফোন আসছিল
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। অন্য দিনও ফোন আসে। তাতে ওর (সুমিতা) ঘুমের অসুবিধা হয় বলে
এক সময় চিৎকার করে এসে ল্যান্ডলাইনের তারটাকে খুলে দিয়ে চলে যায়” |
|
হতাশা ঝরে পড়া গলায় ওঁর জবাব ছিল— “আর রেওয়াজ। তুমি জানো না আমি হারমোনিয়াম নিয়ে
বসতে পারি না?...তার নাকি ওই প্যাঁ প্যাঁ আওয়াজ ভাল লাগে না। কী আর বলব?” |
|
আনন্দplus-এর তরফ থেকে সুমিতা দেবীকে অভিযোগ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য
জানার বারবার চেষ্টা এবং এসএমএস করেও কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি |
|
বিষয়টাকে লঘু করার জন্য আমি সুমিতার উদ্দেশে বললাম, “আমারও ভীষণ অসুবিধা হয়। দাদার সঙ্গে কথা বলতে বলতে লাইনটা কেটে যায়। অনেক সময় লাইন পাওয়াও যায় না।” আমার কথা শুনে সুমিতা আমাকে নানা কথা বোঝাতে লাগলেন। যার নির্যাস সেই পুরনো গল্প। যা ২০১১-’১২ থেকে শুনে আসছি। ওঁরা নাকি নতুন বাড়িতে শিফ্ট করবেন, সেখানে অনেক কাজের লোক নেবেন। আমি বললাম ২০১২-তেই তো সেখানে চলে যাওয়ার
কথা ছিল। ওঁর জবাব, “এখন একেবারে শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে। কয়েক দিনের মধ্যেই আমরা ওখানে চলে যাব।”
আমি মান্নাদার দিকে তাকিয়ে বললাম, ল্যান্ডলাইনটা কি ছেড়ে দিয়েছেন?
“আরে না না ছাড়ব কেন? তার ভাড়া তো দিয়ে যাচ্ছি।”
“তা হলে সেটা ব্যবহার করেন না কেন?”
“হুঁ! ল্যান্ডলাইন!”
সুমিতাও কোনও জবাব না দিয়ে চলে গেলেন ভেতরে।
পরে মান্নাদা যা বললেন, শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। “গত বছর আমার জন্মদিনে সকাল থেকে ফোন আসছিল পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। অন্য দিনও ফোন আসে। তাতে ওর (সুমিতা) ঘুমের অসুবিধা হয় বলে এক সময় চিৎকার করে এসে ল্যান্ডলাইনের তারটাকে খুলে দিয়ে চলে যায়।”
“আপনি কিছু বললেন না?”
“কী বলব? ওকে বলে কিছু হয় না। যা মনে করবে, তাই করবে। আমি তা-ও বললাম, বিভিন্ন লোক যোগাযোগ করে, আমি অনেকের সঙ্গে কথা বলি তুমি এটা কোরো না।”
“কী বলল?” সাফ জবাব, “যার প্রয়োজন সে মোবাইলে যোগাযোগ করে নেবে।”
কত বলব! শেষ হওয়ার নয়। মান্নাদা যখন গান তৈরি করছেন, তখনও সুমিতা ইন্টারফেয়ার করছেন। ড্যাডি এই জায়গাটা বাজে লাগছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। এক সময় বিরক্ত হয়ে মান্নাদা বলে ওঠেন— “তুমি কি আমাকে গানও শেখাবে? তুমি বাংলা ভাষা বোঝো না, জানো না, কেন মন্তব্য করছ? আমি তো শান্তনুকে শোনাচ্ছি। লেট হিম সে সামথিং ফার্স্ট।”
বীরেন্দ্র সহবাগ যে ভাবে গুড লেংথ বলও উড়িয়ে দেন, প্রায় সেই ভঙ্গিতেই মান্নাদার উদ্দেশে জবাব গেল, “আমি কি তোমার গান যাতে খারাপ হয় তাই বলছি? আমি তো ভালর জন্যই বলছি?”
“প্লিজ কিছু বোলো না। প্লিজ। আমাদের কাজ করতে দাও। ডোন্ট ইন্টারফেয়ার।”
“হোয়াই নট ড্যাডি, তুমি মাকে ডেডিকেট করে গান করছ, সেখানে আমার কি কোনও মতামত থাকতে পারে না। মাম্মিও তো তোমার গানে কত কিছু বলত?”
“তুমি কি সেই ভাবে কিছু বলছ? যাকগে ছাড়ো ছাড়ো, আজ আর হবে না।”
আমি বললাম, “দাদা আমার তো সময় কম। চলুন একটু চা খেয়ে আবার শুরু করি।”
সে যাত্রা কলকাতায় ফিরে আসার দিন হোটেল থেকে বেরোনোর সময় মান্নাদার ফোন অনেক চেষ্টাতেও পাইনি। ভাবলাম হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন। ফের ওঁর বাড়ি গেলাম। পৌঁছে দেখি ওঁর জামাই জ্ঞানরঞ্জন এসেছেন। ঢুকেই বললাম, “দাদা এত বার ফোন করছিলাম। ফোনটা কোথায় রেখেছেন?”
কাতর স্বরে মান্নাদা জবাব দিলেন, “না না, আমি তো আবার পড়ে গেছিলাম। এত লেগেছে আমার মাথায় আর হাতে, আমি তো উঠতেই পারছিলাম না। দেখি ক্যাথিটার থেকেও রক্ত গড়াচ্ছে। জ্ঞান না এলে আমি তোমাকে দরজাও খুলে দিতে পারতাম না।”
মনে মনে এত রাগ হচ্ছিল, এর কিছু দিন আগেই আমার পাঠানো এক কাজের লোক অতিষ্ঠ হয়ে চলে এসেছে। কারণটা আর বড় করে না-ই বা বললাম। সে বার গিয়েও যে হোটেলে ছিলাম, সেখানকার বয়দের বলে ওঁর বাড়ির জন্য লোক জোগাড় করেছিলাম। মান্নাদা রাজিও ছিলেন। কিন্তু বাড়িতে ওঁর কথাই তো শেষ কথা ছিল না। অসহায় প্রৌঢ় কত বার যে বলেছেন, ওঁর দিনে রাতে পড়ে যাওয়ার কথা!
একটু পরে জ্ঞানরঞ্জন বেরিয়ে গেলে চোখে জল নিয়ে মান্নাদা আমায় বলেছিলেন, “শান্তনু, আমার জীবনের এখন একটাই কাজ। এই গানগুলো গেয়ে নিজের জীবনটা শেষ করতে চাই। এটা না করতে পারলে আমার সুলুর প্রতি অবিচার করা হবে। আমি মরেও শান্তি পাব না।”
ওঁর সেই অসহায় অথচ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ চেহারা আজ প্রতি মুহূর্তে চোখে ভাসছে। বিকেল পৌনে চারটের সময় (হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন, বিকেল পৌনে চারটে) সুমিতার এনে দেওয়া সাউথ ইন্ডিয়ান লাঞ্চ প্যাক যখন মান্নাদা খাচ্ছিলেন, তখন ওঁকে কথা দিয়েছিলাম, অ্যালবামটা হবেই। মিউজিক ট্র্যাকও হয়ে গিয়েছিল। শুধু উনি ডাবটা করতেন। কিন্তু গানটা আর গাওয়া হল না। সুমিতা ঘরে ঢোকার আগেই মান্নাদাকে বলেছিলাম আপনি আগামী পনেরো কুড়ি দিন হারমোনিয়াম নিয়ে বসে একটু রেওয়াজ করবেন। আমি ঠিক এক মাস পরে এসে আপনার গান রেকর্ড করব। হতাশা ঝরে পড়া গলায় ওঁর জবাব ছিল— “আর রেওয়াজ। তুমি জানো না আমি হারমোনিয়াম নিয়ে বসতে পারি না?”
“কেন?”
“তার নাকি ওই প্যাঁ প্যাঁ আওয়াজ ভাল লাগে না। কী আর বলব? তুমি তো হারমোনিয়ামটা ঠিক করে দিয়ে গেলে। এ বার আমি রেওয়াজ করব। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
কিছুই ঠিক হল না। নাকি ঠিক হতে দেওয়া হল না, সেই বিতর্কে আর যেতে চাই না। দুঃখ এটাই যে মান্নাদার মনের শেষ ইচ্ছা আমরা সবাই মিলে পূর্ণ করতে পারলাম না। একটাই কথা বলতে চাই—
‘অনেক দিন ছিলাম প্রতিবেশী
দিয়েছি যত নিয়েছি তার বেশি।’
আমায় ক্ষমা করবেন, জানি না পরলোক বলে সত্যি কিছু আছে কি না! যদি থাকে তা হলে নিশ্চয়ই আবার সেখানে মিলিত হয়েছেন অমর প্রেমের দুই রূপকার মান্না আর সুলোচনা।
আর দু’জনেই পুনর্মিলনের বিস্ময়ে গেয়ে চলেছেন তাঁদের অতি প্রিয় সেই গান—
‘খুব জানতে ইচ্ছে করে
তুমি কি সেই আগের মতো আছ
না কি, অনেকখানি বদলে গেছ...’
জানতে ইচ্ছে করে।’ |
|
|
|
|
|