কী চেয়েছি আর কী যে পেলাম
দেখি রাজাটা তো পড়েই আছে মুকুটই শুধু নেই—দশ মাস আগে বেঙ্গালুরুতে মান্না দে-র বাড়ি থেকে ভরদুপুরে বার হওয়ার সময় তাঁর চিরবিখ্যাত গানের দুটো লাইনই গুনগুন করে মাথায় এল। উলটে গিয়ে।
দেখি মুকুটটা তো পড়ে আছে, রাজাই শুধু নেই—এটা একান্তই গীতিকারের লেখা। তাঁর কল্পনা। মান্না-জীবনের গীতিকার মনে হল মৃদু হেসে অন্তিম লাইনটা বদলে দিয়েছেন। এই যে রাজাকে চোখের সামনে দেখে এলাম, সে তো রাজ্যপাটহীন আগরা দুর্গে বন্দি শাহজাহান। চিরস্বাধীন মানুষটার অবশ্যই পছন্দ হচ্ছে না নির্জন কারাবাস। সে গর্জন করতে চায় বরাবরের মতো। টুপিটা গলিয়ে বরাবরের অভিজ্ঞানে ফেরত যেতে চায়। হারমোনিয়ামে হাত রেখে প্রত্যাবর্তন চায় মাইকের সামনে। মানুষের সামনে।
কিন্তু কে দেবে সেই স্বাধীনতা? প্রহরীরা তো গরাদের চাবি নিয়ে চলে গিয়েছে।
দিন সাতেক বাদে মোবাইলে ৯৮৮৬০-৬৭০১২ দেখে চমকে উঠলাম।
মান্না দে!
হঠাৎ এত সকালে!
“খুব খারাপ লাগছে ভেবে। তোমরা সে দিন এলে। আমি কিনা এক গ্লাস জল খেতেও বললাম না। কাজের মেয়েটা তো আমায় একবার মনে করাবে—বলো তো, কী সব এদের কাজের ছিরি!” যত বলছি তাতে কিছু এসে যায়নি, আপনাকে দেখে এলাম এটাই সব চেয়ে আনন্দের, মান্না তবু থামছেন না।
“যে কোনও কাজে পারফেকশন বলে একটা কথা আছে। ওটাই আসল। বাকি সব মেকি। আমরা বাঙালিরা নিখুঁত কাজ করতেই ভুলে গিয়েছি,” কথাটা শুনতে শুনতে কী করে বেঙ্গালুরুরই এক সকালে ফিরে গেলাম।
২০১১ অক্টোবর। সচিন তেন্ডুলকরের জীবন নিয়ে সে দিন বেঙ্গালুরু ওবেরয়তে রিলিজ হবে ‘সচ্।’ সচিন-সহ গোটা ভারতীয় দলের থাকার কথা। উদ্বোধনী বক্তা মান্না দে। যিনি কি না শরীর হঠাৎ বেচাল ঘটানোয় আসতে পারছেন না। কিন্তু ভিডিয়ো রেকর্ডিংয়ে বক্তব্য রাখতে চান। এত কম নোটিসে সেটাও জোগাড় করা গেল না। ফোনেই অগত্যা আমায় ডিক্টেশন দিলেন মান্না। জানতাম ওঁর প্রিয় ক্রিকেটার রাহুল দ্রাবিড়। তিনি যে তেন্ডুলকরে এমন আপ্লুত, জানার সুযোগ হয়নি কখনও।

...এই সেই ঘর যেদিকে তাকাই সব কিছুতে তোমার বড় যত্নের ছোঁয়া
“সচিন, তোমাকে শুধু প্রতিভার জন্য সম্মান করি না। কুর্নিশ করি তোমার শাস্ত্রজ্ঞানে পারদর্শিতার জন্য! তোমার নিজের বিষয়ে পারফেকশন আয়ত্ত রাখার যে মানসিক শৃঙ্খলা তুমি কয়েক দশক ধরে দেখিয়ে যাচ্ছ, সেটা রোমহর্ষক! প্লাস তোমার মধ্যে আমি একটা ম্যাজিক দেখতে পাই যেটা রাজ কপূরের মধ্যেও ছিল। এ দেশে তোমার লাখ লাখ ফ্যান রয়েছে। কিন্তু আমি বোধহয় তোমার সব চেয়ে বেশি বয়সি ফ্যান। বিশ্বকাপের জন্য সেই বুড়ো লোকটা তোমায় একরাশ শুভেচ্ছা জানাচ্ছে।”
পরের দিন নেট প্র্যাকটিসে যাওয়ার আগে তেন্ডুলকর জানিয়ে গেলেন অনুষ্ঠানে তাঁর সব চেয়ে মন ছুঁয়ে গিয়েছে মান্না দে’র দরদি বক্ত ব্য।
পারফেকশন শব্দটা কি ওঁর খুব প্রিয় ছিল? একাধিক বার নইলে কথাটা শুনব কেন? জীবনের ভরকেন্দ্রে বোধহয় এই শব্দটাকেই বসিয়ে তার আরাধনা করে গিয়েছেন— জনপ্রিয়তা চাওয়ার আগে বিশুদ্ধতার খোঁজ করো। সফল যদি হতেই হয় তা যেন প্রথম শুদ্ধতাকে বরণ করে আসে।
বছর পাঁচেক আগের ঘটনা। বাগুইআটিতে বন্ধু সাংবাদিকের বাড়িতে মান্নার নেমন্তন্ন। গৃহকর্তা বললেন, আজ একটু অন্য ভাবে মান্না বরণ করব। মান্নাদার সামনে বসে তাঁর গান গাইবেন সম্পূর্ণ অপেশাদাররা। সেই গানের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানানো হবে তাঁকে। অন্য আর সব দিনের মতো গাইতে বলা হবে না তাঁকে। বরং রিল্যাক্স করে অন্যের গলায় নিজের গান শুনতে পাবেন বারবার।
শুনেই শঙ্কা জেগেছিল ঠিকঠাক হবে তো? যাক, মান্না এসে পড়লেন। শুনলেন অভিনব উদ্যোগের কথা।
কিছু বললেন না। তবে মুখে হাসি দেখা গেল না।
প্রথম গায়ক ক্রীড়া সাংবাদিক সরোজ চক্রবর্তী। ঘরোয়া আড্ডায় মান্নার গান দীর্ঘ দিন গাইছে সরোজ। অনবদ্য না হলেও শ্রুতিমধুর। কিন্তু সে দিন স্বয়ং মান্নার সামনে পড়ে বেচারির গলা চোকড। ফিফটি পার্সেন্ট খারাপ গাইল। দেখলাম মান্নার মুখের জ্যামিতি ক্রমশ বদলাচ্ছে। পরবর্তী গায়ক, অভিনেতা দুলাল লাহিড়ি। চোখটোখ বন্ধ করে খুব যত্নের সঙ্গে দুলালবাবু গাইলেন ‘বড় একা লাগে’। মান্না এ বার অস্থির হতে শুরু করেছেন। জমায়েতে হাজির মান্নাভক্ত কোনও কোনও মহিলা ততক্ষণে উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন, “এটা কী হচ্ছে? মান্না দে কেন অ্যামেচার এত সব গায়কের আবির্ভাব সহ্য করবেন?” তৃতীয় গায়ক পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়। সামান্য আশ্বাস এই সময় পাওয়া গেল যে ফোর্থ সিঙ্গার থেকে নাকি গানের কোয়ালিটি বাড়বে। ‘অতিথি’খ্যাত পার্থ মুখোপাধ্যায় যাবেন চার নম্বরে। আর তিনি গায়ক-নায়ক। মানে তৈরি গলা।
কিন্তু পার্থ অবধি সুযোগই পৌঁছল না। তাঁর আগে তো পিকে। যিনি একটা নাতিদীর্ঘ ভূমিকা দিলেন গানের আগে। গাইবেন ‘সেই তো আবার কাছে এলে’। বললেন, “মান্নাবাবু এটা গেয়ে আমার মৃত স্ত্রী-র সঙ্গে কোথাও একত্রিত হই।” ঘরের পরিবেশ সামান্য ভারী। কিন্তু মান্না কিছুই বলছেন না। নির্বিকার এবং গম্ভীর। পিকে তিন লাইন গেয়েছেন কি না, এ বার মান্না নিজেই ধরলেন। এর পর টানা সাতটা গান করলেন সম্ভবত সাঙ্গীতিক দূষণ আক্রান্ত ঘরটাকে বিশুদ্ধ আসরে ফিরিয়ে আনতে। যেন মিউজিক ফ্রেশনার স্প্রে করলেন ঘরের চার দিকে।
এই ছিলেন মান্না! শেষ কুড়ি বছরে সামান্য যেটুকু দেখার সুযোগ হয়েছে, শর্ট কাটে যাওয়ার আগ্রহ কখনও এক মিনিটের জন্যও দেখিনি! সুররাজ তো নিশ্চয়ই, তাকেও হারিয়ে দিয়ে সব সময় শুদ্ধরাজ!
মান্না দে-র সঙ্গে আলাপের বছরখানেক আগে পরিচয় হয়ে গিয়েছিল পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। আধুনিক বাংলা গানের ইতিহাসে মান্না যদি যন্ত্রী হন, পুলক তা হলে একটা দীর্ঘ অধ্যায় জুড়ে তাঁর যন্ত্র। কত সুপারহিট গান যে এঁদের যুগলবন্দিতে উৎপন্ন তা হিসেব করতে যে পরিমাণ সময় লাগবে তার মধ্যে গড়িয়াহাট থেকে তরকারির বাজার আর মাংস কেনা— দুটোই সেরে ফেলা যায়!
হাওড়ার বাড়ি ছাড়াও লেক গার্ডেন্সে ফ্ল্যাট কিনেছিলেন পুলক। রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো থেকে দুপুরে ট্রেনে উঠতেন। রবীন্দ্র সরোবর টু চাঁদনি চক— এই ষোলো মিনিটের ট্রেনযাত্রায় নিয়মিত সহযাত্রী হওয়ার সুযোগে ওঁর কাছে একাধিক বার জানার চেষ্টা করেছি, তাঁদের জুড়িতে বিরহ সিরিজের কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া যে এত সব গান, তার নেপথ্য গলিতে কে?
পুলক চশমাটার ফাঁক দিয়ে কৌতূহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন, “নেপথ্য গলি মানে?”
গলি মানে, কোন নারী মান্না দে-কে এমন দাগা দিয়েছিল যে, গায়কিতে এত বছর পরেও সেই যন্ত্রণার ঢেউ চুরমার করে আসে?
পুলক এতক্ষণে আশ্বস্ত, “ছিল ওই সব কলেজজীবনে উত্তরের কোনও মহিলা-টহিলা নিশ্চয়ই... কেউ না কেউ থেকেই যায় যেমন।” আপনি চিনতেন না? “নাহ, মান্নাবাবু তো অত চট করে নাম-টাম বলেন না। কথা তুললে মৃদু হাসেন,” পুলক ভাসা ভাসা জবাবে ব্যাপারটায় সূক্ষ্ম উপসংহার টেনে দিলেন।
কিন্তু সাংবাদিকের খিদে এত নিরামিশাষী উপসংহারে নিবৃত্ত হওয়ার নয়। বছরখানেক বাদে আলাপ হল স্বয়ং মান্না দে-র সঙ্গে। তাঁর সঙ্গীতজীবনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে নেতাজি ইন্ডোরে বিশাল অনুষ্ঠান। সচরাচর যারা এ সব জলসা বা বড় অনুষ্ঠান-টনুষ্ঠান আয়োজন করে তারা মোটেও করছে না। উদ্যোক্তা ঘটনাচক্রে ত্রিমূর্তি। আমরা আনন্দবাজারের দুই সাংবাদিক আর ফুটবলার সুভাষ ভৌমিক। অনুষ্ঠান থেকে সংগৃহীত চল্লিশ লাখ টাকা সেই মঞ্চেই চ্যারিটিতে দিয়ে দিলেন মান্না। সমস্যা হল, কথা ছিল পিঠোপিঠি রাজ্য সরকারের তরফে একটা ঘোষণা হবে। কলকাতায় বাড়ি করার জন্য মান্না দে-কে জমি দেওয়া হল, এ হেন আবেগাপ্লুত ঘোষণা করবেন রাজ্যের তখনকার তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। অথচ ভারতের অন্য শহরে তাঁর বাড়ি আছে এমন যুক্তি তুলে বাম সরকার শেষ মুহূর্তে কথার খেলাপ করে। জীবদ্দশায় জমিটা আর মান্না পাননি। আজও যেমন পাননি মিঠুন চক্রবর্তী।
যাক গে রাজনৈতিক সে সব ফন্দিফিকির। ইন্ডোরে ১৯৯৩-এর সেই অনুষ্ঠানে কাকে কাকে ডাকতে হবে তার তালিকা মুখেই দিয়েছিলেন মান্না। বিশেষ নির্দেশ তার মধ্যে ছিল, পুলকবাবুকে যেন অবশ্যই ডাকা হয়। পুলক এলেনও। ফটোগ্রাফারেরা চুটিয়ে ছবি তুললেন দু’জনের। জানা গেল, মুম্বইয়ে মান্নার বাড়িতে গিয়ে তাঁর নতুন লেখা গানগুলো সব শুনিয়ে আসেন পুলক। একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া। আড্ডা। দুষ্টু সব জোকসের আদানপ্রদান চলে। “পুলক আমাকে বোঝে! ঠিক আমি কী চাই, আমার কোন কথাটা গাইতে ভাল লাগবে সেটা ভেবে লেখে।”
পুলক যে বললেন, বিরহের গান এত ভাল গাওয়ার পেছনে আপনার কলেজজীবনে দাগা খাওয়া কোনও স্মৃতি রয়েছে সেটা কি সত্যি? “হোয়াট! পুলক বলেছে বুঝি? রাবিশ। ওকে চেপে ধরো। ও-ই কতগুলো দাগা খেয়েছিল কলেজ লাইফে।” এর পর মান্না ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন
পুলক কী ভাবে বাস্তবজীবন থেকে লেখার উপাদান তুলতেন। কোনও পার্টিতে চোখ ঘুরিয়ে দেওয়া এক সুন্দরীর সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন দু’জনেই। দ্রুত পুলক লিখে ফেলেন,
ও কেন এত সুন্দরী হল
ওমনি করে ফিরে তাকাল
দেখে তো আমি মুগ্ধ হবই
আমি তো মানুষ
।’

জুহু বিচে মান্না দে
পরবর্তী কালে স্ত্রী-প্রেমে আচ্ছন্ন মান্নাকে দেখে মনে হয়েছে বিরহ সিরিজের সহজ উপসংহার হল, সত্যি কথাটা তিনিই বলেছিলেন। দাগাটা একান্ত পুলকের ছিল। বা দাগাগুলো।
নইলে গত বছরের শুরুতে সুলোচনা চলে যেতে এমন জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন কেন? সেই সময় থেকেই শারীরিক যন্ত্রণা, মানসিক শোক আর পরিস্থিতির উথালপাথালে মান্নার বিপর্যস্ত হওয়া শুরু। আমেরিকাতে বসবাসকারী বড় মেয়ের ক্যানসার হৃদয়বিদারক হলেও এত কাল তার সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। সুলোচনার মৃত্যু এমন অতর্কিত চাপ নিয়ে এল, যে চিরলড়াকু মান্না বাঁচার ইচ্ছেকে যেন ওয়াকওভার দিয়ে দিলেন। মৃত্যুর মাত্র ক’মাস আগে বাড়িতে মুখোমুখি দেখা করতে না গেলে কোনও দিন জানাই হত না, এভারগ্রিন একটা মানুষের যে এই পরিণতি হতে পারে।
মুগুরভাজা। ফুটবল খেলা। গোবর গোহ-র আখড়ায় কুস্তি করে বড় হওয়া— মান্নার মনন বরাবর ডানপিটে। স্পোর্টসম্যানদের মতো। সখি সখি আর্তনাদ বা আর কত দিনই বা আছি জীবনে, এই সব কোনও দিন তাঁর মুখ দিয়ে বের হয়নি। সেই মানুষটাই যখন ক্যাথিটার টানতে টানতে বার কয়েক বললেন, “আমায় এ বার নিয়ে যাক আর কষ্ট না দিয়ে, আমি তৈরি।” বোঝা গেল এ বার ভেতর থেকে বিদীর্ণ। তারই মধ্যে ভয়াবহ নিঃসঙ্গ।
“একটা মানুষের মুখ দেখতে পাই না। জীবন চলে টিভি দেখে আর এই ফোনে,” মর্মান্তিক শোনায় ৯৩ বছরের বৃদ্ধের গলা। যাঁর জীবনটাই কেটেছে প্রেক্ষাগৃহে। থিকথিকে মাথার ভিড় দেখে। যাঁর উত্থান একান্নবর্তী পরিবার থেকে। যার উত্তর কলকাতার বাড়িতে সব সময় ঘিরে থাকত সশ্রদ্ধ ভিড়। বেঙ্গালুরুর শহরতলির এই কোনার প্লট, যেখানে পাশের বাড়িতে কেউ
বেঁচে আছে কি না বোঝার উপায় নেই। সেই গভীর নিঃসঙ্গতা তো জীবনে প্রথম তাঁর গলায় বৃদ্ধের আকুতি এনে দেবেই— আমায় এ বার নিয়ে যাক। আর কষ্ট চাই না।
হৃদয় আছে যার সে-ই তো ভালবাসে
প্রতিটি মানুষেরই জীবনে প্রেম আসে...

এতক্ষণে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে সামনে বসা বৃদ্ধের জীবন থেকে প্রেম চিরবিদায় নিয়েছে। বিষাদের সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি যেন তিনি।
মাঝে মাঝে পুরনো তেজিয়ান মান্না ছিটকে বার হয়ে আসছেন,
“কী কী সব গোল দেখছি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে। উফ!”
“সচিন এ বার ছেড়ে দিক। সম্মানের সঙ্গে যাক।”
“আমি কারও করুণার পাত্র হতে চাই না। সরকারের টাকায় কেন আমার চিকিৎসা হবে?”
“অ্যা-ই এখন আমার ছবি তুলো না এই অবস্থায়। সুস্থ হয়ে উঠি তার পর।”
বলছেন ঠিকই টুকরো-টাকরা। কিন্তু দ্রুতই সেই পুরনো নেটওয়ার্ক উড়ে গিয়ে পুরনো বিপন্ন মানুষটা বার হয়ে আসছে। দ্বিপ্রাহরিক সফরে সহযাত্রী ফটোগ্রাফার উৎপল সরকার। বিভিন্ন সময়ে মান্নার এত ছবি তুলেছে উৎপল যে, শুধু তা জড়ো করেই অনায়াসে একটা ফটো-এক্সিবিশন হয়। হঠাৎ করে একদিন ‘না’ বললে কী আর শোনার পাত্র! ও মোবাইল ক্যামেরা অন করেই রেখেছে। একবার শুধু ফ্ল্যাশ মারতেই পাশের ঘর থেকে তীব্র তিরস্কার, “স্টপ, স্টপ, স্টপ হিয়ার।”
অত্যন্ত বিরক্ত মুখভঙ্গি নিয়ে যে মহিলা বার হয়ে এলেন তাঁকে গোটা ভারত মান্না-র মুখাগ্নির পর টিভি ক্যামেরার সামনে বারবার হাজির হতে দেখেছে। সুমিতা দেব। শিল্পীর ছোট মেয়ে।
আগেকার মান্না পরিস্থিতির ওপর দ্রুত দখল নিয়ে নিতেন। এতটা রূঢ়তা তৈরিই হত না। ইনি এক বৃদ্ধ। যিনি লজ্জিত মুখে বসে রইলেন। আমরা তখনই উঠে পড়তাম। কিন্তু মলিন মুখে নবতিপর মানুষটি এ বার তাঁর অন্তিম স্বপ্নের আলোচনা শুরু করলেন।
“অ্যালবাম করছি ওর স্মৃতিতে। মাই ট্রিবিউট টু সুলোচনা।”
জানা গেল আশা অডিও থেকে জীবনের শেষ অ্যালবাম বার করছেন মান্না। তার কাজও নাকি অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে।
কলকাতা গিয়ে এই অবস্থায় রেকর্ডিং সম্ভব নয়। ২০১০-এর পর আর তো এই শহরে আসেনওনি।
কিন্তু কলকাতা থেকে গানের ট্র্যাকটা যে আনিয়েছেন। বেঙ্গালুরুর স্টুডিয়োয় সেটা ডাব করবেন। এমন স্টুডিয়ো যেখানে একতলাতেই রেকর্ডিং হয়। সিঁড়ি ভাঙার ঝক্কি নেই। চার-পাঁচটা গান নিজেই সুর করবেন। গান লিখেছেন দেবপ্রসাদ চক্রবর্তী। লাইনগুলো মনে হল নোটেশন না দেখেই মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। গাইতে শুরু করলেন।
জানি জানি আবার দেখা হবে/ চোখের জলে দিন গোনা তাই/ সে দিন আসবে কবে’ হালকা সুরে গুনগুন করতে করতে আরও স্মৃতিসর্বস্ব, আত্মহারা হয়ে পড়ছেন একেবারে অচেনা এই মান্না। হেঁটমুখে তাকিয়ে থাকলেন উলটো দিকের ঘরের দিকে। “এখানেই তো সুলোচনা থাকত। ওর সব কিছু ছিল এই ঘর ঘিরে। ভুলতে পারি না। ভুলতে পারি না আমি।”
...এই সেই ঘর/ যে দিকে তাকাই সব কিছুতে/ তোমার বড় যত্নের ছোঁয়া/ কী করে মানব বলো/ একসাথে যেতে যেতে/ তোমার এমন করে চলে যাওয়া/ কী করে মানব বলো,’ গাইতে গাইতে কেঁদেই ফেলেন। সামনে বসে কেমন সুররিয়্যাল মনে হতে থাকে সব কিছু। এই লোকটা মান্না দে! এর চোখের জল তো কখনও দেখিনি!
দিন কয়েক বাদে টেলিফোনে তীব্র অনুযোগ করতে থাকেন, “এরা তো আমায় পার্কেও বসিয়ে খানিক ঘুরে আসতে পারে। আমি তো মানুষ দেখতে চাই, মানুষ। মানুষ ছাড়া বাঁচব কী করে আমি?”
তখন সত্যিই মনে হতে থাকে বিষণ্ণতার শেষ শাহেনশা তিনি। আগরা দুর্গে বন্দি নিঃসঙ্গ, ব্যথিত এক অতীত জাঁহাপনা। নিজের ট্র্যাজেডিভরা গানগুলো আজ এঁকে নিয়েই লেখার সময় হয়েছে!

পুনশ্চ: মৃত্যুর খবর শুনে মনে হল স্বপ্নের অ্যালবামটা না-করা হোক, মান্না বোধহয় শান্তি পেলেন। শোকের অন্তিম ধাপ অতিক্রম করে তিনি অবিরাম সুখে ফেরত এক নৃপতি। গুটিপোকা থেকে প্রজাপতিতে বিবর্তনের মতো আবার যে তিনি চিরপরিচিত মান্না দে! ক্যাথিটারের দুনিয়া, স্ত্রী-হীন বিপন্নতা আর অসংবেদনশীল প্রিয়জন ছেড়ে আবার স্বাধীন, স্বশাসিত আর মুক্তমনা।
ওই তো আবার সবাই শুনতে পাচ্ছে উদাত্ত, খুশিয়াল সেই গলা, “ইচ্ছে করে শূন্যে উঠে মেঘের ওপর দিয়ে হাঁটি।”

ছবি: উৎপল সরকার



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.