সোমা মুখোপাধ্যায় • কলকাতা |
অপারেশন টেবিল থেকে চিত্রনাট্যের টেবিলে। চিকিৎসা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে চিকিৎসক নিজেই এ বার সিনেমার কারিগর।
কলকাতার নামী গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট কল্যাণ বসু প্রথমে একটি গল্প লিখেছিলেন। বিষয় ছিল, লিভার প্রতিস্থাপন। এ বার সেই গল্প অবলম্বনেই পূর্ণাঙ্গ কাহিনিচিত্র প্রযোজনা করছেন তিনি। ‘আসবো আরেক দিন’ নামে ছবিটি মুক্তি পাচ্ছে আজ, শুক্রবার। চিকিৎসক মহলের বড় অংশের আশা, ‘মৃতদেহ থেকে অঙ্গ নিলে পরের জন্মে ওই সব অঙ্গ ছাড়াই জন্মাতে হবে’ কিংবা ‘অঙ্গ প্রতিস্থাপন নিয়ে সওয়াল করা ডাক্তার মাত্রেই আসলে অঙ্গপাচারকারী’ এমন সব আজগুবি ধারণা কিছুটা হলেও কমাতে পারবে এই ছবি।
ভারতে অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইন তৈরি হওয়ার পর ১৯ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এ রাজ্যে মৃতদেহ থেকে চোখ ছাড়া অন্যান্য অঙ্গ প্রতিস্থাপনের হার এখনও তলানিতেই। আজ পর্যন্ত ‘ব্রেন ডেথ’ বা মস্তিষ্কের মৃত্যু কাকে বলে, ব্রেন ডেথের পরে অঙ্গ নিলে তা কোনও মুমূর্ষু মানুষকে কী ভাবে নতুন জীবন দিতে পারে, তা নিয়ে ন্যূনতম সচেতনতাই গড়ে ওঠেনি অধিকাংশ মানুষের মধ্যে। তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাত বা কর্নাটক অনেকটা এগিয়ে গেলেও পশ্চিমবঙ্গ এ ব্যাপারে এখনও পিছনের সারিতেই। এ পর্যন্ত বার কয়েক কিডনি আর যকৃত প্রতিস্থাপন হয়েছে। বিচ্ছিন্ন ভাবে দু’এক জায়গায় শুরু হয়েছে ত্বক প্রতিস্থাপনও। কিন্তু ওই পর্যন্তই।
চিকিৎসার এই ছবিটাই বদলে দেওয়ার চেষ্টায় পর্দার ছবি। পরিচালক অভিজিৎ দাশগুপ্ত জানিয়েছেন, গুরুগম্ভীর মেডিক্যাল কচকচির বদলে সহজ ভাষায় পারিবারিক গল্পের ছলে লিভার প্রতিস্থাপন নিয়ে একটা বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আর কাহিনিকার তথা প্রযোজক কল্যাণবাবু বলেন, “ব্রেন ডেথ বিষয়টা কী, সেটাই এখনও মানুষকে বোঝানো যায়নি। এই ব্যর্থতা আমাদের সকলের। সেই দায় থেকেই এই ছবি।” কিছু দিন আগে আনন্দ গাঁধীর ‘শিপ অফ থেসেয়ুস’ ছবিটিও এ বিষয়ে সাড়া ফেলেছিল। এ বার বাংলা ছবিও সেই পথে হাঁটল।
গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট অভিজিৎ চৌধুরী বলছিলেন লিভার প্রতিস্থাপন নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। হাসপাতালে অন্তিম শয্যায় এক রোগী। লিভার প্রতিস্থাপন করা গেলে বেঁচে যাওয়ার আশা রয়েছে। এমন সময়ে ওই হাসপাতালেরই অন্য এক ওয়ার্ডে এক রোগীর ‘ব্রেন ডেথ’-এর খবর এল। দু’জনেরই রক্তের গ্রুপ এক। চিকিৎসকেরা দ্বিতীয় জনের পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে অঙ্গদানে রাজি করাতে ছুটলেন তাঁর বাড়ি। কিন্তু সেখান থেকে তাঁদের ফিরতে হল কার্যত প্রাণ হাতে করে। কারণ, অঙ্গদানের কথা বলায় তাঁদের বরাতে জুটেছিল ‘পাচারকারী’র তকমা। অভিজিৎবাবুর কথায়, “ব্রেন ডেথ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের যেমন কোনও স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়নি, তেমনই ব্রেন ডেথের পরে অঙ্গদান সম্পর্কেও তাঁরা সমান অন্ধকারে।”
অঙ্গ প্রতিস্থাপন সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে কয়েক বছর ধরে সক্রিয় রয়েছেন ইউরোলজিস্ট অমিত ঘোষ। তিনি বলেন, “এডস-এর মতো অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়াতে যত দিন না ‘বুলাদি’র মতো চরিত্র তৈরি হবে, সংস্কার-জড়তা কাটবে না। পাড়ায় পাড়ায় রক্তদান নিয়ে যেমন উন্মাদনা, অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রেও সেই দিকে এগোনো দরকার।”
কাঞ্চিপুরমের দুই নামী চিকিৎসক অশোকন সুব্রমণি এবং তাঁর স্ত্রী পুষ্পাঞ্জলী সুব্রমণি এক পথ দুর্ঘটনায় তাঁদের ছেলে হিতেন্দ্রনের মস্তিষ্কের মৃত্যুর পরে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে অঙ্গদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। হিতেন্দ্রনের হার্ট, যকৃত, কিডনি এবং চোখ একাধিক মানুষকে নতুন জীবন দিয়েছিল। এই ঘটনা নজির হয়ে রয়েছে গোটা দেশেই। কিন্তু এ রাজ্যে?
স্বাস্থ্যকর্তারা মেনে নিয়েছেন, এখানে এখনও ব্রেন ডেথ ঘোষণা করার কমিটিই গড়ে তুলতে পারেনি রাজ্য সরকার। তাঁদের আশ্বাস, দ্রুত এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। নিয়ম অনুযায়ী কোনও রোগীর মস্তিষ্কের মৃত্যু হয়েছে কি না, তা ঘোষণা করতে হয় চিকিৎসকদের একটি কমিটিকে। ওই কমিটিতে কার্ডিওলজিস্ট, নিউরোলজিস্ট, অ্যানাস্থেসিস্ট, ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা থাকেন। তাঁরা পৃথক ভাবে রোগীকে পরীক্ষা করে রায় দেন। মস্তিষ্কের মৃত্যুর পরে যত দ্রুত সম্ভব অঙ্গগুলি সংগ্রহ করে তা অন্যের দেহে প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা করলে সাফল্যের হার বাড়ে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
কিন্তু বাস্তবে অঙ্গ প্রতিস্থাপন সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর কোনও চেষ্টাই সরকারি স্তরে চোখে পড়ে না। এখনও কোনও তথ্যপঞ্জি তৈরি হয়নি যা থেকে জানা যাবে, কোন হাসপাতালে ভর্তি কোন রোগীর কোন অঙ্গের জন্য দিন গুনছেন। ডাক্তারদের একটা বড় অংশ তো বটেই, এমনকী সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের কর্তারাও অঙ্গ প্রতিস্থাপনের নিয়মকানুন সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানেন না। দেহদান নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছে এমন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তরফে ব্রজ রায় বলেন, “এখানে বেশির ভাগ ডাক্তারই অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ব্যাপারে জড়াতে চান না। কারণ প্রশাসনিক তরফে প্রচুর বাধা আসে। কোন চিকিৎসকেরা ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষণা করতে পারবেন, তাঁদের নামের একটা তালিকা ২০০৬ সালে সরকারি তরফে প্রকাশ হয়েছিল। তার পরে আজ পর্যন্ত সেই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়নি।” |