|
|
|
|
দুর্ঘটনা ভুলে শব্দবাজি তৈরি রমরমিয়ে
আনন্দ মণ্ডল • তমলুক |
বিস্ফোরণে প্রাণ গিয়েছে আপনজনের। তবু এখনও বন্ধ হয়নি বারুদ দিয়ে বাজি তৈরির কাজ।
শব্দবাজি তৈরির উপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা উপেক্ষা করে গোপনে বেআইনি ভাবে বাজি তৈরি চলছে পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ার সাধুয়াপোতা, পশ্চিম চিল্কা, পুলশিটা ও কোলাঘাটের পয়াগের মতো গ্রামে।
বিপজ্জনক ভাবে বাজি তৈরি করতে গিয়ে এই সব গ্রামে দুর্ঘটনা ঘটেছে বারবার। গত ১৬ সেপ্টেম্বর পাঁশকুড়া থানার হাউর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার পুলশিটা গ্রামে বাড়ির মধ্যে শব্দবাজি তৈরির সময় বিস্ফোরণের ঘটনায় সোনালী মাজি নামে এক গৃহবধূ ও তাঁর দেওর স্বরূপ মাজির মৃত্যু হয়। জখম হয় দুই শিশু-সহ পরিবারের আরও পাঁচ সদস্য। তারপর গত মাসে পাঁশকুড়া থানার পুলিশ সাধুয়াপোতা ও পশ্চিম চিল্কা গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে হানা দিয়ে প্রায় এক হাজার কেজি শব্দ বাজি বাজেয়াপ্ত করে নষ্ট করেছিল। কোনও শিক্ষা না নিয়ে ফের বাজি তৈরির কাজ শুরু হয়েছে জোরকদমে।
পাঁশকুড়া থানার রাধাবল্লভচক গ্রাম পঞ্চায়েতের সাধুয়াপোতা গ্রামের ভক্তাপাড়া, সামন্তপাড়া, মাইতিপাড়া, পশ্চিম চিল্কা গ্রামের ঘোড়াই পাড়া, গাঁতাই পাড়া, পাত্র পাড়া ও হাউর পঞ্চায়েতের পুলশিটা গ্রামের মাজি পাড়ায় দীর্ঘদিন ধরেই বাজি তৈরির কাজ চলছে। কোলাঘাটের দেউলিয়া এলাকার পুলশিটা পঞ্চায়েতের পয়াগ গ্রামের মাইতি পাড়ায় বংশ পরম্পরায় অনেক পরিবার বাজি তৈরির পেশায় যুক্ত।
|
পয়াগ গ্রামে পিচ বোর্ডের খোল দিয়ে তৈরি হচ্ছে তুবড়ি। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস। |
মাইতি পাড়ায় গিয়ে দেখা গেল দু’বছর আগে রাধাকান্ত মাইতির বাড়িতে বিস্ফোরণের ছাপ এখনও স্পষ্ট। ওই বাড়িতেই বাজি তৈরির সময় বিস্ফোরণের ঘটনায় তিন জনের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় ভেঙে পড়া বাড়ির ছাদ, দেওয়াল এখনও বিধস্ত অবস্থায় একইভাবে পড়ে রয়েছে। পাড়ার মধ্যে ঢুকতেই বাসিন্দারা সন্ত্রস্ত হয়ে অনেকেই বাড়ির সামনে থেকে সরে যান। বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত ওই বাড়ির সামনেই একটি বাড়ির উঠোনে বসে রংমশালের কাগজের খোল বানাচ্ছিলেন প্রৌঢ় রমেশ মাইতি। কিছু বলার আগেই রমেশবাবু দাবি করেন, “আমরা এখন শুধু আতসবাজির খোল তৈরি করি।” পাড়ার অধিকাংশ বাসিন্দা যে এখনও বিভিন্ন ধরণের বাজি তৈরির সঙ্গে যুক্ত তা স্বীকার করে রমেশবাবু বলেন, “বংশ পরম্পরায় আমাদের পাড়ার বাসিন্দারা বাজি তৈরির কাজে যুক্ত রয়েছে। তবে আগের মত এখন আর শব্দ বাজি তৈরি হয় না।” রমেশবাবুর কথায়, “বাজি তৈরির কাজ করতে গিয়ে আমার নিজের ঠাকুরদার ছয় ভাই মারা গিয়েছেন। আর আমার নিজের ভাইপোও মারা গিয়েছে। প্রতি মুহূর্তে জীবনের ঝুঁকি রয়েছে এই কাজে। তা সত্ত্বেও কিছুটা নেশার মতো আমরা এই কাজ করে যাচ্ছি।”
ওই পাড়ারই বাসিন্দা মন্মথ মাইতির বাড়িতে কয়েক বছর আগে বাজি তৈরির সময় বিস্ফোরণে দোতলা পাকাবাড়ির ছাদ-সহ একাংশ ভেঙে পড়েছিল। সেই বিস্ফোরণে পরিবারের কয়েকজন আহত হয়। সেই বাড়িতেই এখনও বাজি তৈরির কাজ চলে। নিজের নাম জানাতে অনিচ্ছুক মন্মথবাবুর ছেলে বলেন, “এখন শুধু আতসবাজি তৈরির কাজ করা হয়। তাও বাড়ির মধ্যে নয়। বাড়ি থেকে দূরে আলাদা ঘরে বাজি তৈরির কাজ করা হয়।” বাজি তৈরি করতে গিয়ে বিস্ফোরণে পরিবারের লোকেদের প্রাণহানির ঘটনা সত্বেও এই পেশায় কেন? তিনি বলেন, “প্রতি মুহূর্তে জীবনের ঝুঁকি থাকায় এই কাজ করতে চাই না। বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা হলে এই কাজ ছেড়ে দেব।”
তবে আদালতের নির্দেশে কয়েক বছর আগে শব্দবাজি নিষিদ্ধ হয়েছে। তবুও পাঁশকুড়া ও কোলাঘাটের ওই সব গ্রামে লুকিয়ে বেআইনি শব্দবাজি তৈরির কাজ চলছে বলে অভিযোগ। এমনকী এখান থেকে অনেকে অন্যত্র গিয়ে বাজি তৈরির কাজও করেন। পাইকারি ব্যবসায়ীদের অর্ডার অনুযায়ী বিভিন্ন ধরণের বাজি তৈরি করে দেন এইসব বাজি কারিগররা। ব্যবসায়ীরা এই সব গ্রামে তৈরি বিভিন্ন আতস বাজির পাশাপাশি শব্দবাজিও এসে নিয়ে চলে যায়। আসলে অল্প খরচে তৈরি বাজির তুলনায় শব্দবাজি অনেক বেশি দামে বিক্রি হওয়ায় প্রচুর লাভ হয়। আর সেই কারণেই বাজি কারিগররা এই কাজ ছেড়ে দিতে চাননা।
বাজির কারিগররা জানান, আদালত ও পরিবেশ দফতরের নির্দেশে ৯০ ডেসিবেলের বেশি শব্দসীমার বাজি ফাটানো নিষিদ্ধ হয়েছে। ফলে এমনিতেই আগের চেয়ে বাজির চাহিদা অনেকটাই কমে গিয়েছে। তাই এখন সারা বছর ধরে বাজি তৈরির কাজ থাকে না। কালীপুজোর দু’-তিন মাস আগে থেকে আতসবাজি তৈরির কাজ চলে। ফলে জীবিকা হিসেবে এই পেশার উপর ভরসা করা যায় না। প্রতি বছর কালীপুজোর কিছুদিন আগে পুলিশ ওইসব গ্রামে হানা দিয়ে কিছু পরিমাণ শব্দবাজি বাজেয়াপ্ত করে দায় সারে। আর বাজি কারিগরদের বাড়িতে বিস্ফোরণের ঘটনাও চলতে থাকে। জেলা পুলিশ সুপার সুকেশ কুমার জৈন বলেন, “জেলার পাঁশকুড়া, কোলাঘাট, কাঁথির রামনগর নিষিদ্ধ শব্দবাজি তৈরির বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” |
|
|
|
|
|