নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
কারও উপরে রেগে গেলে মান্না দে প্রায়শই বলতেন, ‘আমিও সিমলের ছেলে, দেখে নেব!’ শেষযাত্রায় উত্তর কলকাতার সেই নিখাদ বাঙালিকে গোটা ভারতবর্ষ যেন ছুঁয়ে থাকল।
মান্না দে-র সঙ্গে সমার্থক চিরকেলে কাশ্মীরি টুপি তাঁর সঙ্গে ছিল না। কিন্তু কর্নাটকী কায়দায় চুড়ো করে ফুল সাজানো হয়েছিল ট্রাকের মাথায়। বৃহস্পতিবার বেলা ১০টা নাগাদ দীর্ঘ পাঁচ মাস বাদে বেঙ্গালুরুর হাসপাতালের আইসিইউ-তে বেরোনোর পরে ঈষৎ অন্য রকম দেখাচ্ছিল মান্না দে-কে। গোঁফ কামানো। চশমা নেই। বেঙ্গালুরুর সাংস্কৃতিক কেন্দ্র রবীন্দ্র কলাক্ষেত্রে এই মান্নাকে দেখতে জনতার ঢল নামল। সেই ভিড় চলল বেশ খানিকটা দূরের হেব্বাল শ্মশানে। মান্না চেয়েছিলেন, ওখানেই তাঁর শেষকৃত্য হোক। যেখানে, দেড় বছর আগে শিল্পীর স্ত্রী সুলোচনাকে দাহ করা হয়েছিল।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মান্নার দেহ কলকাতায় আনতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, মান্নার ভক্তদের জন্য কিছু ক্ষণ এ শহরে রেখে তা বেঙ্গালুরুতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। মান্নার ছোট মেয়ে সুমিতা ও জামাই জ্ঞানরঞ্জন দেব তাতে রাজি হননি। এই অপরাগতার জন্য বাংলা জুড়ে মান্নার অনুরাগী-ভক্তদের কাছে তাঁরা ক্ষমাও চেয়ে নেন। বিকেল পৌনে চারটে নাগাদ শেষকৃত্যের দৃশ্য ক্যালিফোর্নিয়ায় বসে ইন্টারনেটে স্কাইপে দেখেন, মান্নার বড় মেয়ে সুরমা। অসুস্থতার জন্য বাবাকে শেষ দেখা দেখতে যিনি আসতে পারলেন না। মান্নার শবদেহ ঘিরে ভিড়টা বলা বাহুল্য, কলকাতা হলে এর কয়েক গুণ বেশি হতো। তবু শিল্পী মান্না দে-র স্মরণে গোটা দেশ তথা সঙ্গীতের ভুবনই যেন সামিল হয়েছিল। সনিয়া গাঁধী, নরেন্দ্র মোদী, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তাঁর পূর্বসূরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও শোকবার্তা পাঠিয়েছেন। |
বাড়ির রকে খাঁটি বাঙালি। ফাইল চিত্র |
৯৪ বছরের দীর্ঘ সফল জীবনের শেষেও কত অতৃপ্তিই থেকে যায়। বেঙ্গালুরুর হাসপাতালের মুখপাত্র কে বাসুকি বলছিলেন, “অসুস্থতার প্রথম ধাক্কাটা যে-ভাবে সামলে নিয়েছিলেন, তাতে আমরা প্রায় বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম, এ যাত্রা মৃত্যু ওঁর সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে না।” ভেন্টিলেশন খুলে দেওয়া হল। মান্না উঠে বসলেন। কথা খুব বেশি বলতেন না। কিন্তু অজস্র গান শুনতেন। কেরলের উৎসব ওনামের সময়ে মালয়ালি ডাক্তারেরা এসে একবার মান্নার মালয়ালম ভাষার গান ওঁকে মনে করিয়ে দেওয়ায় শিল্পী খুব খুশি হয়েছিলেন। বাসুকির কথায়, “উনি হাসপাতালেও গানে বুঁদ হয়ে থাকতেন। আক্ষরিক অর্থেই সঙ্গীতময় একটা জীবন!”
মান্নার পরিবারের তরফে জানানো হয়েছে, দিন পনেরো আগে অবস্থা ফের খারাপ হতে শুরু করে। জামাই জ্ঞানরঞ্জন দেবের আফশোস, মঙ্গলবার সন্ধ্যাতে ডাক্তারেরা অ্যান্টিবায়োটিকের ‘কম্বিনেশন’ পাল্টে একটা শেষ চেষ্টা করেছিলেন। আশা ছিল, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একটা ইতিবাচক সাড়া মিলবে। কিন্তু বুধবার সন্ধ্যা থেকেই অবস্থা খারাপই হতে শুরু করে। ডাক্তারেরা পরিবারকে জানিয়েওছিলেন, সময় ঘনিয়ে আসছে। রাত তিনটে ৫০ মিনিটে শিল্পীর জীবনাবসানের মুহূর্তটিতে পাশেই ছিলেন ছোট মেয়ে সুমিতা দেব ও জামাই জ্ঞানরঞ্জন। হাসপাতালের বিবৃতি বলছে, সেপ্টিসেমিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হওয়াই শিল্পীর মৃত্যুর কারণ।
পাঁচ মাস আগে শ্বাসকষ্ট ও বুকে সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন শিল্পী। ক্রমশ কিডনির রোগের উপসর্গও দেখা দিতে থাকে। বছর দশেক আগে বেঙ্গালুরুর জীবন শুরু করার পরে চিকিৎসক দেবী শেঠির সঙ্গে হৃদ্যতার সুবাদে কোনও সমস্যায় তাঁর হাসপাতালেই যেতেন মান্না। বয়সের ভারটাও সেরে ওঠার পথে বড় বাধা ছিল মনে করেন ডাক্তাররা। তবু মান্নার অসম্ভব মনের জোরের কথা উঠে আসছে সবার মুখেই। ছ’দশকের সঙ্গিনী, স্ত্রী সুলোচনার চলে যাওয়াটাও সেই মনের জোরে চিড় ধরিয়েছিল বলে মনে করছেন অনেকেই।
মান্নার স্ত্রীর প্রসঙ্গের সূত্র ধরেই উঠে আসছে আরও একটি আফশোস। ৯৪ বছরে পৌঁছেও তাঁর শেষ অ্যালবাম রেকর্ড করার জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন শিল্পী। সুলোচনাকে মনে রেখেই যার নাম, ‘জানি, জানি আবার দেখা হবে’। সুলোচনার স্মৃতিতে চারটি গান ছাড়াও মান্না তাঁর গুরু তথা প্রিয় ‘বাবুকাকা’ কৃষ্ণচন্দ্র দে-র জন্যও একটা শ্রদ্ধার্ঘ সাজাতে চেয়েছিলেন। একদা কৃষ্ণচন্দ্রের গাওয়া রবীন্দ্রনাথের দু’টি গানও রেকর্ড করার কথা ছিল। ‘তোমরা যাওয়া বল তাই বলো’ আর ‘আনন্দ তুমি স্বামী’। মান্নার স্নেহভাজন, গীতিকার দেবপ্রসাদ চক্রবর্তী বলছিলেন, উনি নিজেই সুলোচনাদেবীকে ভেবে লেখা গানগুলোয় সুর দিয়েছিলেন। মিউজিক অ্যারেঞ্জার শান্তনু বসু বেঙ্গালুরুতে ওঁর কাছে ঘুরে যাওয়ার পরেই আমরা কাঁকুড়গাছির স্টুডিওতে গানের ট্র্যাক রেকর্ড করে ফেলি। এই তো এপ্রিলের মাসের ঘটনা! তখনও মান্নাদা দিব্যি সুস্থ। সারা ক্ষণ ফোনে আমাদের বকাবকি করে রেকর্ড করাচ্ছিলেন। দেবপ্রসাদবাবুর কথায়, “মান্নাদা, বার বার বলতেন এই অ্যালবামটা রেকর্ড না-করে আমি মরব না!”
মান্নার জন্মস্থান, উত্তর কলকাতার সিমলেপাড়াতেও বারবার ঘুরে-ফিরে আসছে শিল্পীর অদম্য প্রাণশক্তির কথা। কাছেই গোয়াবাগানে কুস্তিগির গোবর গোহের আখড়ায় তালিম নিতেন যুবক মান্না। অল বেঙ্গল চ্যাম্পিয়নশিপে একবার ফাইনাল অবধি গিয়েও স্বেচ্ছায় কুস্তি ছেড়ে দেন। মান্নার উল্টো দিকের বাড়ির এক প্রবীণ, অমিত দে বলছিলেন, পাড়ার দাদার কিশোর বয়সে নিয়মিত শরীরচর্চা করার কথা। “এক কালে কুস্তি লড়তেন বলেই শেষ বয়সেও মৃত্যুর সঙ্গে এ ভাবে পাঞ্জা লড়ে গেলেন!”
স্বামী বিবেকানন্দের বাড়ি থেকে কয়েক পা দূরে, নকুড়ের সন্দেশের দোকানের পিছনে ন’নম্বর মদন ঘোষ লেনে কৃষ্ণচন্দ্র দে ও মান্না দে-র বাড়ি। নকুড়ের দোকানের কর্তা প্রতীপ নন্দী বলছিলেন, ’৭০-এর দশকে পাশাপাশি ছাদে পঞ্চাশোর্ধ্ব মান্না দে-র সঙ্গে ঘুড়ির প্যাঁচ খেলার কথা। মুম্বইয়ের বান্দ্রায় মহম্মদ রফির সঙ্গে মান্না-র ঘুড়িযুদ্ধও অনেকেরই জানা। রফি নাকি ঘুড়ির লড়াইয়ে মান্নার সঙ্গে পারতেন না। প্রবীণ মান্না জনে জনে সগর্বে বলতেন, “পারবে কী করে! আমি যে সিমলের ছেলে!” |