প্লে-ব্যাকে জনপ্রিয় ধ্রুপদী
মিশেলের পথিকৃৎ তিনিই

চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি এক ঝাঁক রঙিন বেলুন উড়ে যাচ্ছে। পাড়ে আছড়ে পড়ছে আরব সাগরের ঢেউ। আকাশে-বাতাসে মিশে যাচ্ছে একটা গান...
‘জিন্দেগি ক্যায়সি হ্যায় পহেলি হায়
কভি তো হাসায়ে
কভি ইয়ে রুলায়ে...’

‘আনন্দ’ ছবিতে মান্না দে-র গাওয়া এই গানই যেন এই মুহূর্তে ঘুরেফিরে আসছে তাঁর হাজারো রঙে রঙিন জীবনের স্মৃতি হয়ে। বেঙ্গালুরুতে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হলেও মুম্বইবাসীর কাছে, বলিউডের কাছে মান্না দে-র চলে যাওয়া মানে ওই এক ঝাঁক রঙিন বেলুনের উড়তে উড়তে বহু দূরে মিলিয়ে যাওয়া। আজকাল যখনই মান্নাদার কথা ভেবেছি, তখনই মনে হয়েছে, এত না ভুগে, এত পারিবারিক ঝুটঝামেলায় না জড়িয়ে ওঁর জীবনের শেষ দিনগুলো যদি দূর আকাশে মিলিয়ে যাওয়া ওই রঙিন বেলুনগুলোর মতোই অদৃশ্য হয়ে যেত, তা হলে বেশ হত। কিন্তু সেটা তো হল না।
হল না বলেই আবারও গেয়ে উঠতে ইচ্ছে করে গানটা...‘জিন্দেগি ক্যায়সি হ্যায় পহেলি হায়/ কভি তো হাসায়ে/ কভি ইয়ে রুলায়ে...’
জীবন তো এই রকমই...
ওঁর সঙ্গে সরাসরি আলাপ হয়নি কোনও দিন। যখন অসুস্থ ছিলেন, এক বার ফোন করেছিলাম। ওঁর আরোগ্য কামনা করে। জীবনে তিন বার মাত্র কনসার্টে শুনেছি ওঁর গান। বাদবাকি সবটাই সিডি বা ক্যাসেটে। লখনউয়ে মামার বাড়িতে খুব শোনা হত মান্নাদার গান। কখনও ‘পুছো না ক্যায়সে’, কখনও ‘হয়তো তোমারই জন্য’, কখনও বা ‘ফুল গেঁন্দওয়া না মারো’। বাঙালির কাছে একটা সময় রবিবার মানে ছিল ড্রইংরুমে মান্নাদার গান, আর রান্নাঘরে মাংস রান্না হওয়ার গন্ধ।

‘আনন্দ’-এর সেই বিখ্যাত গান ‘জিন্দেগি’র দৃশ্য
কিন্তু যে মানুষটি এতগুলো ভারতীয় ভাষায় গান গেয়েছেন, তাঁকে শুধু বাঙালিয়ানায় বেঁধে রাখা যায় না। আমার মনে হয়, প্লে-ব্যাকে ধ্রুপদী ঘরানা খুব সহজ-সরল ভাবে, খেলাচ্ছলে মিশিয়ে দেওয়ার পথিকৃৎ তিনিই। একের পর এক কঠিন গান এত সহজ ভাবে গেয়েছেন যে, রাগাশ্রয়ী জেনেও সাধারণ শ্রোতা সে গান গুনগুন করার চেষ্টা করেছেন। এটাই মান্না দে-র উত্তরাধিকারের প্রথম কথা। আজও অনেক সময় গানের মধ্যে ক্লাসিক্যাল ছোঁয়া দেওয়া হয় যখন, তখন মান্নাদার ঘরানার কথাই মনে করা হয়। মহম্মদ রফি অনেক বড় শিল্পী। তাঁর গান ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু তাঁর পাশেও মান্না দে ছিলেন। কারণ একটাই। মার্গসঙ্গীতের সহজ-সরল উপস্থাপনা। ধ্রুপদী ঘরানা ধরে রেখেই অবলীলায় কখনও কমেডি গান, কখনও রোম্যান্টিক গান, কখনও বা ভক্তির গান গেয়েছেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতেও যে সুরের এত রূপ হতে পারে, সেটা চলচ্চিত্র দুনিয়াকে শিখিয়ে গিয়েছেন মান্নাদা। ‘লগা চুনরি মে দাগ’, ‘লপট ঝপট’, ‘ফুল গেঁন্দওয়া না মারো’র মতো মুরকি দেওয়া গান সত্যি অনুকরণ করা খুবই কঠিন। আবার ‘পড়োসন’-এ তাঁর সেমি-ক্ল্যাসিক্যালের অসাধারণ রসিক ব্যবহার যুগযুগ ধরে মানুষের মনে থাকবে।
আমার মতে শিল্পীরা হন দু’ধরনের। এক দল জনপ্রিয় শিল্পী। আর এক দল শিল্পীদের মধ্যে সেরা শিল্পী। উনি ছিলেন দ্বিতীয় দলে। ওঁর জীবনকে যতটা জেনেছি, তাতে বুঝেছি, কোনও সময়ে প্রতিযোগিতায় বিশ্বাস করতেন না। কখনও নায়কের মুখের গান না পেলেও অন্য শিল্পীদের দেখিয়ে বলতেন, “ইস্ ওঁর মতো যদি গাইতে পারতাম!’’ এই ‘ওঁর’দের দলে রফি, কিশোরকুমার, মুকেশ, সবাই ছিলেন যাঁদের মান্নাদা শ্রদ্ধা করতেন। হিন্দি প্লে-ব্যাকের জগতে একটা সোনালি চতুষ্কোণ ছিল এক সময়। এক কোণ রফিজি, এক কোণ কিশোরজি, তৃতীয় কোণ মুকেশজি, আর চতুর্থ কোণ আমাদের প্রিয় মান্নাদা। মান্নাদার চলে যাওয়া মানে এক সুবর্ণযুগের সাক্ষীর সময়ের স্রোতে মিলিয়ে যাওয়া।
কেউ কেউ বলতে পারেন হয়তো যে, আজ চুরানব্বই বছর বয়সে ওঁর চলে যাওয়ার পর নতুন কী লেখার আছে! এটা সত্যি, নব্বইয়ের দশক থেকেই সিনেমার গানের জগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন মান্নাদা। কিন্তু সেটাই তো সব নয়। উনি তো এত দিন ছিলেন, সে যে ভাবেই থাকুন না কেন, আমাদেরই মধ্যে এক জন হয়ে ছিলেন। নতুন নতুন গান গাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। এই স্বপ্ন দেখাটাই তো বেঁচে থাকা! ভারতীয় গানের চর্চা যত দিন থাকবে, তত দিন বাঁচবে মান্নাদার স্টাইল। তাঁর আধুনিক গানে ধ্রুপদীর ওই অতুলনীয় ব্যবহারের উপমা তিনি নিজেই। ধ্রুপদী গানের শিল্পটাকে কী ভাবে জনপ্রিয় গানে সঞ্চার করতে হয়, তাঁর অনবদ্য দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে আছে তাঁর অজস্র গানে। নতুন প্রজন্মকে সেই সব মণিমুক্তো ছড়ানো গান বারবার শুনে কণ্ঠে তুলে নিতে হবে। সমস্ত ভারতীয় উঠতি পপ-সিঙ্গারদের কাছে তিনি গুরু হয়ে থাকবেন। আমাদের আর্কাইভ তৈরি করার সংস্কৃতি নেই। তাই শিক্ষার্থীকে ওঁর গান বারবার শুনতে হবে নিজের উদ্যোগে।
আরও একটা কথা। মান্নাদা নিয়মিত শরীরচর্চা করতেন। ওঁর গানেও তার প্রভাব ছিল। অনেকক্ষণ দম ধরে রেখে সুর ছাড়তে পারতেন। গানবাজনা করতে গেলে শরীরচর্চারও যে প্রয়োজন আছে, সেটা ওঁর কাছ থেকে শিখবে নতুন যুগের শিল্পীরা। শিখবে ওঁর দুর্দান্ত লয়জ্ঞান, পেসিং। কোথায় সুর ছাড়তে হবে, কোথায় ধরতে হবে, কোথায় শ্বাস নিতে হবে, তার অনবদ্য কৌশল লুকিয়ে আছে মান্নাদার বহু গানে। এখন তো গান শোনার সুবিধে হয়ে গিয়েছে। নতুন যুগের উদীয়মান শিল্পীরা ডাউনলোড করে যত পারুন ওঁর গান শুনুন। মান্নাদার অনেক গানে পাশ্চাত্য সুরের ব্যবহার আছে। আজকের এই ফিউশনের যুগে সেটাও শিক্ষণীয়।
শেষমেশ নিজের কথা একটু না বলে পারছি না। প্রদীপ সরকারের ছবি ‘লগা চুনরি মে দাগ’ ছবিতে এক বার ভেবেছিলেম মান্নাদার ‘চুনরি মে দাগ’ গানটা অন্য কাউকে দিয়ে গাইয়ে ব্যবহার করব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা করার সাহস পাইনি। ফলে সুর পাল্টে কথা ঠিক রেখে অন্য ভাবে গানটাকে বেঁধেছিলাম। গেয়েছিলেন শুভা মুদগল এবং মিতা বশিষ্ঠ। গানটা কম্পোজ করার সময় শুভাজির সঙ্গে প্রচুর আলোচনা হত। বিষয় থাকত একটাই, মান্নাদার গাওয়া গানের সুরটাই রাখব কি না। আমার প্রথম ভিডিও অ্যালবামে ‘শিখো না নয়নো কি ভাষা’ বলে একটা গান ছিল, আমি যার সুর করেছিলাম মান্না দে-র গায়নশৈলী মনে রেখেই। কিন্তু ওঁকে দিয়ে গাওয়ানো সম্ভব ছিল না। চেষ্টাও করিনি। গেয়েছিলেন শুভা মুদগল। ‘খোয়া খোয়া চাঁদ’ ছবিতে ‘ওরে পাখি’ গানটাও কম্পোজ করেছিলাম মান্না-ঘরানার গায়কী মনে রেখে। আর সেই ঘরানা মেনে গানটা খুব ভাল উতরে দিয়েছিল সোনু নিগম।
‘অন্তহীন’-এ আমার সুরের গানগুলো সম্ভবত মান্নাদা শুনেছিলেন। মনে হয় ওঁর খুব ভালও লেগেছিল। যখন অনেকেই এ ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার পেলেন এবং আমি পেলাম না তখন কাগজে বলেছিলেন, “অন্তহীনের গানের জন্য শান্তনুর পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল।” ওঁর যে আমার কথা মনে পড়েছিল এতেই আমি কৃতজ্ঞ।
এখন ক’দিন মান্নাদাকে নিয়ে প্রচুর স্মৃতিচারণ ও অনুষ্ঠান হবে। আর তার পরে সব থেমেও যাবে।
এটাই কালের নিয়ম।
কিন্তু আমি চাইব মান্নাদাকে নিয়ে আলোচনা থেমে গেলেও ওঁর গান শোনার অভ্যেস যেন আমাদের ছেড়ে না যায়।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.