মান্নাদার সঙ্গে আমার আলাপ বম্বেতে। সেটা ’৫০-’৫১ সাল। এখন ভাবলে মনে হয়, সত্যিই কী আশ্চর্য! আমরা দু’জনেই কলকাতার শিল্পী, অথচ আমাদের আলাপ হল গিয়ে ওই অত দূরে!
আসলে আমাকে তখন শচীনদা (শচীনদেব বর্মন) নিয়ে গেছেন বম্বেতে। সেই সময়ে আমি থাকতাম খারের কাছে হোটেল ‘এভারগ্রিন’-এ। আর সেই হোটেলেরই দোতলায় থাকতেন শচীনদা। মান্নাদা আসতেন শচীনদার সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু দোতলায় যে ঘরে শচীনদা থাকতেন সেখানে উঠতে গেলে আমার ঘরের পাশ দিয়ে যেতেই হত। আর সকালের দিকে যখন আমি রেওয়াজ করতাম, উনি শুনে মনে রাখতেন কী গাইছি, কোন রাগ। পরে সেটা নিয়ে আমাকে বলতেন। গান ছাড়াও নানা বিষয় নিয়ে রসিকতা করতেন।
এমনিতে বম্বে আমার ভাল লাগেনি ঠিকই, কোনও দিনই ভাল লাগেনি। কিন্তু শচীনদা ও মান্নাদার সেই সময়ের কথা আজও আমার মনে অমর হয়ে রয়েছে।
আজ সত্যিই ভারতীয় সঙ্গীত জগতের এক মহীরুহ চলে গেলেন। একটা খুব অমূল্য সময়ের যিনি সাক্ষী।
যদিও জীবন হিসেবে দেখতে গেলে, বয়স হয়েছিল তাঁর। তা ছাড়া বৌদি মানে ওঁর স্ত্রী সুলোচনার চলে যাওয়া, আর বড় মেয়ে, যিনি লস অ্যাঞ্জেলেসে থাকেন, তাঁর দুরারোগ্য ক্যানসার খুব চিন্তায় রাখত মান্নাদাকে। ফোনে কথা হলে সেই সব প্রসঙ্গ উঠত। বিষণ্ণ হয়ে পড়তেন। গলার আওয়াজেই বুঝতে পারতাম সে কথা।
হাসপাতালে যাওয়ার দেড় মাস আগেই কথা হয়েছে। উনি নিজেও শারীরিক ভাবে খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। মনে পড়ছে, আমার স্বামী মারা যাওয়ার সময়ে উনি যেমন ফোন করেছিলেন আমাকে, তেমনই ওঁর স্ত্রীর মৃত্যুতেও আমি ফোন করি। পরস্পর পরস্পরের বেদনায় কান্নাকাটিও করি। এত স্মৃতি তো ভোলার নয়! |
‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’র সেই জুটি। — আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে। |
আজ আরেকটা কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। নিউ থিয়েটার্সের সেই রেকর্ডিং-এর সময়ের কথা। বেশ মজারই ব্যাপার। ‘চম্পা চামেলি গোলাপেরই বাগে’র রেকর্ডিং হবে। সুরকার উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের পুরোধা অনিল বাগচী, রেকর্ডিস্ট শ্যামসুন্দর ঘোষ। তো অনিলদা ফাইনাল স্বরলিপি দেওয়ার পরেও বারবার নানা রকম অলংকার দিচ্ছেন সুর নিয়ে। সুরে বারবার নানা বৈচিত্র আনছেন। আর মান্নাদা সবে সবে অনিলদার সুরে গাইছেন। আর উনি তো শর্টহ্যান্ডে নোটেশন নিতেন। আমাকে বললেন, “কী করি বলুন তো...এত বার নোটেশন পাল্টাচ্ছেন...”।
এখানে একটা কথা বলে রাখি, আমার থেকে বারো বছরের বড় হলেও আমাকে ‘সন্ধ্যাদি’ আর ‘আপনি’ বলেই সম্বোধন করতেন। তো আমি পরামর্শ দিলাম— “অনিলদা যখন যেমন সুর বলছেন, আপনি সেইটা গেয়ে দেখান। ফাইনাল রেকর্ডিং-এ কিন্তু ওই প্রথমটাই গাইবেন।” খুব স্বস্তি পেলেন যেন! স্বস্তি পাওয়ার পরে আবার ফিরে গেলেন নিজের পরিচিত রসিকতায়। খুব রসিক ছিলেন তো। আর খুব প্রাণবন্ত। লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতেন। এটা আমি বলছি ২০০৮-এর কথা। আমরা সায়েন্স সিটিতে শেষ বারের মতো অনুষ্ঠান করি। তখনই সামনাসামনি শেষ বারের মতো কথা হয়। সেই সময় রিহার্সালের জন্য মান্নাদা আসেন আমার এই লেক গার্ডেন্সের বাড়িতে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠেন লাফিয়ে লাফিয়ে। বললাম, শ্বাসকষ্ট হবে যে!
আসলে আমার আর মান্নাদার স্বভাবে একটা স্বাভাবিক বৈপরীত্য আছে। উনি স্বভাব-প্রাণবন্ত আর আমি স্বভাব-লাজুক। আমার সঙ্গে দেখা হলেই বলতেন, “ওই সন্ধ্যার টেনশন শুরু হল!”
এখন মনে হচ্ছে নিজের জীবনের সব টেনশন কাটিয়ে দিয়ে উনি যেন নিজের জগতে চলে গেলেন।
ওঁর প্রতিভা নিয়ে কথা বলার মতো ক্ষমতা আমার নেই। তবুও এই মুহূর্তে যে ক’টা গানের কথা মনে পড়ছে বলি। ‘যখন কেউ আমাকে পাগল বলে’, কিংবা, ‘আমি নিরালায় বসে বেঁধেছি আমার স্মরণবীণ’, কিংবা ‘ও আমার মন-যমুনার অঙ্গে অঙ্গে’, অথবা ‘বসন্ত বাহার’ ছবিতে ভীমসেন জোশীজির সঙ্গে ডুয়েট, কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি।
তবে আহির ভৈরোঁ রাগে ‘পুছো না ক্যায়সে ম্যায়নে রয়েন বিতায়ি’ বোধহয় চিরকালীন হয়ে থাকবে।
এক বার আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, “মান্নাদা, আপনার খারাপ লাগে না, রাজ কপূর থেকে উত্তমকুমার— বেশির ভাগ সময়ে নায়কদের লিপে নিয়মিত না থেকে অন্য ধরনের গানই বেশি গাইলেন সারা জীবনে?”
বলতেন, “কোনও দিন মনে হয়নি সন্ধ্যাদি।’’ আসলে মান্নাদা গানকে গান হিসেবেই নিতেন। এত ভার্সেটাইল, এত জ্ঞান— কল্পনাতীত। ভীমসেন জোশীজির সঙ্গে ডুয়েটে তানগুলো পর্যন্ত কী হেলায় গেয়ে দিতেন!
যদিও এক সাক্ষাৎকারে উনি বলেছিলেন, উত্তমকুমারের মুখে গেয়েছি বলেই আমি আজ এত জনপ্রিয়। কী জানি, কী ভেবে উনি এ কথা বলেছিলেন। আমার কিন্তু মনে হয়, উত্তম-সুচিত্রা জুটির গানে যখন হেমন্তদার পরে মান্নাদা এলেন ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’তে এবং তারও পরে ‘চিরদিনের’ গাইলাম আমরা, ‘আমায় চিরদিনের সেই গান বলে দাও’, তখন যেন আর একটা ধরনের প্রেমের গান শুরু হল।
অবশ্য হেমন্তদা-মান্নাদা কিংবা রফিজি-মান্নাদা এই ভাবে তুলনা আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়, তবু বলব, হেমন্তদা ছিলেন রোম্যান্সের রাজা, সম্রাট। আর মান্নাদা সুরের সাগর। উচ্চাঙ্গসঙ্গীত থেকে শ্যামাসঙ্গীত থেকে রোম্যান্টিক থেকে নজরুলগীতি থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে আধুনিক— এমন সাবলীল অনায়াস গায়কি বিরল।
আজ মনে হচ্ছে জীবনের ‘জলসাঘর’ থেকে হয়তো তিনি বিদায় নিলেন, কিন্তু ভারতীয় সঙ্গীতের ‘জলসাঘর’ চিরকালই অমর হয়ে থাকবে তাঁর অনন্য হীরকদ্যুতির মতো প্রতিভায়।
|