শতায়ু হতে চেয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, “একশো বছর বেঁচে থেকে গান গাইতে চাই।” হল না। ৯৪’তে চলে গেলেন বাংলা গানের লাস্ট লিয়র। বয়সের নিরিখে এ হয়তো অকালবিদায় নয়, কিন্তু তাঁর চলে যাওয়া, আক্ষরিক অর্থে, এক শূন্যতা তৈরি করল ভারতীয় সঙ্গীতে। কারণ ধ্রুপদী গানের শিল্পী না হয়েও আসমুদ্রহিমাচল ছাড়িয়ে বিদেশেও তাঁর নামের বিস্তার। আর কোনও বাঙালি শিল্পীর ক্ষেত্রে এমনটি সুলভ নয়। সে দিক থেকে মান্না দে-র মৃত্যু এক অনন্য প্রতিভার অবসান।
বাংলা, হিন্দি তো আছেই। তা ছাড়াও প্রায় সব প্রধান ভারতীয় ভাষায় গান গেয়েছেন তিনি। তামিল-মালয়ালি-ভোজপুরি-কোঙ্কনি, কী নেই তাঁর গাওয়া তিন হাজার গানের তালিকায়! আর সেই বিস্তারের জোরেই বোধ হয় ঘনিষ্ঠ মহলে রসিকতা করে বলতে পারতেন, ‘আমার সৌভাগ্য, ধানবাদের ও পারেও লোকে আমাকে চেনে। আমার গান জানে।’ এই উক্তি নিছক অহমিকা ভাবলে হয়তো অবিচার হবে।
কিন্তু মান্না দে যতটা বাঙালি শিল্পী, ততটাই কি বাংলার? এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই সম্ভবত রয়ে গিয়েছে ভারতীয় সংগীতের ইতিহাসে মান্না দে-র যাত্রাপথটি, যে পথে অনেক সাফল্য, কিছু ব্যর্থতাও। ১ মে ১৯১৯, উত্তর কলকাতার ন’নম্বর মদন ঘোষ লেনে পূর্ণচন্দ্র দে এবং মহামায়া দেবীর সংসারে শুরু সেই জীবনযাত্রার। উত্তর কলকাতার সব বৈশিষ্ট্য নিয়ে বড় হচ্ছিলেন ‘প্রবোধচন্দ্র’। গোবর গোহের আখড়ায় কুস্তিচর্চা, স্কটিশ চার্চ কলেজের ক্যান্টিনে টেবিল বাজিয়ে গান, জীবন কাটছিল এই ভাবেই। তার পরে এক দিন প্রবোধচন্দ্র হারিয়ে গেলেন স্কটিশ চার্চ স্কুল ও কলেজের কাগুজে খাতায়। রয়ে গেল ডাকনাম মানা থেকে হয়ে ওঠা ‘মান্না’। সে নামই রয়ে গেল অগণিত সঙ্গীতপ্রেমীর হৃদয়ে। |
কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে-র ছায়ায় বেড়ে উঠলেও মান্নার গাইয়ে হওয়ার স্বপ্ন ছিল না। গান বলতে অফ পিরিয়ডে টেবিল বাজিয়ে শচীনকর্তা, কানাকেষ্টর গান গাওয়া। সেই আসরের সঙ্গীরাই এক দিন এক সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়েছিলেন তাঁর, সেই সূত্রেই কাকার কাছে গান শেখা এবং নানা বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন। সেই প্রথম স্থানটা বলিউডের বড় যুদ্ধক্ষেত্রে সব সময় বজায় থাকেনি। কৃষ্ণচন্দ্র দে-র সহকারী হিসেবে শুরু হয়েছিল সদ্য কুড়ি পেরোনো মান্না দে-র যাত্রা। ‘তমান্না’ ছবিতে সুরাইয়ার সঙ্গে ডুয়েট এবং শঙ্কর রাও ব্যাসের সুরে ‘রামরাজ্য’ ছবিতে একক কণ্ঠে প্রথম প্লেব্যাক ভরসা জোগাল না তেমন। কিন্তু কাকার সঙ্গে বাংলায় ফিরলেন না মান্না, জড়িয়ে রইলেন বলিউড-বৃত্তে। সে থাকা সার্থক হল ১৯৫০-এ, শচীন দেববর্মনের সুরে ‘মশাল’ ছবিতে গাইলেন ‘উপর গগন বিশাল’। এই গানটিই যেন তাঁর গতিপথ নির্ধারণ করে দিল।
পুরুষালি নায়কোচিত কণ্ঠ বলতে তখন যা বোঝাত, সেটা তাঁর ছিল না। সেই বৈশিষ্ট্যের জন্যই হয়তো নায়কের গানের জন্য বিশেষ ডাক পাননি তিনি। সে দিনের রফি, মুকেশ, হেমন্তকুমার, তালাত মাহমুদ, কিশোরের দাপুটে প্লে-ব্যাক বৃত্তে নায়ক বা প্রধান চরিত্রের লিপে বড় একটা জায়গা হয়নি তাঁর। প্রধানত পৌরাণিক-ধর্মমূলক ছবিতেই ডাক পেতেন। তবে শঙ্কর জয়কিষণ, শচীন দেববর্মন, সলিল চৌধুরী এবং উত্তরকালে রাহুল দেববর্মনের মতো সঙ্গীত পরিচালক মান্নার গায়কী বুঝে তাঁর কণ্ঠে তুলে দিয়েছেন কিছু উল্লেখযোগ্য চিত্রগীতি। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েই বলিউডে নিজের নাম লিখেছেন মান্না।
আওয়ারা, পরিণীতা, দো বিঘা জমিন পেরিয়ে শ্রী ৪২০ ছবিতে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তিনি। ‘আনন্দ’ ছবির ‘জিন্দেগি ক্যায়সি হ্যায় পহেলি’ রেকর্ড গড়েছে। শোলে, পড়োশন, জঞ্জীর-এর মতো ছবিতে এমনকী কিশোরকুমারের সঙ্গেও পাল্লা দিয়ে জনপ্রিয় হয়েছেন মান্না। তবু প্লে-ব্যাক গাইয়েদের প্রথম সারিতে কোনও দিনই আসতে পারেননি। ধ্রুপদ-ধামার থেকে ভজন কীর্তন পর্যন্ত নানা ধারার তালিমে সমৃদ্ধ মান্না রাগাশ্রয়ী গানের ক্ষেত্রে সঙ্গীত পরিচালকদের কাছে নির্ভরযোগ্য ছিলেন। আর সেই নির্ভরতার জায়গাতেই নায়কের লিপে বেশি গান না পেলেও তাঁকে মুম্বইয়ে থেকে যেতে হয়েছে তাঁর সংগীতজীবনের সেরা সময়টা। প্রধানত বলরাজ সাহনি-মেহমুদ-প্রাণ এর মতো অভিনেতার জন্যই তাঁকে প্লে-ব্যাক করতে হয়েছে। হীরকখণ্ডের মতো এক একটি কম্পোজিশনে প্রাণ দিয়েছে মান্নার কণ্ঠ, শিল্পী হিসেবে তাঁর জাত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বার বার। মুম্বইয়ে চল্লিশ বছরের প্লে-ব্যাক কেরিয়ারে মান্না দের গানের সংখ্যা তাই তিনশোর কম, অর্থাৎ গড়ে বছরে সাত-আটটি। মুম্বই তাঁকে যতটা ‘সমীহ’ বা ‘গুরুত্ব’ দিয়েছে ততটা সুযোগ দেয়নি। অথচ এই অবকাশেই তিনি ধ্রুপদী শিক্ষায় পারদর্শী বহুমুখী শিল্পী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। কিছুটা মুম্বইয়ে প্রত্যাশা মতো গুরুত্ব না পাওয়ার কারণেই সম্ভবত পুরোপুরি বাংলা গানে ফিরতে চেয়েছিলেন তিনি। মুম্বইয়ে থাকার সময়েও বাংলা গান গেয়েছেন। অবশ্য তা অনেকটা অতিথি শিল্পীর মতো। ১৯৫৩-য় তাঁর প্রথম বাংলা বেসিক গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। তার পরে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে বাংলা বেসিক গানে ধারাবাহিক ভাবে সামর্থ্য বিনিয়োগ করে গেলেও অতিথি হয়েই রইলেন তিনি, বাংলার শিল্পীর দৈনন্দিন সংগীতযাত্রার অংশীদার হয়ে উঠতে পারেননি। হয়তো চেয়েছিলেন সেটা, তাই তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের কাছে পাকাপাকি ভাবে বাংলায় থেকে কৃষ্ণচন্দ্র দে-র নামে সঙ্গীত অ্যাকাডেমি গড়বেন বলে জমি চেয়েছিলেন। যে ভাবে সেই পরিকল্পনা করেছিলেন সে ভাবে জমি পাননি, ফলে অভিমান নিয়ে ফিরে গিয়েছেন। মুম্বই থেকে সরে থাকা এবং কলকাতায় পাকাপাকি ভাবে ফিরতে না পারার অভিমানই হয়তো তাঁকে বেঙ্গালুরুতে ঠেলে দেয়। সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে এ তাঁর এক রকম স্বেচ্ছানির্বাসনই। তবে সংগীতজীবনের শেষ কিছু কাল ধরে বেঙ্গালুরু-প্রবাসী মান্না দে আক্ষরিক অর্থে শুধু কলকাতার বা বাংলার শিল্পী হয়েই ছিলেন। গানের সূত্রেই যোগাযোগ ছিল কলকাতার সঙ্গে, মুম্বইয়ের সঙ্গে যে যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
শুধু বাংলায় পাকাপাকি থাকার ক্ষেত্রে নয়, বাংলা গানেও তাঁর প্রবেশটা খুব মসৃণ হয়নি। প্রেমে-ফুটবলে-বিরহে-কফিহাউসে যে মান্না দে বাঙালির প্রাণের শিল্পী তাঁকেও বাংলা গানে প্রথম কণ্ঠ দিতে হয়েছিল অন্য এক শিল্পীর প্রত্যাখানের সূত্র ধরে। ডাবল ভার্শন ‘অমর ভূপালী’ ছবিতে বসন্ত দেশাইয়ের সুরে মান্না দের প্রথম বাংলা ছবির গান ‘ঘনশ্যাম সুন্দর’। ‘একদিন রাত্রে’ ছবির ‘এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়’ তাঁর প্রথম ব্রেক। এর পরেই ডাকহরকরা ছবির ‘তোমার শেষ বিচারের আশায়’ বাংলা সিনেমায় মান্না দের আগমনী ঘোষণা করেছিল। তারও আট বছর পরে উত্তমকুমারের লিপে ‘শঙ্খবেলা’ ছবির ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’ এবং ‘আমি আগন্তুক’ তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিল। ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ পাকা জমিতে বসিয়ে দিল উত্তম-মান্না জুটিকে। চৌরঙ্গী, বিলম্বিত লয়, নিশিপদ্ম, ছদ্মবেশী থেকে স্ত্রী-মৌচাক-সন্ন্যাসী রাজা বাংলা সিনেমার গানে তৈরি করে দিল মান্না-যুগ।
আর বেসিক গান? ‘ও আমার মনযমুনার অঙ্গে অঙ্গে’ কিংবা ‘এই কূলে আমি’র যুগ পেরিয়ে ‘সে আমার ছোট বোন’, ‘কফি হাউস’ বা ‘ফুটবল খেলা’ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর কণ্ঠ আবেগময় বঙ্গজীবনের অঙ্গ হয়ে উঠল। আজও মান্না দে-র কণ্ঠে এ সব গান বেজে ওঠে মোবাইলের কলার টিউনে। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার বা শ্যামল গুপ্তের মতো গীতিকারের গান মান্না দে গেয়েছেন, কিন্তু তাঁদের সেরা সময়ের সঙ্গে তাঁর সংযোগ হয়নি। পরে সুধীন দাশগুপ্ত তাঁর জন্য কিছু উল্লেখযোগ্য লিরিক লিখেছেন। তারও পরে প্রধানত পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লিরিকই ছিল তাঁর সামনে।
অনেকের মতে, শেষ বয়সে মান্না দে অতি অকিঞ্চিৎকর গানও রেকর্ড করতে দ্বিধা করতেন না। এতে তিনি তাঁর কণ্ঠসামর্থ্যের অপচয় করেছেন। কিন্তু পরিস্থিতি বিচার করলে এ অভিযোগ তাঁর প্রতি অবিচার বলেই মনে হবে। গানেই তিনি জীবনযাপন করতেন। রোজ গান নিয়ে বসেন কি না, সে প্রশ্নের উত্তরে এক বার এক সাংবাদিককে বলেছিলেন, “গান নিয়ে কেন, গানেই তো বসে আছি।” স্ত্রী সুলোচনার মৃত্যুতে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেছিলেন গানকেই। এ হেন মানুষ ‘ভাল’ গান নেই বলে থেমে যেতে পারেন কি? সময় তাঁকে যা দিয়েছে তাই গেয়েছেন। কিন্তু যা পেয়েছিলেন, তবু গাননি? অনেকের আক্ষেপ, ‘মেঘ ও রৌদ্র’ ছবিতে এমন স্মরণীয় গায়কীতে ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’ গেয়েছিলেন যিনি, তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত সে ভাবে রেকর্ড করলেন না কেন? তার কারণ হিসেবে ঘনিষ্ঠমহলে শিল্পী বলতেন, রবীন্দ্রসংগীত গাইতে তাঁর ভয় করে! বিদ্রোহের গান, গণনাট্যের গানও সে ভাবে গাননি। তবু স্ত্রীর স্মৃতিতে শেষ যে অ্যালবামের পরিকল্পনা করেছিলেন সেখানেও দু’টি রবীন্দ্রসঙ্গীত ছিল। ‘আনন্দ তুমি স্বামী’ আর ‘তোমরা যা বল তাই বল’।
জীবনের একেবারে শেষে এসেও নতুন গান রেকর্ড করে অ্যালবামের কথা ভাবতে পারতেন ফালকে সম্মানজয়ী মান্না দে। এই সাঙ্গীতিক জীবনীশক্তিই আজও তাঁকে নতুন প্রজন্মের বহু শিল্পীর কাছে আইকন করে রেখেছে।
সে ‘আইকন’ পুরোপুরি বাংলার না হোক, আপ্রাণ বাঙালির। বৃহৎ বাঙালির, সেটাই বাঙালির গর্ব। |