দেবাশিস ভট্টাচার্য • দার্জিলিং |
মৃত্যুশোক ছাপিয়ে প্রকট হয়ে উঠল মান্না দে-র মরদেহ নিয়ে বিতর্ক!
বৃহস্পতিবার ভোররাতে বেঙ্গালুরুর হাসপাতালে মান্না দে-র মৃত্যুর খবর মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দ্রুতই পৌঁছেছিল। শোনামাত্র দার্জিলিংয়ে বসেই শিল্পীর মরদেহ কলকাতায় আনার ব্যাপারে উদ্যোগী হন মমতা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শিল্পীর পরিবারের সম্মতি না মেলায় সেটা পারা যায়নি। মর্মাহত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “মান্না দে বাঙালির হৃদয়ের শিল্পী। তিনি আজ শুধু একটি পরিবারের পরিচয়েই সীমাবদ্ধ নেই। তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে না পারার এই দুঃখ ভোলার নয়।”
মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বৃহস্পতিবার দুপুর বেলায় বেঙ্গালুরুতেই মান্না দে-র শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়ে যায়। এ রাজ্যের সরকারি মহলে তা নিয়ে ক্ষোভ স্পষ্ট। এক সরকারি মুখপাত্র সখেদে বলেন, কলকাতায় দেহ আনা তো গেলই না! রাজ্য সরকারের তরফে কোনও মন্ত্রী বেঙ্গালুরুতে গিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর সময়টুকুও পেলেন না।
কেন রাজ্য সরকারের প্রস্তাবে রাজি হল না শিল্পীর পরিবার? শিল্পীর ছোট মেয়ে সুমিতা এ প্রসঙ্গে বলেন, “আমি (মুখ্যমন্ত্রীর) অনুরোধ ফেরাইনি। বলেছিলাম, আমাকে ভাবার জন্য একটু সময় দিন।...মুখ্যমন্ত্রী এমন একটা সময়ে মৃতদেহ কলকাতায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, যখন আমি বেঙ্গালুরুতে সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি।” সময়াভাবই কি তবে মরদেহ পাঠাতে একমাত্র কারণ বলে দাবি করছেন মান্নার কন্যা? তাঁর সামগ্রিক বক্তব্যে কিন্তু রাজ্য সরকারের প্রতি অন্য ক্ষোভ এবং অভিযোগও প্রকাশ পেয়েছে। |
শেষ শ্রদ্ধা। দার্জিলিঙে মান্না দে-র ছবিতে পুষ্পস্তবক দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র। |
গত পাঁচ মাস ধরে বেঙ্গালুরুর নারায়ণ হৃদয়ালয়ে ভর্তি ছিলেন ৯৪ বছরের মান্না। সেই দীর্ঘ রোগভোগের সময় রাজ্য সরকারকে পাশে পাননি বলেই অভিযোগ শিল্পীর ছোট মেয়ে সুমিতার। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের কোনও টাকার গাছ ছিল না। তাই সরকারে কাছে আবেদন করেছিলাম। সরকার কোনও রকম সাড়া দেয়নি। এর পরও আমি কী ভাবে তাঁর (মুখ্যমন্ত্রী) কথাকে সম্মান দেব, আপনারাই বলুন!’’ শিল্পীর মৃত্যুদিনেই শিল্পী-কন্যার এমন অভিযোগ নিয়ে স্বভাবতই সঙ্গীত মহলে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, এমন দিনে এমন সব কথা না তুললেই ভাল হতো!
সরকারি সূত্রের খবর, মান্নার মরদেহ কলকাতায় নেওয়ার জন্য মমতা উদ্যোগী হয়েছিলেন শিল্পীর মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। বৃহস্পতিবার ভোরে খবরটা পেয়েই তিনি যোগাযোগ করেন সুমিতার সঙ্গে। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে জানান, রাজ্য সরকার কলকাতায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মান্নাবাবুর শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে চায়। প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা সরকারই করবে, কারণ মান্নাবাবুকে এই সরকার ইতিমধ্যেই রাজ্যের সর্বোচ্চ সরকারি সম্মান ‘বঙ্গবিভূষণ’ প্রদান করেছে। গত এপ্রিলে শিল্পীর বেঙ্গালুরুর বাড়িতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নিজে তাঁকে অর্পণ করেছেন ‘বিশেষ সঙ্গীত মহাসম্মান’। তাই উপযুক্ত মর্যাদায় মান্না দে-র শেষকৃত্য সম্পন্ন করাকে রাজ্য সরকার নিজেদের কর্তব্য বলে মনে করে।
বিষয়টি বিবেচনার জন্য মান্নাবাবুর পরিবারের তরফে কিছুটা সময় চেয়ে নেওয়া হয়। তার পর থেকে দফায় দফায় দার্জিলিংয়ের রিচমন্ড হিলের সঙ্গে বেঙ্গালুরুর কল্যাণনগরের কথাবার্তা চলতে থাকে। এ পারে স্বয়ং মমতা, ও পারে মান্নাবাবুর জামাই জ্ঞানরঞ্জন দেব। পাশাপাশি মমতা তাঁর দার্জিলিং সফর কাটছাঁট করে কলকাতায় ফেরার প্রস্তুতি নিতেও শুরু করেন। কিন্তু শেষ কালে খবর আসে, বেঙ্গালুরুতে শেষকৃত্যের বন্দোবস্ত সম্পূর্ণ। বেলা ১২টা নাগাদ অন্ত্যেষ্টির কাজ শুরু হতে চলেছে।
এই অবস্থায় আরও এক বার চেষ্টায় নামেন মমতা। জ্ঞানরঞ্জনবাবুকে তিনি বলেন, “আপনাকে একটা বিকল্প অনুরোধ করছি। কয়েক ঘণ্টার জন্য শিল্পীর মরদেহ কলকাতায় নিয়ে গিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ দিন। প্রয়োজন হলে রাজ্য সরকার বেঙ্গালুরুতে বিশেষ বিমান পাঠিয়ে কলকাতায় দেহ আনবে। দু’-চার ঘণ্টা রেখে সকলের শ্রদ্ধা জানানোর ব্যবস্থা করবে। আবার বিশেষ বিমানেই দেহ বেঙ্গালুরুতে পাঠিয়ে দেবে। শিল্পীর পরিবারের সদস্যরাও সঙ্গে আসবেন।” বেলা ১২টা বাজার পাঁচ মিনিট আগে সেই প্রস্তাব খারিজ করে দেন মান্না দে-র মেয়ে-জামাই।
মমতা অগত্যা সিদ্ধান্ত নেন, রাজ্য সরকার এ দিন বিকেল থেকেই রবীন্দ্র সদন প্রাঙ্গণে মান্না দে-র ছবি সাজিয়ে মানুষকে আগামী ৪৮ ঘণ্টা শ্রদ্ধা প্রদর্শনের সুযোগ দেবে। মুখ্যমন্ত্রী নিজে যে হেতু দার্জিলিংয়ে, তাই এখানে জেলাশাসকের দফতরে শিল্পীর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানিয়ে সরকারের তরফে শোকজ্ঞাপন করবেন তিনি নিজে। সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী জানতে পারেন, মান্নাবাবুর জামাই বলছেন, শিল্পীর দেহ কলকাতায় পাঠাতে না পারার জন্য রাজ্যের মানুষের কাছে তাঁরা ‘ক্ষমাপ্রার্থী’। তবে রাজ্য চাইলে শিল্পীর চিতাভস্ম তাঁরা পাঠিয়ে দিতে পারেন। মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহলের খবর, চিতাভস্ম পাঠানোর বিষয়টি শিল্পীর পরিবার চূড়ান্ত ভাবে জানাননি। সে প্রস্তাব এলে শ্রদ্ধার সঙ্গেই তা রাখা হবে। কিন্তু তাতে মরদেহে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে না পারার দুঃখ ঘুচবে না।
কলকাতায় দেহ না পাঠানোর কারণ হিসেবে সুমিতা রাজ্য সরকারকে লক্ষ্য করে যা বলেছেন, সরকার তাতেও যথেষ্ট ক্ষুব্ধ। সুমিতার অভিযোগ, “প্রত্যেকে জানেন, শেষ পাঁচ মাস আমাদের কেমন কেটেছে। আমি বহু বার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছি, কলকাতার পুলিশ কমিশনারকেও জানিয়েছি। সাড়া না পেয়ে কড়া চিঠিও লিখেছিলাম।” তা ছাড়া মান্নার সম্পত্তি নিয়ে পারিবারিক বিবাদের কথা উল্লেখ করে তাঁর দাবি, “ভাইয়েরা যা করেছে তার বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এটাকে চুরি ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। এমন অবস্থাতেও তিনি (মুখ্যমন্ত্রী) এগিয়ে আসেননি। দুঃখ প্রকাশও করেননি।” সেই কারণেই তাঁরা মরদেহ কলকাতায় পাঠাননি বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন সুমিতা। তাঁর মন্তব্য, “বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও যখন মুখ্যমন্ত্রী বা পুলিশ কমিশনার এগিয়ে আসেননি, তখন আমার কী করা উচিত?”
এ ব্যাপারে রাজ্য সরকারের কী বক্তব্য? সরকারি তরফে বলা হচ্ছে, মমতা ক্ষমতায় আসার পর মান্নাবাবুকে কলকাতায় এনে তাঁর থাকা-খাওয়া-চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করা হবে বলে প্রস্তাব দেন। শিল্পীই তা নিতে ‘অপারগ’ বলে জানিয়েছিলেন। গত এপ্রিলেও মান্নাবাবুর বাড়ি গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলে এসেছিলেন, “আপনি আমার বাড়িতে আমার অভিভাবক হয়ে চিরকাল থাকবেন। কলকাতায় চলুন।” সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রশাসন বলছে, রাজ্য সরকার মান্নাবাবুর খোঁজখবর রাখেনি, এমন কথা বলা শোভা পায় না। আর, শিল্পীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের টাকা গায়েব হওয়া সম্পর্কে আইন মোতাবেক যা করণীয় তা করা হচ্ছে বলেও সরকারি কর্তারা জানিয়েছেন।
কিন্তু প্রবীণ শিল্পীর মৃত্যুর দিনে কি এই প্রসঙ্গগুলো অনিবার্য ছিল? সঙ্গীত মহলের ক্ষোভ ঠিক এই জায়গাতেই। শিল্পী বাবুল সুপ্রিয়র কথায়: “শিল্পীর কন্যা যা বলছেন, তা মানতে পারছি না। শিল্পীকে শেষ দেখতে না পাওয়ার আফশোস থেকে যাবে বাংলা ও বাঙালির হৃদয়ে।” সঙ্গীত পরিচালক সুপর্ণকান্তি ঘোষ শিল্পী-কন্যার কথা নিয়ে সরাসরি মন্তব্য করেননি। কিন্তু বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী যখন তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন তখনও ফোনে মান্নাদা আপ্লুত হয়ে আমায় বলেছিলেন, বাংলার এই ভালবাসা আমি ভুলতে পারি না। কিন্তু মৃত্যুর পরে তাঁকে কলকাতায় আনা গেল না!” সঙ্গীত আয়োজক শান্তনু বসুর মন্তব্য: “সুমিতা যা বলছেন ঠিক নয়। বলা হয়েছিল, প্রয়োজনে বেসরকারি উদ্যোগে আমরাও তাঁকে নিয়ে আসতে পারি। কিন্তু তাতেও তিনি বাগড়া দিলেন।”
মুখ্যমন্ত্রী নিজে শিল্পী-কন্যার বক্তব্য নিয়ে একটি কথাও বলেননি। শুধু বলেন, “কারও বিরুদ্ধে আমার কোনও অভিযোগ নেই। আজ বিবাদ-বিতর্কের দিন নয়। মান্নাদাকে ঘিরে অহেতুক তিক্ততা আমি চাই না।”
|
সহ-প্রতিবেদন: বিপ্লবকুমার ঘোষ |