ঋজু বসু ও প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত • কলকাতা |
বছর সাতেক আগের কথা। সাতাশি বছরের প্রবীণের গলার দাপুটে মেজাজে থ হয়ে গিয়েছিলেন সঙ্গীত পরিচালক সমীর টন্ডন। পঞ্চাশ পেরিয়েও এতটা ‘হাই-পিচে’ গাইতে অনেক শিল্পীই সমস্যায় পড়বেন। আর মান্না দে কি না পাঁচ মিনিটে নিখুঁত একটি টেকে বাজিমাত করে দিলেন।
ছবির নাম ‘উমর’। বয়স্কদের জীবনের ঝুট-ঝামেলা ছিল ছবির বিষয়বস্তু। কাদের খান, প্রেম চোপড়া, সতীশ কৌশিক অভিনীত তিনটি চরিত্রের হয়েই প্লে-ব্যাক করেছিলেন একা মান্না দে। মুম্বই থেকে তার বেশ ক’বছর আগেই কার্যত অবসর নিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু গানটির জন্য সমীরের একটি প্রবীণ-কণ্ঠের দরকার ছিল। বেশ কিছু দিন আপত্তি জারি রাখার পরে কী ভাবে যেন মান্না রাজি হয়ে গেলেন। রেকর্ডিংটা হয়েছিল বেঙ্গালুরুতেই। গানের সময়ে শিল্পীর অন্য চেহারা। ছবির দরকার মাফিক তিনটি চরিত্রের গলা পাল্টে পাল্টে গানের পরে বিস্ময়ে স্তব্ধ গোটা স্টুডিও।
বলিউডে সেটাই মান্নার শেষ গান। ’৪২ সালে ‘তমান্না’ ছবিতে তাঁর প্রথম রেকর্ডিং ‘জাগো আয়ি উষা’-র এর ৬৪ বছর বাদে, ২০০৬। প্রথম জীবনে জেলের কয়েদি, বৃদ্ধ থেকে পৌরাণিক ছবিতে হনুমান-বাল্মীকির লিপেও গান করতে হয়েছে মান্নাকে। আদতে শচীন কত্তার সহকারী, কৃষ্ণচন্দ্র দে-র ভাইপোটিকে ভাল গান পেতে বেশ কিছু দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। প্রথম যৌবনের মান্না সিনেমা-হলে চুপিচুপি নিজের গান শুনে চলে যেতেন। অমুক ছবিতে গান গেয়েছেন তা বলতেও লজ্জা পেতেন। |
বলিউডের প্রখ্যাত সুরকার জুটি শঙ্কর-জয়কিষেণের শঙ্করের সঙ্গে। |
সেই মান্নাই গড়লেন এমন মণিমুক্তোখচিত লম্বা ইনিংস। যে ইনিংসের স্মৃতিরোমন্থনে বসে বলিউডের আজকের পরিচালক, সঙ্গীত পরিচালক বা গীতিকারদের অনেকেই বিন্দুমাত্র অবাক হচ্ছেন না। মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির গানের ইতিহাস মানে তো যুগে যুগে বাঙালির দাপটের আখ্যান। সব প্রজন্মেই বাঙালিরা রয়েছেন। শুরু সেই চল্লিশের দশকে। মাত করল পঙ্কজ মল্লিকের ‘পিয়া মিলন কো যানা’, কাননবালার ‘তুফান মেল’, রাইচাঁদ বড়ালের ‘হাসকে জিয়ে জা তু’। ক্রমশ আসবেন ‘দিল জ্বলতা হ্যায়’ নিয়ে সঙ্গীত পরিচালক অনিল বিশ্বাস এবং শচীন দেব বর্মন। অশোক কুমারও নিজের গান (রেলগাড়ি চুক চুক) গেয়েছেন। ’৫০-৬০ এর দশকে দেখা গেল গান গাইতেও বাঙালি, সুর করতেও বাঙালি! শচীনকত্তা, গীতা দত্ত, সলিল চৌধুরী, হেমন্তকুমার, কিশোরকুমার, মান্না! ’৭০-এর দশক মানে রাহুলদেব বর্মন, বাপ্পি লাহিড়িদের জয়জয়কার। বাংলার আরতি মুখোপাধ্যায়ও ‘দো নয়না’, ‘শ্যাম তেরি বংশী’-র মতো হিট উপহার দিয়েছেন। এ দিকে কিশোরপুত্র অমিত কুমারও ’৮০র দশক থেকেই জাত চিনিয়ে দিয়েছেন। তাঁর ‘বড়ে আচ্ছে লাগতে হ্যায়’-এ আজও বুঁদ বাঙালি। এর পরে ব্যাটন গিয়েছে জলি মুখোপাধ্যায়, কুমার শানু, অভিজিৎ থেকে শুরু করে শান, শ্রেয়া, বাবুল সুপ্রিয়দের হাতে। প্রথম সারির সমস্ত নায়কের লিপে একচেটিয়া ভাবে তাঁরাই গেয়েছেন। সেই সঙ্গে বলিউড পেয়েছে শান্তনু মৈত্র, প্রীতমের মতো দুঁদে বঙ্গজ সঙ্গীত পরিচালককে। প্রীতমের একদা জুটি জিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলিউড থেকে দৌড় শুরু করে দীর্ঘদিন বাংলা কাঁপিয়ে আবার ফিরেছেন মুম্বইয়ে। আজকের বলিউডের গানে উজ্জ্বলতম দু’টি মুখ ‘আশিকি-২’ খ্যাত অরিজিৎ সিংহ এবং ‘লুটেরা’-র সম্পদ মোনালি ঠাকুর। তবে এঁদের সবার চেয়ে এগিয়ে আছেন অবশ্যই শ্রেয়া, শ্রেয়া ঘোষাল। ‘কী জাদু বাংলা গানে’, তা তো বাঙালি বলবেই নিজেদের গান নিয়ে। কিন্তু বাঙালির গানের জাদু গোটা ভারত মানতে বাধ্য হয়েছে। বাঙালি তা মানতে বাধ্য করেছে। সেটাই বুক বাজিয়ে বলছিলেন অভিজিৎ। “আরে বাবা, ভাল মেলোডি চাইলেই বাঙালিদের ডাকতে হবে। তখন আমরা রাজ করব।” অভিজিতের অবশ্য বর্তমান নিয়ে আক্ষেপ রয়েছে। আক্ষেপ এ কালে বলিউডের সুর ও একান্ত প্রযুক্তিনির্ভর রেকর্ডিং নিয়ে। তাঁর মতে, মিউজিক ট্র্যাকের যুগে এখন বাঙালির অনেক সময় আলাদা করে কিছু করার সুযোগ থাকছে না।
মধুর ভান্ডারকর বিষয়টা বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। তাঁর কথায়, “শুধু সঙ্গীতের কথা বলব কেন? সলিলদা, কিশোরদা -দের সঙ্গে বিমল মিত্র, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়রা হিন্দি ছবিকে সমৃদ্ধ করেছেন।” আজকের প্রীতম-শান্তনু মৈত্রর পরে মোনালি ঠাকুরদের নিয়েও অনেক আশা মধুরের। সঙ্গীতে বাঙালির এই সাফল্যের পিছনে তার বহুমাত্রিক গানের উত্তরাধিকারটাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন সঙ্গীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্র। তাঁর মতে, কলকাতার কসমোপলিটন আবহ তার সাঙ্গীতিক বোধটা ধারালো করেছে।
বাস্তবিক সিমলেপাড়ায় কৃষ্ণচন্দ্র দে-র বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো, অন্নপূর্ণাপুজো মানেই ছিল বড় বড় ওস্তাদদের আসর। ওস্তাদ বাদল খাঁ, জমিরুদ্দিন খাঁ, দবির খাঁ, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, রাইচাঁদ বড়াল, শচীন কত্তা কে আসেননি সে-বাড়িতে। লখনউ থেকে বেগম আখতার অবধি এসেছেন। হেদুয়ার সুইমিংপুলে কোন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান যুবা বেহালা বাজাচ্ছেন। শুনতে পেয়ে ভাইপো মানা’কে কৃষ্ণচন্দ্রের হুকুম, “যা ধরে আন!” মান্না দে এই পরিবেশের ফসল। কৃষ্ণচন্দ্রের ভাইপো বিশ্বাস করতেন, গুরু তুলসীপাতার মতো। তাঁর কোনও জাতধর্ম হয় না।
দেবজ্যোতি বলছিলেন, বাংলা গানের অস্ত্রভাণ্ডারে সব-কিছু আছে। কীর্তন-বাউল-ভাটিয়ালি থেকে পাশ্চাত্যের আহরণ। আজকের বলিউডের গীতিকার অমিতাভ ভট্টাচার্যের মতে, মনের জানলা খোলা রেখেই বাঙালি এতটা দাপটে করেকম্মে খাচ্ছে। তাঁর কথায়, “সঙ্গীতে বাঙালির নিজেকে ভাঙতে পারার বুদ্ধিই বাজিমাত করছে। এই তো বাংলার পটভূমিতে লুটেরা-য় মোনালির জন্য আমরা বাংলা লোকসঙ্গীতের আদলে গান তৈরি করলাম। আবার দরকারে ‘বদতমিজে দিল’-এ অন্য মেজাজ।”
নিজেকে বারবার ভাঙার এই সাহসই অনেকের মতে মান্না দে-র ঘরানা। দেবজ্যোতি মনে করালেন, সলিল চৌধুরীর ‘অ্যায় মেরে প্যায়ারে ওয়াতন’-এর মান্না, ‘পেয়ার হুয়া ইকরার হুয়া’-র মান্না আর ‘আও টুইস্ট করে’র মান্নার মধ্যে কত তফাত। শহুরে পল্লিতে গভীর রাতে পড়শিদের অসুবিধে না-করে কাবুলিওয়ালা চাপা স্বরে গাইছে ‘অ্যায় মেরে প্যায়ারে ওয়াতন’। সেই গান গাইতে গিয়ে মান্না অনায়াসে তাঁর গলার ‘টোনাল টেক্সচার’ বা চরিত্রই পাল্টে ফেলেন। দেবজ্যোতির কথায়, “১০০ ভাগ সৎ একজন শিল্পীই এটা পারেন। লোকে অনেক সময়ে মান্নাকে ভুলে গিয়েছে, কিন্তু গানটাকে ভুলতে পারেননি।”
এখানেই মান্না দে-র জিৎ। |