গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের জেরে তৃণমূলের এক বুথ কমিটির সভাপতি গুলিবিদ্ধ হয়ে খুন হওয়ার পরে একের পর এক গণ্ডগোলে তেতে উঠেছিল লাভপুরের বিপ্রটিকুরি পঞ্চায়েত এলাকা। পুলিশের উপরে আস্থা হারিয়ে দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে এককাট্টা হওয়ার ডাক দিয়েছিলেন গোটা এলাকার মানুষ। “পুলিশ ব্যবস্থা নিক বা না নিক, আমরা আর কোনও দুষ্কৃতীকে এলাকায় ঢুকতে দেব না! দুষ্কৃতীদের যারা আশ্রয় বা মদত দেবে, তাদেরও গ্রামছাড়া করব। যা হওয়ার হবে!”সাফ ঘোষণা ছিল তাঁদের। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এলাকায় ফিরতে ওই খুনেরই অন্যতম এক অভিযুক্তকে পিটিয়ে খুন করল এলাকার উত্তেজিত জনতা।
পুলিশ জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সকালে ঘটনাটি ঘটে লাভপুরের বিপ্রটিকুরি হাইস্কুল লাগোয়া এলাকায়। নিহতের নাম সেন্টু কাজি (৩৪)। তাঁর বাড়ি স্থানীয় কাশিয়াড়া গ্রামে। এলাকায় তিনি তৃণমূল কর্মী বলে পরিচিত। ঘটনার পরে অবশ্য লাভপুর থানায় নিহতের বাবা দলেরই অপর এক গোষ্ঠীর লোকজনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ করেছেন। পুলিশ সুপার সি সুধাকর বলেন, “কী কারণে ওই খুন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অভিযুক্তদের খোঁজেও তল্লাশি চলছে। তবে এখনও পর্যন্ত কেউ ধরা পড়েনি। নিহত যুবক নিজে একটি খুনের অভিযুক্ত।” তৃণমূলের জেলা সভাপতি নিহতকে তাঁদের সমর্থক বলে মেনে নিলেও উল্টো সুর এলাকার দলীয় বিধায়কের। |
গত বছর ১০ নভেম্বর সন্ধ্যায় স্থানীয় বিপ্রটিকুরি পঞ্চায়েতের ব্রাহ্মণী গ্রামের অদূরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার হয়েছিলেন তৃণমূলের বুথ কমিটির সভাপতি চিত্তরঞ্জন মণ্ডল। পরের দিন বর্ধমান মেডিক্যাল থেকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়। নিহত চিত্তরঞ্জনবাবু এলাকায় লাভপুরের তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলামের বিরোধী গোষ্ঠীর নেতা দেবাশিস ওঝা ও চয়ন চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন। ওই খুনে দাগী আসামী গোপাল শেখ, রেজাউল শেখ, সেন্টু কাজি-সহ ২৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ হয়েছিল। দীর্ঘদিন ফেরার থাকার পরে গোপাল-সহ দু’জন ধরা পড়লেও বাকি ২৭ জনই পুলিশের খাতায় গত এক বছর ধরে পলাতক। এ দিন তাদেরই এক জন, সেন্টু কাজিকে একটি মোটর বাইকে বিপ্রটিকুরি গ্রামের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় দেখতে পেয়ে বাসিন্দাদের একাংশ ধরে ফেলেন। অভিযোগ, তাঁকে আটকে লাঠি রড দিয়ে মারধর করা হয়। পরে পুলিশ সেন্টুকে উদ্ধার করে লাভপুর হাসপাতালের নিয়ে গেলে পথেই তার মৃত্যু হয়। খুনের খবর এলাকায় ছড়াতেই উত্তেজনা দেখা দেয়। অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবিতে তাঁতবান্দী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বোলপুর-লাভপুর সড়ক অবরোধ করা হয়। পরে অবশ্য মনিরুলের হস্তক্ষেপে তা উঠেও যায়।
এ দিন দুপুর ১২টা নাগাদ বিপ্রটিকুরিতে গিয়ে দেখা যায় গোটা এলাকা থমথমে। গ্রামের প্রাইমারি ও হাইস্কুলের মাঝে ভেঙে পড়ে রয়েছে সেন্টু কাজির বাইকটি। বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ। গ্রাম কার্যত পুরুষ শূন্য। পুলিশের টহল দেখে গ্রামে থাকা বয়স্ক, মহিলা ও শিশুদের চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। প্রত্যেকেই মুখে কুলুপ এঁটেছেন। একই দৃশ্য ছিল চিত্তরঞ্জনবাবুর গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণীতেও। সেখানেও বৃদ্ধ, মহিলা আর শিশুরা ছাড়া কেউ নেই। নিহত চিত্তরঞ্জনের কাকিমা সন্ধ্যা মণ্ডল বললেন, “ভাইপোকে খুনে এক অভিযুক্ত যুবক খুন হয়েছেন বলে শুনেছি। তবে কারা তাঁকে কেন খুন করল বলতে পারব না।” এ দিকে, নিহত সেন্টু কাজির বাবা হান্না কাজি সরাসরি অভিযোগ করেই বলছেন, “আমার ছেলেকে খুনের মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো হয়েছিল। সেন্টু এ দিন বোলপুর থেকে বাড়ি ফিরছিল। চয়ন আর তার দলবলই ওকে পিটিয়ে মেরেছে।” |
তৃণমূলেরই একটা অংশ একে পাল্টা খুন বলেই দেখছে। যার পিছনে তাঁরা দলের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বকেই দায়ী করছেন। তৃণমূল সূত্রের খবর, গত বিধানসভা ভোটে লাভপুর কেন্দ্রের টিকিট পাওয়া নিয়ে বর্তমান তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলাম এবং দলের জেলা সম্পাদক, লাভপুরের বাকুল গ্রামের বাসিন্দা দেবাশিস ওঝার মধ্যে বিরোধ শুরু হয়। এক সময়ের ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা মনিরুল ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পরে সদলবলে তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের উপস্থিতিতে তৃণমূলে যোগ দেন। লাভপুর বিধানসভা কেন্দ্রে প্রার্থিপদের অন্যতম দাবিদার ছিলেন দেবাশিসবাবুও। কিন্তু মনিরুল টিকিট পাওয়ায় দুই গোষ্ঠীর বিরোধ চরমে পৌঁছয়। তৃণমূলের এই অংশের ক্ষোভ, ভোটে জিততে সিপিএম কিংবা ফব-র হয়ে কাজ করা দুষ্কৃতীদের দলে ঢোকানো হয়েছে। তারা দলে এসে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাও পেয়েছেন। কিন্তু যাঁরা প্রথম থেকে এলাকায় তৃণমূলের সংগঠন বাড়ানোর কাজ করতে গিয়ে বামেদের মার খেয়েছেন, দলে ব্রাত্য হয়ে পড়েছেন তাঁরাই। চিত্তরঞ্জন-খুনের পরে সেই দলীয় বিভাজন আরও বেআব্রু হয়ে যায়। এলাকার মানুষের মধ্যেও ক্রমশ ক্ষোভ দানা বাধছিল। তাই ফেরার অভিযুক্তকে এলাকায় দেখেই বিরোধী-গোষ্ঠীর লোকজন মারমুখী হয়ে ওঠে।
এ দিকে নিহত যুবককে দলীয় কর্মী বলে চিনতে অস্বীকার করেছেন মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, “সেন্টু আমাদের দলের কেউ নন। ও আমার বিধানসভা কেন্দ্রের এক জন ভোটার মাত্র। ঠিক কী কারণে তাঁকে মারা হয়েছে, তা পুলিশই বলতে পারবে।” যদিও এলাকাবাসীর দাবি, এ দিন নিহতের বাবাকে কার্যত বগলদাবা করে লাভপুরে দলীয় কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে থানা। সবেতেই সক্রিয় ভাবে থাকতে দেখা যায় মনিরুলকেই। অনুব্রত-রও দাবি, নিহত সেন্টু কাজি তৃণমূলেরই সমর্থক। তবে সেন্টু খুনে যাঁর দিকে অভিযোগের আঙুল উঠছে, সেই এলাকায় তৃণমূলের ব্লক যুব সভাপতি বলে পরিচিত চয়ন চট্টোপাধ্যায়কে অবশ্য দু’জনেই একসুরে তৃণমূলের কেউ নন বলে দাবি করেছেন। এ নিয়ে স্থানীয় ইন্দাস প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক চয়নবাবুর প্রতিক্রিয়া, “আমাকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে দল তো কখনও জানায়নি। এ রকম কোনও চিঠিও আমি পাইনি।” মোবাইল বন্ধ থাকায় দেবাশিসবাবুর সঙ্গে অবশ্য যোগাযোগ করা যায়নি।
চয়নবাবু সেন্টুকে খুনের অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি, “চিত্তরঞ্জন খুনের প্রতিবাদে আমি সরব হয়েছিলাম। অভিযুক্তদের শাস্তির দাবি তুলেছিলাম। এখন সেই চিত্তরঞ্জনকে খুনেই ফেরার এক অভিযুক্তকে খুনের ঘটনায় আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে!” তাঁর অভিযোগ, এ দিন স্কুলে যাওয়ার জন্য বিপ্রটিকুরি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পৌঁছতে সেন্টুই তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। তিনি কোনও রমে ছুটে পালিয়ে প্রাণ বাঁচান। পরে খবর পান, উত্তেজিত জনতা সেন্টুকে ধরে গণপিটুনি দিয়েছে। চয়নবাবুর মতোই এলাকার অনেক মানুষই বলছেন, চিত্তরঞ্জন-খুনে অভিযুক্তদের অনেকেই এখন এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু শাসক দলের প্রভাবশালী গোষ্ঠীর চাপে পুলিশ তাঁদের গত এক বছরেও গ্রেফতার করেনি। অভিযুক্তেরা আগেই গ্রেফতার হলে এ দিনের ঘটনা ঘটত না বলেই তাঁদের দাবি। জেলার পুলিশ সুপার এবং স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক অবশ্য ওই অভিযোগ মানেননি। |