উত্তরবঙ্গের চাষিদের সেচের জল থেকে বঞ্চিত করে বাংলাদেশকে তিস্তার জল ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ করে তদন্তের নির্দেশ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে ইঞ্জিনিয়ারদের একাংশের কথায়, শুখা মরসুমে তিস্তায় জল এতটাই কম থাকে যে ব্যারাজ থেকে সেচ খালে জল দেওয়াই সম্ভব হয় না। তাই চাষিদের বঞ্চিত করার অভিযোগ ভিত্তিহীন।
শুখা মরসুমে উত্তরবঙ্গের সর্বত্র কৃষকরা তিস্তা প্রকল্পের সেচের জল পাচ্ছে না, এমন অভিযোগ পৌঁছেছে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। যেখানে সেচ খাল রয়েছে সেখানে কৃষকরা চাহিদামতো জল পাচ্ছেন না এই নালিশ পাওয়ার পরে খোঁজখবর করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে বলা হয়, শুখা মরসুমে বোরো চাষের জন্য জল সেচের সব চেয়ে বেশি প্রয়োজন থাকে। অথচ সে সময়ে তিস্তার জলের অনেকটাই সেচ খালে না ছেড়ে নদী দিয়ে বইয়ে দেওয়া হয়। সেই জল চলে যায় বাংলাদেশে।
কেন এমন হচ্ছে? অভিযোগ, তিস্তা সেচ খালগুলির বেহাল দশার কারণেই ক্রমশ জল ধারণ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। যার ফলে পরিমাণ মতো জল ছাড়লেও খালগুলি উপচে পড়া বা পাড় ধসে পড়ার মতো ঘটনা ঘটেছে।
শিলিগুড়িতে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র-ভানু মঞ্চে মঙ্গলবার উত্তরবঙ্গের ৬ জেলাকে নিয়ে প্রশাসনিক বৈঠকে শুখা মরসুমে বাংলাদেশকে কেন বেশি পরিমাণ জল ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে তা নিয়ে সেচ কর্তাদের জবাবদিহি চান মমতা। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে তিস্তার জল বাইরে চলে যেতে দেওয়া হচ্ছে। দুর্নীতির অভিযোগও পেয়েছি। তা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে।” রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডিকে পৃথক তদন্তেরও নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পরেই নড়েচড়ে বসেছে সেচ দফতর। দফতরের এক কর্তার কথায়, “মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে দফতর থেকেও তদন্ত শুরু হয়েছে। প্রকল্পের ইঞ্জিনিয়ার এবং আধিকারিকদের থেকে তথ্য ও পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা হচ্ছে।”
শুখা মরসুমে উত্তরবঙ্গের ৬ জেলার কৃষকদের সেচের জল দিতে ১৯৭৫-৭৬ সালে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প ঘোষণা করা হয়। সেচ দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম নদী তিস্তা থেকে সেচ খাল কেটে মহানন্দা, ডাউকি-সহ বিভিন্ন নদীকে যুক্ত করে সেচের জল দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু তিন দশকের বেশি সময় কেটে গেলেও উত্তরবঙ্গে সেচের জলের সমস্যা মেটেনি। রাজ্যে পরিবর্তনের পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশকে তিস্তার জল দেওয়া নিয়ে চুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন। প্রকল্পের গাফিলতির কারণে উত্তরবঙ্গের কৃষকরা জল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, এ বারের সফরে এই অভিযোগ পেয়েই ক্ষুব্ধ হন মুখ্যমন্ত্রী।
সরকারি সূত্রের খবর, শীতের শুখা মরসুমে তিস্তাতে অন্তত ৭০০ কিউসেক জল থাকে। নথি অনুযায়ী তিস্তা প্রকল্পের সেচ খালে প্রায় সাড়ে ৪০০ কিউসেক জল বহনের ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু সেচ খালগুলি নিয়মিত সংস্কার এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অর্থ বরাদ্দ হলেও সে কাজ যথাযথ ভাবে হয় না বলে অভিযোগ।
তিস্তা-মহানন্দা সংযোগকারী বেশ কিছু খাল সংস্কার না হওয়ায় এক দিকে যেমন পলি জমে জল ধারণ ক্ষমতা কমেছে, তেমনই খালের কংক্রিটের পাড়গুলি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। ফলে নির্ধারিত মাত্রার জল ছাড়লেও পাড় ধসে পড়া বা এলাকা প্লাবিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর আগে ২০১০ সালে শিলিগুড়ি লাগোয়া ফুলবাড়ি এলাকায় খালের পাড় কয়েকশো মিটার ধসে যাওয়ায় গোটা এলাকা জলের তলায় চলে যায়। ২০১১ সালে বোরো মরসুমে জল ছাড়ার পরে মালবাজারের বেশ কিছু এলাকায় জল উপচে পড়া এবং খালে ভাঙন ধরার ঘটনা ঘটে। অভিযোগ, তার পরেও কোনও সেচ খালের যথেষ্ট রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অভিযোগ, খাল ভাঙার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কাতেই শুখা মরসুমেও সেচ খালে প্রয়োজন মতো জল না ছেড়ে বাংলাদেশের দিকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। যদিও দফতরের ইঞ্জিনিয়ারদের একাংশের দাবি, শুখা মরসুমে তিস্তার বুকে শুধুই বালি পড়ে থাকে। সে সময়ে ওদলাবাড়ি ব্যারাজ থেকে সেচ খালে দেওয়ার মতো জলই থাকে না। ফলে উত্তর দিনাজপুর থেকে শিলিগুড়ি লাগোয়া বিস্তীর্ণ এলাকায় জলই দেওয়া যায় না। তাই ওই মরসুমে বাংলাদেশকে বাড়তি জল ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ ভিত্তিহীন বলেই তাঁরা মনে করেন। |