পরিমাণ অল্প। দামও তাই নাগালে।
বেআইনি চোলাইয়ের পাউচ প্যাকের চ্যালেঞ্জ নিতে এ বার বাজারে আসতে চলেছে সরকারি দেশি মদের (চালু ভাষায় দিশি বা বাংলা) টেট্রা প্যাক। যাতে বোতলের তুলনায় কম পরিমাণ মদ থাকবে, ফলে দামও হবে কম। এতে ‘সস্তা’র আকর্ষণে চোলাইয়ের ঠেকে জমে ওঠা ভিড়ের অনেকটা ‘দিশি’র দোকানে টেনে আনা যাবে বলে আশা করছেন রাজ্যের আবগারি-কর্তারা।
কৌশলটি অবশ্য দেশি মদের উৎপাদকেরাই তাঁদের বাতলেছেন। জানা গিয়েছে, কর্নাটকে ইতিমধ্যে এই কায়দায় হাতে-নাতে ফল মিলেছে। এ বার পশ্চিমবঙ্গেও তা রূপায়ণের লক্ষ্যে আবগারি দফতরে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। দফতরের খবর, সব ঠিকঠাক থাকলে আর ক’মাসের মধ্যে বেরিয়ে যাবে সরকারি দেশি সুরার টেট্রা প্যাক, যে রকম প্যাকেটে হরেক ব্র্যান্ডের ফলের রস বাজারে বিকোয়। পাশাপাশি দেশি মদের কাচের বোতল উঠিয়ে প্লাস্টিকের বোতল চালু করার পরিকল্পনাও রয়েছে। আবগারি-কর্তাদের মতে, ভাবনাগুলি বাস্তবায়িত হলে এক ঢিলে দু’পাখি মারা যাবে। চোলাইয়ের বাজার মার তো খাবেই, আবগারি-আয়ও বাড়বে।
বস্তুত পুরো বিষয়টির মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গিতে বড়সড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাচ্ছেন সরকারি মহলের একাংশ। এই মহলের বক্তব্য: আবগারি খাতে রাজস্ব বৃদ্ধি করতে হলে এক দিকে যেমন চোলাইয়ের অবৈধ কারবার বন্ধ করা জরুরি, তেমন সরকারি মদ বিক্রির বাজারও চাঙ্গা করতে হবে। সে জন্য নির্দিষ্ট জনসংখ্যাপিছু মদের দোকানের সংখ্যা বাড়ানো ও যথাযথ বিপণন দরকার। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে মমতা কিছুতেই আবগারি ক্ষেত্রটিতে হাত দিতে চাননি। সরকারি সূত্রের দাবি, মুখ্যমন্ত্রী এখন বুঝেছেন, আবগারি-রাজস্ব বাড়াতে হলে এবং মগরাহাট-কাণ্ডের (বিষ-মদে গত বছর শতাধিক মৃত্যু) মতো বিপর্যয় এড়াতে গেলে সরকারি মদের প্রসার ঘটানো একান্ত প্রয়োজন।
আবগারির এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী চান না, রাজ্যে নতুন মদের দোকান খোলা হোক। তবে চালু ব্যবস্থার মধ্যে কিছু এ দিক-ও দিক করে রাজস্ব বৃদ্ধির সুযোগ করা গেলে তাঁর আপত্তি নেই।” আবগারি সূত্রের খবর: সেই মতো গত দু’বছরে রাজ্যে ১৫টি নতুন বটলিং প্লান্ট খোলা হয়েছে, বিলিতি মদের শ’দুয়েক অস্থায়ী দোকানের স্থায়ীকরণ হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, পানশালা খোলা রাখা যাবে রাতভর। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরেও নামী ব্র্যান্ডের বিলিতি মদ মিলবে। “পরের ধাপে সরকারি মদ সহজলভ্য করতে আধুনিক প্যাকেজিংয়ের সাহায্য নেওয়া হবে। এরই অঙ্গ টেট্রা প্যাকে দেশি মদ।” বলেন ওই কর্তা।
আবগারি-সূত্র জানাচ্ছে, এখন রাজ্যের হাজার দুয়েক দোকানে দেশি মদ বিকোয় মূলত ছ’শো মিলিলিটারের কাচের বোতলে। এক বোতলের দাম ৫০ টাকা। বোতল জমা দিলে পাঁচ টাকা ফেরত। অন্য দিকে চোলাইয়ের একশো, দু’শো বা তিনশো মিলিলিটারের পাউচ প্যাকের দাম অনেক কম। তাই পুরো বোতল দেশি মদ কেনার বদলে বহু লোক চোলাইয়ের দিকে ঝুঁকছেন। সেই প্রবণতা রুখতেই পাউচ প্যাকের ধাঁচে টেট্রা প্যাকে দিশি আনার ভাবনা। এক আবগারি-কর্তার কথায়, “শুধু অভিযান চালিয়ে চোলাই ঠেকানো যাবে না। চোলাইয়ের খদ্দেরদের কাছে তাঁদের পছন্দসই পরিমাণ ও দামে সরকারি মদ পৌঁছে দিতে হবে। সে জন্যই টেট্রা প্যাকে ভরে তুলনায় অল্প পরিমাণে দেশি মদ বাজারে ছাড়া হবে।”
অর্থাৎ, কম দরে কম মদ। উৎপাদকমহলের ইঙ্গিত, দেশি মদের প্রস্তাবিত প্যাকের দাম হবে একই পরিমাণ চোলাইয়ের প্রায় সমান, অথবা সামান্য বেশি।
বিপণন-বিশেষজ্ঞেরাও বলছেন, আধুনিক যুগে এটি বাজার দখলের পরিচিত পদ্ধতি। “ধরা যাক নামী ব্র্যান্ডের এক বোতল টোম্যাটো সস। কিংবা এক শিশি কফি বা শ্যাম্পু। দাম নেহাত কম নয়। যার পকেটের জোর কম, কিংবা যার ওই মুহূর্তে অতটা পরিমাণ দরকার নেই, সে ওগুলো কিনতে যাবে কেন? বরং একই ব্র্যান্ডের সস, কফি বা শ্যাম্পুর ‘স্যাসে’ (ছোট প্যাকেট) কিনে নিয়ে যাবে। খরচা কম। তখনকার মতো কাজও দিব্যি চলে যাবে এক বার স্নান সেরে, সস মিশিয়ে এক প্লেট ন্যুডলস আর দু’কাপ কফি! অপচয়ের প্রশ্ন নেই।” মন্তব্য করেছেন একটি সংস্থার বিপণন-কর্তা।
একই জিনিস যদি অল্প পরিমাণে বাজারে আনা যায়, প্রয়োজন ও পকেটের জোর অনুযায়ী নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের কাছে তার কদর হয় বেশি। বিপণনের তত্ত্বটি আশির দশকের গোড়ায় প্রথম হাতে-নাতে প্রয়োগ করেছিল শ্যাম্পু প্রস্তুতকারী এক সংস্থা। সেই ইস্তক উৎপাদকেরা নিজেদের পণ্যকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে তাকে হাতিয়ার করেছে। দামি ব্র্যান্ডের পুরো বোতল কেনার সাধ্য যাদের নেই, সেই দরিদ্র-নিম্নবিত্তেরাও অনায়াসে দু’-এক টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন একই ব্র্যান্ডের সস বা তেলের স্যাসে।
এবং আবগারি কর্তাদের দাবি, মার্কেটিংয়ের এই পরীক্ষিত ফর্মূলাতেই এ যাবৎ বাজিমাত করে এসেছে চোলাই-কারবারিরা। অথচ সরকারি লাল ফিতের ফাঁসে এত দিন তাদের পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছোড়া যায়নি।
এখন অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়ে বিপণন-বিশেষজ্ঞ রাম রে বুধবার বলেন, “এতে লাভ বই ক্ষতি নেই। প্রথমত, চোলাইয়ের দাপট ধাক্কা খাবে। দ্বিতীয়ত, বোতলের মদে ভেজাল হয়, টেট্রা প্যাকে যার সম্ভাবনা নেই। তৃতীয়ত খরিদ্দারদের পক্ষে এটি বহন ও ব্যবহার করা সুবিধাজনক।” তবে দিশি সুরার টেট্রা প্যাক কত সংখ্যায় ও কোথা থেকে বিক্রি হবে, তা না-জানলে এর প্রভাব পুরোপুরি আন্দাজ করা কঠিন বলে জানিয়েছেন তিনি।
কিন্তু বোতলের মদের ক্ষেত্রে কাচ ফেলে প্লাস্টিক আনার ভাবনা কেন?
আবগারি-কর্তাদের ব্যাখ্যা, কাচের বোতলে ভেজালের সঙ্গে দুর্নীতিরও সুযোগ থাকছে। নিয়ম হল, দোকানে খালি বোতল জমা দিলে ক্রেতা পাবেন ৫ টাকা। অভিযোগ, বহু খুচরো বিক্রেতা ক্রেতাকে দু’-তিন টাকা ধরিয়ে বোতল ফেরত নেন, যার বিনিময়ে উৎপাদকের কাছ থেকে আদায় করেন পুরো পাঁচ টাকাই। এ ক্ষেত্রে বিক্রেতা হিসেবের বাইরে বোতলপিছু দু’-তিন টাকা লাভ করছেন, যে বাবদ সরকারের খাতায় কিছু জমা পড়ছে না। কর্তাদের মতে, এ এক ধরনের রাজস্ব লোপাট।
টেট্রা প্যাক বা প্লাস্টিক বোতল চালু হলে এ-ও বন্ধ হবে বলে দফতরের আশা। কিন্তু উৎপাদক বা খুচরো বিক্রেতারা কি রাজি?
সেটা অবশ্য এখনও একশো শতাংশ নিশ্চিত নয়। “টেট্রা প্যাকে মদ বিক্রি হলে স্বাগত জানাব। প্লাস্টিক বোতলেও আমাদের আপত্তি নেই।” জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ দেশি মদ উৎপাদক সংগঠনের সভাপতি রাজেশ কুমার। যদিও তাঁর প্রশ্ন, “দীর্ঘ দিন ধরে কাচের বোতলে মদ বিকোচ্ছে। নতুন ব্যবস্থা খুচরো বিক্রেতারা কি মেনে নেবেন?”
তাঁর সংশয় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বিক্রেতাদের কণ্ঠে। রাজ্যের দেশি মদ বিক্রেতা সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক প্রদ্যোৎ সাহার দাবি, “সরকার এমন কিছু করলে ক্রেতাদের আদতে বেশি টাকা খরচ হবে। কাচের বোতল ফেরালে যে পাঁচ টাকা মেলে, প্লাস্টিকের বোতলে তার সুবিধা থাকবে না। খদ্দের কমবে। আমরা এটা মানব না। তা ছাড়া টেট্রা প্যাকে মদ বেচলেই চোলাই খাওয়া বন্ধ হবে, এর গ্যারান্টি কী?”
কিছু প্রতিবন্ধকতা এখনও আছে। সে সব কাটিয়ে উদ্যোগটি সাফল্যের মুখ দেখবে কিনা, সময়ই বলবে। |