প্রতিমা বিসর্জনে নৈহাটি মডেলই কার্যকর করুক কলকাতা। গঙ্গার দূষণ ঠেকাতে এমনটাই সুপারিশ করেছেন পরিবেশবিদদের একাংশ।
নৈহাটি পুর-এলাকায় বিশালাকার কালীপ্রতিমা গঙ্গার ধারে দাঁড় করিয়ে হোসপাইপ দিয়ে গলিয়ে দেওয়া হয়। তাতে গঙ্গায় দূষণ হয় না। কলকাতায় বিশাল দমকলবাহিনী রয়েছে। পুলিশের জলকামান রয়েছে। তাই কলকাতায় এমন ব্যবস্থা চালু হলে কোনও সমস্যাই হবে না বলে মনে করছেন পরিবেশবিদেরা।
কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ দেবাশিস কুমার নিজে একটি বড় পুজোর উদ্যোক্তা। শহরে বিসর্জনের গোটা প্রক্রিয়াটাই পরিচালনা করেন তিনি। পরিবেশবিদদের এই সুপারিশের সঙ্গে একমত তিনি। বললেন, “আমার মতে ভাসানের ক্ষেত্রে নৈহাটি মডেলই কার্যকর হওয়া উচিত। তবে এতে পুজোর উদ্যোক্তাদের ভাবাবেগ জড়িত। সবার সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
এক দিকে যখন দূষণ কমাতে পরিবেশবিদ, পুজো উদ্যোক্তাদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তুতি নিচ্ছে কলকাতা পুরসভা, অন্য দিকে তখন দেশ জুড়ে বিসর্জনের নির্দিষ্ট বিধির দাবিতে জাতীয় পরিবেশ আদালতের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন পরিবেশবিদদের একাংশ। পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত বুধবার আদালতে এ বিষয়টি নিয়ে আর্জি জানান। আদালত তা গ্রহণও করে। সুভাষবাবু বলেন, “শুধু গঙ্গাই নয়, দেশ জুড়ে বিভিন্ন নদীতে বিসর্জন হয়। ফলে গোটা দেশে অভিন্ন ও নির্দিষ্ট বিসর্জনবিধি না থাকলে দূষণ ঠেকানো সম্ভব নয়।” এ নিয়ে পরিবেশ-বিজ্ঞানী, প্রশাসনের পাশাপাশি ধর্মগুরুদের সঙ্গেও আলোচনা জরুরি বলে তিনি জানান। পরিবেশবিদদের একাংশের মতে, সুভাষবাবুর এই মামলায় নৈহাটি মডেলও ওঠা প্রয়োজন।
সুভাষবাবু এই মডেলকে পুরোপুরি মানতে নারাজ। তিনি বলেন, “শুধু কলকাতায় কয়েক হাজার পুজো হয়। এখানে নৈহাটির মতো হোসপাইপে বিসর্জন কতটা সম্ভব, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।” তবে বিষয়টি একেবারে অসম্ভব বলে মনে করেন না পুরকর্তারা। নদী-বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রও বলছেন, “নদীতে বিসর্জন না হলে তো ভালই। তবে প্রতিমার অবশিষ্টাংশ পুনর্ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে।”
মেয়র পারিষদ পরিবেশবিদদের সুপারিশের সঙ্গে একমত হলেও হোসপাইপে বিসর্জন মানতে চান না কলকাতার পুজোকর্তাদের একটা বড় অংশই। উত্তরের এক পুজোকর্তা তাপসকুমার রায় বলেন, “হোসপাইপে বিসর্জন দিলে মানসিক শান্তি মিলবে না।” একই মত দক্ষিণ শহরতলির এক নামী পুজোর কর্তা হিল্লোল বসুরও। হরিদেবপুরের একটি পুজোর কর্তা দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, “হোসপাইপ দিয়ে গলানো মাটি, রং তো খাল-নালা দিয়ে গঙ্গাতেই যাবে!”
নৈহাটি অবশ্য এই বিসর্জন মেনে নিয়েছে। স্থানীয় বিধায়ক পার্থ ভৌমিক বলছেন, “এই ভাবে বিসর্জন দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। আমরা চাই গঙ্গা পরিষ্কার থাকুক।”
পরিবেশবিদেরা চান, কামারহাটি, বরাহনগর, ব্যারাকপুর, হাওড়া, উত্তরপাড়ার মতো পুরসভাগুলিও নৈহাটি মডেল অনুসরণ করুক। পরিবেশবিজ্ঞানীদের বক্তব্য, কলকাতার অদূরে গঙ্গা ছাড়াও খালে নিয়ম না মেনে বিসর্জন হওয়ায় দূষিত হচ্ছে জল। সেই জলই বয়ে আসছে কলকাতায়। ফলে শুধু কলকাতায় ঘটা করে দূষণ নিয়ন্ত্রণে কতটা লাভ হচ্ছে, সে প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। কল্যাণবাবু বলছেন, “শুধু এক জায়গায় নিয়ম মেনে কাজের কাজ হবে না।”
অন্য দিকে, শহরে প্রতিমার সীসাহীন রং নিয়ে নানা প্রচার চললেও রাজ্যের বৃহত্তর এলাকায় ওই রঙের তেমন চল নেই। ফলে সেখানে প্রতিমা থেকে স্থানীয় নদী-জলাশয়ে দূষণ ছড়াচ্ছে। গবেষক তন্ময় রুদ্র বলছেন, “সীসাহীন রং নিয়ে জন-সচেতনতা বাড়াতে হবে। না হলে হোসপাইপের জলে ধুয়ে ওই রংও মাটিতে মিশে দূষণ ছড়াবে।” বস্তুত, পরিবেশবিজ্ঞানীদের মতে, শুধু আইন করে দূষণ ঠেকানো যাবে না। পরিবেশ বাঁচাতে জন-সচেতনতাও জরুরি। |