|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
আর একটু এগোলেই গুলির দাগ |
ও পার থেকে গুলি এলে মানুষ লোটাকম্বল বেঁধে রওনা হয়। এ পারের সেনার গুলির
মুখে পড়লে পাথর ছোড়ে।
কাশ্মীরের এল ও সি’র গ্রাম এ ভাবেই বাঁচে। সয়ে গেছে আর কী।
জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায় |
লে ছাড়ালেই এক নম্বর জাতীয় সড়কের একটা অংশ তার নাম পাল্টে ফেলে। বি আর ও-র তৈরি রাস্তা। লাদাখে যার নাম প্রোজেক্ট হিমাঙ্ক, কারগিলমুখী হওয়া ইস্তক তার নাম হয়ে যায় প্রোজেক্ট বিজয়ক। নামের সঙ্গেই বদলে যায় মেজাজ।
এল এ সি (লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল) থেকে এল ও সি-তে (লাইন অব কন্ট্রোল) বদলে যাওয়ার মেজাজ। ভারত-চিন থেকে ভারত-পাক। গত কয়েক মাস ধরে সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘনের ঘটনা জারি আছে দুই সীমান্তেই। তবু তফাত হয়। কারণ ভারত-চিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থানের সঙ্গে লাদাখবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষার অনেকটা সাযুজ্য রয়েছে। কাশ্মীরের আজাদির লড়াই আর পাক মদতের প্রশ্নটি সম্পূর্ণ আলাদা।
২৬ সেপ্টেম্বর জম্মুর হীরানগর আর সাম্বায় থানা আর সেনা ছাউনি আক্রান্ত হল। তার পর থেকে আজ অবধি এল ও সি এক বারের জন্য শান্ত হয়নি। সব মিলিয়ে এ বছরে এখনও ১৫০টি সংঘর্ষবিরতি ভাঙার ঘটনা ঘটে গেছে। ঘটনাচক্রে ২৬ তারিখটা আমাদের কেটেছিল কারগিলে। সকালবেলা লে ছাড়িয়ে নিম্মু ঢুকতে না ঢুকতেই খবরটা শুনি। গাড়ির চালক, পঞ্জাবি। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি জম্মুতে। বাড়ির ফোন পেয়ে তিনিই ঘটনাটা বললেন প্রথম। সেই মুহূর্তে বুঝতে পারিনি, হীরানগর থেকে কুপওয়ারা বা কেরান থেকে পুঞ্চ-এর পরিস্থিতি অতঃপর ক্রমে ১৯৯৯-এর কারগিল-দ্রাস-বাটালিকের সঙ্গেই তুলনীয় হয়ে উঠবে।
আমরা বরং বেশি চিন্তিত ছিলাম, বাটালিক যাওয়ার সুযোগটা ফস্কে যাবে কি না, তা-ই নিয়ে। খালসে থেকে একটা রাস্তা গেছে মুলবেক হয়ে সোজা কারগিল। অন্যটা সিন্ধুর ধার ধরে বাটালিক। আমাদের সঙ্গে বাটালিকের পারমিট আছে। কিন্তু খালসের চেকপোস্টে বলা হল, আপনারা দা-ধনু পর্যন্ত যেতে পারেন। তার পর আবার খালসে ফিরে কারগিলের রাস্তা ধরবেন। নইলে পুলিশ আর এস ডি এম-এর কাছ থেকে স্পেশাল পারমিশন নিয়ে আসুন।
এস ডি এম যদি বা রাজি হন, পুলিশ নারাজ। কী, কেন, ওই রাস্তাটাই বা কীসের জন্য দরকার। শেষ পর্যন্ত রফা হল, রাস্তায় কোথাও দাঁড়াব না। কথা বলব না। গ্রামে ঢুকব না। বুঝলাম, একে বলে এল ও সি-র গ্রাম। মনকে বোঝালাম, এমন একটা ঘটনা! কড়াকড়ি তো হবেই। |
|
সয়ে গেছে। ও পারের গুলি থেকে বাঁচতে আশ্রয়শিবিরে। জম্মু, অক্টোবর ২০১৩। ছবি: এপি। |
রাস্তায় নেমে রফাটা অবশ্য হুবহু মানতে পারিনি। খাঁ খাঁ করা রাস্তা। একটা চায়ের দোকান অবধি নেই। প্রায় ঘণ্টা আড়াই কাটার পরে দেখতে পাই একটি দ্রোকপা পরিবারকে। দাঁড়িয়ে কথা বলি। এক বয়স্ক মহিলা রয়েছেন, তাঁকে কি আমরা একটু এগিয়ে দিতে পারি? আমরা রাজি। ভাঙা ভাঙা জনজাতীয় ভাষা বলেন মহিলা। কথা বিশেষ এগোয় না। নেমেও যান একটু পরে। আর তখনই, প্রায় বেশ একটু গায়ে পড়েই গাড়িতে ওঠে এক যুবক। বলে, এ রাস্তায় তো আর কিছু নেই। আমরা এই ভাবে গাড়িকে হাত দেখিয়েই উঠি। বাটালিকে নেমে যাব। পরিষ্কার চোখমুখ, তার চেয়েও পরিষ্কার কথাবার্তা। ছেলেটি জানায়, সে পেশায় ফার্মাসিস্ট। গ্রামে গ্রামে পোলিয়ো ড্রপ খাওয়ানোর কাজ করে। বাটালিকেই বাড়ি।
রাস্তা ক্রমশ সরু হচ্ছে। পরিবেশটাও ছমছমে হচ্ছে। এ ক’দিনে সেনা শিবিরের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করা দিব্যি অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই পাহাড় অন্য রকম। খাঁজে খাঁজে, গর্তের মধ্যে এই ভাবে বন্দুক উঁচিয়ে সেনাকে লুকিয়ে থাকতে এর আগে দেখিনি। ছেলেটি বলে চলেছে, এই যে পাহাড়টা দেখছেন, এর পিছনেই পাকিস্তান। এল ও সি। ওই যে দেখুন, ছোট্ট ব্রিজটা! সাদা-গেরুয়া-সবুজ রং! ওইটা পেরিয়ে ও দিকে গেলেই লাইন অব কন্ট্রোল।
আর আপনাদের গ্রাম? বাটালিক? গ্রামের পরেই তো এল ও সি। ও পারেও গ্রাম আছে, আমাদেরই মতো। আর সেনা? সেনাও আছে। আমরা তো সেনা নিয়েই থাকি। কে কখন ঢুকছে, বেরোচ্ছে, কার সঙ্গে কথা বলছে, দোকানে কী কিনছে— সেনা সব জানে। সব সময় নজরদারি, সব সময় জেরা। সেনাকে বাদ দিয়ে আমাদের কোনও জীবন নেই। আর যুদ্ধের সময়? যুবক হেসে বলে, স্কুলে পড়তাম। দু’পারের গুলিই গ্রামের উপর দিয়ে ছুটে যেত! সে কী আওয়াজ!
আমাদের গাড়িটা একটি সেনা পোস্টে দাঁড়ায়। সেনা অফিসার বেরিয়ে এসে বলেন, দেড় কিলোমিটার দূরে এল ও সি। আর যেতে দেওয়া যাবে না। মুখ ঘুরিয়ে দেখি, নিঃশব্দে চলে যাচ্ছে যুবক। যেন চুপিসাড়ে মিলিয়ে যেতে পারলে বাঁচে। সেনা অফিসার আমাদের ছাড়েন না। আবার এক প্রস্ত নাম-ঠিকানা-বয়স... নিয়মরক্ষা, না বাজিয়ে দেখার সময় নেওয়া, কে জানে! কারগিলের রাস্তা ধরার পরে কেবলই মনে হতে থাকে, কোনও ঝামেলায় পড়বে না তো ছেলেটি? আমাদের সঙ্গে গল্প করার খেসারত দিতে হবে না তো? কিছু না বলে চুপচাপ চলে গেল কেন?
পড়ন্ত বিকেলের আলোয় দূর থেকে দেখতে পাই কারগিল শহর। ঠিক ১৪ বছর আগে এই নামটা জাতীয়তার যাবতীয় আবেগ উথলে দিয়েছিল। আজ জম্মুতে এত বড় ঘটনার দিনে কারগিল কী ভাবছে? কম সাবধানবাণী তো শুনিনি! কারগিল হয়ে শ্রীনগর যাব, বলামাত্র নানা রকম পরামর্শ দিতে শুরু করেছিলেন লে-র গাড়িচালকরা। ওখানে কিন্তু এ রকম পরিবেশ পাবেন না। এখানকার মতো ভাল ব্যবহার পাবেন না। আর ভুলেও কারগিলে কারও সঙ্গে বেশি কথা বলবেন না ওখানে কে কার চর, কিচ্ছুটি বোঝার উপায় নেই... এটাই কি বাস্তব অবস্থা, না কি পর্যটন ব্যবসার দড়ি টানাটানি?
বোঝার উপায় নেই। হোটেলের সব ক’টা টিভিতে মালয়েশিয়া আর পাকিস্তানের হকি ম্যাচ চলছে! চ্যানেল ঘোরাই, স্থানীয় চ্যানেল কারগিল টুডে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পাকিস্তানের জিও টিভি, অবশ্যই তাতে জম্মুর খবর নেই। আরও কিছু দূর গিয়ে পেলাম এবিপি নিউজ আর এনডিটিভি ইন্ডিয়া, সেখানে জম্মু হেডলাইন। রাস্তায় বেরিয়ে এক বইয়ের দোকানির সঙ্গে আলাপ জমাই। কংগ্রেসি পরিবার। দাদা রাজ্যের মন্ত্রীও ছিলেন। গড়গড় করে বলে যান, যুদ্ধের পর থেকে কত কোটি টাকার অনুদান এসেছে। কত উন্নয়ন হয়েছে ইত্যাদি। কারগিলের বড় অংশই শিয়া মতাবলম্বী। দোকানি বললেন, আমরা আজাদির লড়াইয়ে নেই। আমরা শান্তিপ্রিয়। আমরা গ্রেটার লাদাখ চাই। বুঝলাম, লাদাখের অংশ হয়েও কারগিল-বাটালিক নিজেকে একটু কোণঠাসা মনে করে তিব্বতিদের তুলনায়। আবার কাশ্মীরের সঙ্গেও পুরোটা একাত্ম হতে পারে না। অথচ মাঝখানে থেকে ভারত-পাক সীমান্ত সমস্যার আঁচ সমান ভাবে গায়ে লাগে। “আর একটু এগোলে গুলির দাগ দেখতে পাবেন এখনও। ভাবুন, এই বাজারের মধ্যেও গুলি ছুটে আসত! এল ও সি তো মাত্র চার-পাঁচ কিলোমিটার এখান থেকে! ও পারে স্বাধীনতা দিবস পালন হচ্ছে, এ ধার থেকে দেখতে পাই!”
কারগিল থেকে জোজিলা পর্যন্ত গোটা রাস্তাটাই যুদ্ধের স্মারক-সরণি। মাথার উপরে সেনা-কপ্টারের চক্কর। পথের পাশে উদগ্র বফর্স। টাইগার হিল, টোলোলিং, দ্রাস, মাশোক ভ্যালি— খবরের শিরোনামে থাকা এক-একটা নাম। জোজিলা পেরোলে সোনামার্গ। ভূস্বর্গে আহ্বান জানাবে সেনার ব্যানার: আপকি ফৌজ আপকে লিয়ে। শ্রীনগরে বাঙালি পর্যটক ভালই। শিকারা-চালকরা যদিও বলছেন, এ মরসুম ভাল যায়নি। ধরেই রেখেছেন, আগামী বছরও ভাল যাবে না। লোকসভা নির্বাচন আছে যে!
নিমেষে মনে হয়, জম্মু-কাশ্মীরের মধ্যেও দু’টো ভাগ আছে। যে অংশটা সরাসরি পর্যটন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত, তাদের চাওয়াপাওয়া এক রকম। আর খবরের ভাষায় যারা চিরকাল এল ও সি-র গ্রাম, তাদের রাগ-দুঃখ আলাদা। সংবাদমাধ্যম শুধু জানিয়ে চলে, সংঘর্ষবিরতি ভাঙছে। এল ও সি-র গ্রামে আতঙ্ক! স্কুলে যাচ্ছে না শিশুরা। ফসল কাটা যাচ্ছে না মাঠে! জঙ্গিই হোক বা সেনা, এক অনন্ত গুলি বিনিময়ের মধ্যে পড়ে আছে তারা।
ক্যামেরা তাক করতে গিয়ে হাত কাঁপে। গুলির আওয়াজ না? পরীমহলের রক্ষীরা জানান, হ্যাঁ। এয়ারপোর্ট রোডে গুলি চলছে। ও দিকে যাবেন না। আশ্চর্য! শহরের রাস্তায় গুলি চলছে, পরীমহলে প্রেমিক-প্রেমিকাদের গল্পে ব্যাঘাত নেই! লাল চকের বইয়ের দোকানে খলবল করে খালেদ হোসেইনির লেখা বেশি ভাল না অরুন্ধতী রায়, তর্ক করছে স্কুলছাত্রীরা। শিকারার দাঁড় টেনে অভয় দেন মাঝি, ও কিছু না! এয়ারপোর্ট রোডে গুলি চলছে বলে কি গোটা শহর থমকে যাবে? গুলি চলবে, কার্ফু লাগবে, আবার উঠেও যাবে!
জ্ঞানচক্ষু খুলল। সেই সিন্ধুপারের রাস্তা থেকে যে প্রশ্নটা মনের মধ্যে খচখচ করছিল, এত ক্ষণে যেন তার কিছুটা উত্তর পেলাম। এ যেন বড় রাস্তার ধারে বাড়ির মতো। নতুন মানুষ এসে ছটফট করবে। লাগাতার গাড়ির আওয়াজে কানে তালা ধরে যাবে। কিন্তু যারা ওই বাড়িতে থাকে, তারা থাকে। তাদের সয়ে গেছে।
কাশ্মীরেরও সয়ে গেছে। সেনা। কার্ফু। তল্লাশি। গুলির আওয়াজ। ও পারের গুলি, এ পারের গুলি। ও পার থেকে গুলি এলে সেনা গ্রাম খালি করে দেয়। মানুষ লোটাকম্বল বেঁধে রওনা হয়। সেনা-জঙ্গি সংঘর্ষ বাধলে দোর দিয়ে অপেক্ষা করে, কখন থামবে। আর, এ পারের সেনার গুলির মুখে পড়ে গেলে খেপে ওঠে। পাথর ছোড়ে।
সয়ে গেছে। মানুষ অভ্যাসের দাস। |
|
|
|
|
|