|
|
|
|
তিস্তা চুক্তি নিয়ে ফের চেষ্টা, ঢাকার তাড়ায় অস্বস্তি |
অগ্নি রায় • নয়াদিল্লি |
বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী দীপু মণি আগামী মাসে দিল্লি আসছেন। কিন্তু প্রতিবেশী দেশের বন্ধু সরকারের প্রতিনিধির সেই সফর নিয়ে যথেষ্ট অস্বস্তিতে বিদেশ মন্ত্রকের কর্তারা।
আগামী মাসের ১১ তারিখ ‘আসেম’ (এশিয়া-ইউরোপ বিদেশমন্ত্রী বৈঠক)-এ যোগ দিতে আসছেন দীপু মণি। সাউথ ব্লকের ধারণা, এই সফরে তো বটেই, হয়তো আসেম-এর মঞ্চে দাঁড়িয়েও তিস্তা জলবণ্টন চুক্তির দাবিতে সরব হবেন তিনি। এর আগে জুলাই-এর শেষে একটি স্মারক বক্তৃতা দিতে দিল্লি এসেও অবিলম্বে তিস্তা চুক্তি করার জন্য দিল্লিকে তাড়া দিয়ে গিয়েছিলেন দীপু। বিদেশ মন্ত্রকের কূটনীতিকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে তাঁরা চেষ্টার কসুর করছেন না। কিন্তু ঘরোয়া রাজনীতির এমন এক জটে গোটা বিষয়টি আটকে রয়েছে, তড়িঘড়ি কিছু করাটা তাঁদের হাতের বাইরে। তার পরেও দীপু মণি এসে বার বার তাগাদা দেওয়ায় বিদেশ মন্ত্রকের কূটনীতিকরা খুবই হতাশ।
বিদেশ মন্ত্রকের বক্তব্য, তিস্তা চুক্তি সম্পাদন করে বাংলাদেশ যাতে ন্যায্য পরিমাণ জল পায়, তার জন্য এই মুহূর্তে নতুন একটি চেষ্টা শুরু করা হয়েছে, পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘ট্র্যাক টু’ কূটনীতি। এই পরিস্থিতিতে ঢাকার পক্ষ থেকে ক্রমাগত চাপ এলে গোটা প্রয়াসটিই ভেস্তে যেতে পারে।
ঠিক কী করছে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক?
সাউথ ব্লক সূত্রের খবর, সংশ্লিষ্ট সমস্ত পক্ষকে এক ছাতার তলায় এনে ঐকমত্যের ভিত্তিতে তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নের নতুন সূত্র খোঁজা হচ্ছে। এই উদ্যোগের মূল শরিক ‘স্ট্র্যাটেজিক ফোরসাইট গ্রুপ’ (এসএফজি) নামে একটি ভারতীয় ‘থিংক ট্যাঙ্ক’, যারা বিশ্বের প্রায় পঞ্চাশটি দেশের মেধাসম্পদ সংক্রান্ত নীতি-নির্ধারণ নিয়ে কাজ করছে। তিস্তা চুক্তি নিয়েও কাজে নেমে পড়েছে তারা।
ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনকে নতুন করে সাজাতে গত জুলাই মাসে মুম্বইয়ে একটি গোল টেবিল বৈঠক করেছিল এসএফজি। দু’দেশের কূটনৈতিক কর্তারা তো বটেই, ছিলেন বিরোধী দলগুলির প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞরাও। সেই বৈঠকের সূত্র ধরেই এর পর নদী বিশেষজ্ঞ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে ৮৬ পাতার একটি রিপোর্ট তৈরি করেছে সংস্থাটি। রিপোর্টটি প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে পৌঁছনোর পরে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন আপাতত সে’টি খতিয়ে দেখছেন।
অন্য দিকে নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করবেন সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট সন্দীপ ওয়াজলেকর। রিপোর্টটিও তুলে দেবেন তাঁর হাতে। সে দেশের বিরোধী নেতাদের সঙ্গেও আলোচনা করবেন সন্দীপ। আলোচনা হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও। দীপু মণি আগামী মাসে দিল্লি এলে কথা হবে তাঁর সঙ্গেও।
কূটনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, কূটনৈতিক দৌত্যে যখন ফল হচ্ছে না তখন এ ভাবেই ‘ট্র্যাক টু’ আলোচনার মাধ্যমে গোটা বিষয়টিতে নতুন প্রাণ আনতে চাইছে নয়াদিল্লি। সন্দীপ ওয়াজলেকরের কথায়, তিস্তা জলবণ্টন নিয়ে যে নতুন চেষ্টা শুরু করা হচ্ছে তার মূল লক্ষ্য দু’টি। দেশের অভ্যন্তরীণ মতানৈক্যের অবসান ঘটানোর পাশাপাশি গোটা তিস্তা অববাহিকার বাস্তুতন্ত্র বা ইকো সিস্টেমের উন্নয়ন ঘটিয়ে স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা। মূলত তিন দফা সূত্র দেওয়া হচ্ছে প্রস্তাবে। যৌথ নদী কমিশনকে ঢেলে সাজা, নদী অববাহিকার পলি সরিয়ে জলপ্রবাহ ও সেচ বাড়ানো এবং ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সুষম জলবণ্টন। এ ছাড়াও চুক্তিটির শর্তগুলিকে নমনীয় করে তোলা, বর্ষাকালের উদ্বৃত্ত জল ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো, স্থানীয় শিল্পকে উৎসাহ দেওয়ার মতো বিষয়গুলিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
চুক্তিটি না হওয়ার কারণ হিসেবে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক মতপার্থক্যকেই প্রধানত চিহ্নিত করা হয়েছে। মনে করা হচ্ছে তিস্তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রের মতপার্থক্য কাটানোটাই এই মুহূর্তে বড় চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে ১৯৪৫ সালের একটি মার্কিন দৃষ্টান্তকে তুলে ধরা হয়েছে। সে সময় কলোরাডো নদীর জলবণ্টন নিয়ে আমেরিকা এবং মেক্সিকো একটি চুক্তি করতে উদ্যত হয়। প্রবল বাধা আসে কলোরাডোর নিম্ন অববাহিকায় অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়া থেকে।
চুক্তি অনুযায়ী মেক্সিকোকে যে জল দেওয়ার কথা, তাতে আপত্তি ছিল ক্যালিফোর্নিয়ার। সেনেট-এ দীর্ঘ চাপানউতোরের পর ‘ইন্টারন্যাশনাল বাউন্ডারি অ্যান্ড ওয়াটার কমিশনের’ মধ্যস্থতায় শেষ পর্যন্ত ১৯৪৫ সালে এই চুক্তিটি করা সম্ভব হয়। ক্যালিফোর্নিয়া বিষয়টি মেনে নেয়, কেন না ওই চুক্তির মধ্যে নমনীয়তাঅর্থাৎ উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং স্থানীয় মানুষের প্রয়োজনীয়তার মাপকাঠিতে সেটির বদলানোর অবকাশ রাখা হয়েছিল। ভারত-বাংলাদেশের চুক্তির ক্ষেত্রেও এই মডেলটি ভেবে দেখার কথা বলা হয়েছে।
বর্তমান খসড়াটিরও সমালোচনা করা হয়েছে এসএফজি-র রিপোর্টে। বলা হয়েছে, ‘শীতের সময়ে জলবণ্টনের ক্ষেত্রে ভারত এবং বাংলাদেশের যে দু’টি বিশেষ অঞ্চল (উত্তরপশ্চিম বাংলাদেশ এবং উত্তরবঙ্গ) সমস্যার মুখে পড়ে, তার উল্লেখ চুক্তির খসড়ায় রাখা হয়নি। শুধু উল্লেখই নয়, এই দুটি বিশেষ এলাকায় শীতকালে কী ভাবে জল ধরে রেখে পরিস্রুত করে কৃষি ও অন্য কাজে ব্যবহার করা যায়, তার দিশা থাকা প্রয়োজন। তা হলে রাজনৈতিক মতপার্থক্য কিছুটা কমতে বাধ্য।’
চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শুরু হয়েছে নতুন প্রয়াস। সেই প্রয়াসে তিস্তার জল এ বার গড়ায় কিনা, সেটাই এখন দেখার।
|
পুরনো খবর: রাজ্যের স্বার্থ রক্ষা করেই চুক্তি, তিস্তার জলবণ্টনে সায় মমতার
|
|
|
|
|
|