এ যেন সিনেমার থেকেও বেশি!
রাস্তায় দাঁড়িয়ে আঙুল তুলে এক পুলিশ অফিসারকে শাসাচ্ছেন আর এক পুলিশ অফিসার। পাল্টা তেড়ে আসছেন অন্য জনও। বচসা চলতে চলতেই চলে এলেন আরও কয়েক জন পুলিশকর্মী। তার পরে সকলে মিলে এক পুলিশ অফিসারকে তুলে গাড়ি নিয়ে রওনা দিলেন তাঁরা।
চোর-পুলিশের লড়াইয়ের খবর মেলে আকছারই। কিন্তু পুলিশে-পুলিশে লড়াই! বুধবার এমনই ‘কীর্তি’ গড়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার কলকাতা লেদার কমপ্লেক্স ও বিধাননগর কমিশনারেটের নিউ টাউন থানা। পুলিশই বলছে, রাস্তায় নেমে শুধু মারামারি নয়, এক থানার পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছে অন্য থানার পুলিশ অফিসারকেও! রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার মানচিত্রে শেষ কবে এমন ঘটেছে, মনে করতে পারছেন না রাজ্যের তাবড় তাবড় পুলিশকর্তারাও।
কী হয়েছে এ দিন? |
পুলিশ সূত্রের খবর, দুপুরে লেদার কমপ্লেক্স থানা ও নিউ টাউন থানার সীমানা এলাকা কোঁচপুকুরে দু’টি গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। কয়েক জন যাত্রী আহত হন। রাস্তাতেই হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন দুই গাড়ির চালক। এই ঘটনা চলার সময়ে সেখানে হাজির হয় নিউ টাউন থানার টহলদারি গাড়ি। ওই থানার কর্মীরা দুই চালকের বিবাদ মিটিয়ে চলে যেতে বলেন। নিউ টাউন থানার পুলিশ এলাকা ছাড়তেই সেখানে উদয় হয় লেদার কমপ্লেক্স থানার পুলিশ।
গোটা ঘটনা জানার পরে ওই থানার অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইনস্পেক্টর কাজি জাহাঙ্গির গাড়ি দু’টি আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
পুলিশ সূত্রের খবর, জাহাঙ্গির আটক করার কথা বলতেই এক গাড়িচালক চটজলদি মোবাইল ফোন মারফত নিউ টাউন থানার কর্মীদের ফোন করে ঘটনাটি জানান। গাড়ি ঘুরিয়ে ফের ঘটনাস্থলে হাজির হয় নিউ টাউন থানার পুলিশ। গাড়ি আটক করা হবে নাকি ছেড়ে দেওয়া হবে, এই নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। রাস্তায় তখন বেবাক দাঁড়িয়ে দুই গাড়িচালক।
একটি সূত্রের খবর, নিউ টাউন থানার সাব-ইনস্পেক্টর গৌরাঙ্গ নাথ জাহাঙ্গিরকে গাড়ি দু’টি ছেড়ে দিতে বলেন। জাহাঙ্গির পাল্টা জবাব দেন, “থানা এলাকার দুর্ঘটনা ঘটলে গাড়ি আটক করাই নিয়ম।” ব্যস, বেধে যায় পুলিশে-পুলিশে লড়াই!
পুলিশের একাংশের অভিযোগ, গৌরাঙ্গ ও তাঁর সহকর্মীরা জাহাঙ্গিরকে মারধর করে জিপে তুলে নেন। রওনা দেন নিউ টাউন থানার দিকে। গোটা ঘটনার বিস্ময় কাটতেই জাহাঙ্গিরের সহকর্মীরা খবর দেন উপরওয়ালাদের। ব্যাপারটা ঘোরালো বুঝতে পেরে নিউ টাউন থানায় পৌঁছে যান দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের কর্তারা। খবর পেয়ে নিউ টাউন থানায় হাজির হন বিধাননগর কমিশনারেটের এডিসিপি সন্তোষ নিম্বলকরও।
শুধু পুলিশ নয়, সন্ধ্যায় নিউ টাউন থানায় হাজির হয়েছিলেন ভাঙড়ের তৃণমূল বিধায়ক আরাবুল ইসলাম ও রাজারহাট-নিউ টাউনের তৃণমূল বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত। সব্যসাচীবাবু বলেন, “আমার ও আরাবুলের হস্তক্ষেপে পুলিশের মতবিরোধ মিটে গিয়েছে।” তবে আরাবুল বলছেন, “পুলিশ যদি নিজেরাই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, তা হলে সাধারণ মানুষের ভরসা উঠে যাবে।” রাতে নিউ টাউন থানা থেকে ছাড়িয়ে আনা হয় জাহাঙ্গিরকে।
শাসকদলের বিধায়কেরা মুখ খুললেও ভরদুপুরে পুলিশি লড়াই নিয়ে কিন্তু বেশি কথা বলতে নারাজ পুলিশকর্তারা। ডিআইজি (প্রেসিডেন্সি রেঞ্জ) আনন্দ কুমার বলেন, “সংঘর্ষের কারণ ও সীমানা এলাকার ওই জায়গার বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।” বিধাননগর কমিশনারেটের এডিসিপি সন্তোষ নিম্বলকর বলেন, “ওই এলাকার সংঘর্ষের বিষয়ে তদন্ত চলছে। আমরা সব দিক খতিয়ে দেখছি।” তবে পুলিশের একটি সূত্রের খবর, জাহাঙ্গির ও গৌরাঙ্গ, দু’জনের বিরুদ্ধেই বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পুলিশের একটি সূত্র অবশ্য বলছে, নিউ টাউন থানায় বিষয়টি মেটাতে এসে চাপান-উতোরে জড়িয়ে পড়েন পদস্থ কর্তারাও। কেন এক দুর্ঘটনাস্থলে দু’টি থানার পুলিশ হাজির হল, তা নিয়ে পরিষ্কার উত্তর মেলেনি কর্তাদের কাছ থেকে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের এক কর্তার দাবি, ‘‘দুর্ঘটনাস্থল আমাদের এলাকায়। তাই লেদার কমপ্লেক্স থানার পুলিশ গিয়েছিল।” উল্টো দিকে, বিধাননগরের পুলিশকর্তারা রাতেও বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশায় রয়েছেন। এক পুলিশকর্তার বক্তব্য, “জায়গাটা কার, তা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে।”
পুলিশকর্তারা সাবধানী মন্তব্য করলেও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের একটি সূত্র কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছেন নিউ টাউন থানার বিরুদ্ধে।
এক অফিসারের মন্তব্য, “মানবাধিকার আইনে চোর-ডাকাতকেও মেঝেতে কম্বল পেতে বাসাতে হয়। সেখানে পুলিশ হয়ে আর এক জন পুলিশকর্মীকে খালি মেঝেতে বসিয়ে রেখেছিল!”
যদিও অভিযোগ মানতে চাননি সন্তোষ নিম্বলকর। তিনি বলেন, “মাটিতে বসানো হয়নি।” |