ব্যবসা শুরুর প্রথম ধাপ
নেক ভাবনা-চিন্তা, হিসেব-নিকেশের পর একটা ব্যবসা শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কী ব্যবসা করবেন, কোথায় করবেন, সব ঠিক। অপেক্ষা শুধু ময়দানে কোমর বেঁধে নেমে পড়ার। আর এখানে দাঁড়িয়ে প্রথমেই আপনার যা দরকার, সেটি হল ট্রেড লাইসেন্স বা সার্টিফিকেট অফ এনলিস্টমেন্ট। অর্থাৎ ব্যবসা করার প্রাথমিক অনুমতিপত্র। যে-কোনও জায়গায়, যে কোনও ধরনের ব্যবসা শুরু করার প্রাথমকি শর্ত এই অনুমতিপত্র হাতে পাওয়া। তার পর শুরু হবে বাকি কাজ। তাই চলুন আজ এই ট্রেড লাইসেন্স-এর খুঁটিনাটি নিয়েই একটু আলোচনায় বসি আমরা।

কেন?
আপনার ব্যবসার নামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টই খোলা যাবে না, যদি ট্রেড লাইসেন্স না-পেয়ে থাকেন। তা ছাড়া, টেন্ডার জমা দিতে, প্রফেশনাল ট্যাক্স, সেলস ট্যাক্স (ভ্যাট), সার্ভিস ট্যাক্স, সেন্ট্রাল এক্সাইজ, কাস্টমস, শপস্ অ্যান্ড এস্টাব্লিশমেন্টস, পিএফ, ইএসআই আইনের আওতায় রেজিস্ট্রেশন বা এনরোলমেন্ট করাতে হলেও প্রাথমিক ভাবে দরকার পড়ে এটির।

কে দেয়?
কলকাতায় ট্রেড লাইসেন্স দেয় কলকাতা পুরসভার (কেএমসি) লাইসেন্স দফতর। আর অন্যান্য জেলাশহরে দেয় সংশ্লিষ্ট মিউনিসিপ্যালিটি এবং গ্রামাঞ্চলে সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েত। একটা কথা মনে রাখবেন, প্রথম বার নতুন ট্রেড লাইসেন্স নেওয়ার সময়ে, যেখান থেকে সেটি হাতে দেওয়া হচ্ছে সেই দফতরেই নগদে টাকা জমা দিতে হয়। নতুন লাইসেন্স দেওয়ার পাশাপাশি পুরনো লাইসেন্সের নবীকরণ বা অস্থায়ী লাইসেন্স দেওয়ার মতো কাজও হয় ওই দফতর থেকেই।

কীসের ভিত্তিতে
দু’টি বিষয়ের ভিত্তিতে দেওয়া হয় ওই অনুমতিপত্র। এক, যে-জায়গায় আপনি ব্যবসা করবেন, সেই অঞ্চলের জন্য। এবং দুই, যে-ধরনের ব্যবসা করবেন বলে ঠিক করেছেন, সেটির জন্য।
ধরুন, আপনি আলিপুর ও বেহালায় দু’টি বুটিক খুলতে চান। তা হলে আপনাকে দু’টি এলাকার জন্য আলাদা আলাদা লাইসেন্স নিতে হবে।
আবার যদি এমন হয় যে, আপনি কোনও জায়গায় একটি বুটিকের পাশাপাশি একটি ওষুধের দোকানও খুলতে চাইলেন। সে ক্ষেত্রেও দু’ধরনের ব্যবসার জন্য পৃথক লাইসেন্স চাই আপনার।

আবেদনপত্র নিতে
ট্রেড লাইসেন্স পাওয়ার জন্য আবেদন জানাতে প্রথমে আবেদনপত্র সংগ্রহ করতে হয়। এটি সংশ্লিষ্ট কর্পোরেশন, মিউনিসিপ্যালিটি বা পঞ্চায়েত থেকেই পাওয়া যায়। তবে এ ক্ষেত্রে কলকাতার বাসিন্দারা খানিকটা সুবিধা ভোগ করেন। কারণ তাঁদের কষ্ট করে কলকাতা পুরসভায় না-গেলেও চলে। চাইলে কেএমসি-র ওয়েবসাইট থেকেই (www.kmc.gov.in বা www.kolkatamycity.com) ওই আবেদনপত্র ডাউনলোড করে নেওয়া যায়।

সঙ্গে যা লাগবে
আবেদনপত্র তো নিলেন। ঠিকঠাক ভর্তিও করলেন। কিন্তু শুধু সেটি জমা দিলেই তো চলবে না। সঙ্গে আরও কিছু জরুরি তথ্য পেশ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে যে-জায়গায় ব্যবসা করবেন বলে ঠিক করেছেন, সেটি কী ভাবে আপনার হাতে আসছে বা তার মালিকানা সত্যিই আপনার কি না, তার উপর নির্ভর করেই স্থির হবে কোন তথ্য জমা দিতে হবে। যেমন—
নিজস্ব জায়গা হলে: জমা দিতে হবে ওই জায়গার জন্য পুরসভাকে যে সম্পত্তি কর দেওয়া হয়, তার প্রমাণস্বরূপ শেষ রসিদ/ বিল/ জায়গাটির রেজিস্ট্রিকৃত দলিলের কপি/ রেজিস্ট্রি অফিস থেকে প্রাপ্ত দলিলের আইনজীবী দ্বারা সার্টিফায়েড রসিদ (যা থেকে বোঝা যাবে আপনার নামেই সেটি কেনা হয়েছে)।
ভাড়া নেওয়া হলে: দিতে হবে শেষ ভাড়ার রসিদ/ চালান/ বিল/ রেন্ট কন্ট্রোলের থেকে ভাড়া নেওয়ার জন্য করা চুক্তিপত্র।
লিজ নেওয়া হলে: লাগবে লিজের দলিল/ রেন্ট কন্ট্রোল থেকে লিজ নেওয়ার জন্য করা চুক্তিপত্র।
জায়গাটির মালিকের থেকে বিনা ভাড়ায় নেওয়া হলে: লাগবে এ বিষয়ে ওই মালিকের সম্মতিপত্র। ফোটোকপি নয়, জমা দিতে হবে আসল পত্রটি।
ব্যবসরা জন্যই ভাড়া নিয়েছেন, এমন কারও থেকে জায়গাটি বিনা ভাড়ায় নেওয়া হলে: জমা দিতে হবে আগের ভাড়াটিয়ার সম্মতিপত্র। সঙ্গে তাঁর বর্তমান ট্রেড লাইসেন্স।
ব্যবসার জন্যই ভাড়া নিয়েছেন, এমন কারও থেকে জায়গাটি ভাড়া নেওয়া হলে: জায়গাটির আসল মালিক যিনি, তাঁর সম্মতিপত্র লাগবে। সেই সঙ্গে অন্যান্য তথ্য, যেমন ভাড়ার রসিদ/ মূল ভাড়াটিয়া ব্যবসায়ীর ট্রেড লাইসেন্স ইত্যাদি।
কোন সরকারি বাজার, পুরসভার বাজার বা সরকারি চত্বরে (যেমন, কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন, ক্যালকাটা পোর্ট ট্রাস্ট, ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট ইত্যাদি অঞ্চলভুক্ত কোনও ক্যাম্পাস) ব্যবসা করলে: আসল ভাড়াটিয়ার নামেই ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হয় এই সব জায়গায়। এখানে ভাড়া নেওয়া জায়গা ফের কাউকে ব্যবসার জন্য ভাড়া দেওয়া যায় না। এমনকী তা কাউকে বিনা ভাড়ায় ব্যবহারও করতে দিতে পারেন না সংশ্লিষ্ট ভাড়াটিয়া।
কো-অপারেটিভ হাউসিং সোসাইটিতে জায়গা নিলে: দিতে হবে সেই সোসাইটির সেক্রেটারি বা সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রকের সম্মতিপত্র।
সরকারি আবাসন চত্বরে ব্যবসা করতে: দরকার ওই হাউসিং এস্টেট ম্যানেজারের সাম্প্রতিক ছাড়পত্র।
কোনও পেশাদার তাঁর পেশা সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যবসা শুরু করতে চাইলে: তাঁর পেশার প্রমাণ হিসেবে নির্দিষ্ট তথ্য পেশ করতে হবে।
নির্দিষ্ট কিছু ব্যবসার ক্ষেত্রে: ট্রেড লাইসেন্স পেতে এ সব ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা আইনি নিয়ন্ত্রকের অনুমোদন/ ছাড়পত্র জরুরি।

সংস্থা হলে
কোনও কোম্পানি বা প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি যখন ব্যবসা শুরু করে, তখন ট্রেড লাইসেন্স পাওয়ার আবেদনপত্রের সঙ্গে যেখানে ব্যবসা করা হবে, সেই জায়গার মালিকানা সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণ তো লাগবেই (উপরের তালিকা অনুযায়ী)। সঙ্গে জমা দিতে হবে
• মেমর‌্যান্ডাম/ আর্টিক্ল অফ অ্যাসোসিয়েশন।
• রেজিস্ট্রার অফ কোম্পানিজ-এর থেকে ৩২ ও ১৮ নম্বর ফর্মে ডিক্লারেশন। সঙ্গে টাকা জমা দেওয়ার রসিদ।
যৌথ অংশীদারি সংস্থা (পার্টনারশিপ ফার্ম) হলে জমা দিতে হবে—
• যৌথ অংশীদারি দলিল (পার্টনারশিপ ডিড)।

এ ছাড়া যেখানে যে ধরনের ব্যবসাই শুরু করুন না কেন, তার জন্য আপনাকে একটি হলফনামা (অ্যাফিডেভিট) দাখিল করতেই হবে। তাতে বলতে হবে, যে-ধরনের ব্যবসা আপনি করছেন, তার জন্য যদি ভবিষ্যতে কখনও ফায়ার লাইসেন্স বা পুলিশ লাইসেন্স নেওয়ার দরকার আইনত পড়ে, তা হলে সেটা নিতে আপনি বাধ্য থাকবেন।

বিশেষ কিছু ব্যবসার ক্ষেত্রে
মদ বা অস্ত্র জাতীয় পণ্যের ব্যবসা: পুলিশ ও এক্সাইজের ছাড়পত্র/ অনুমোদন নিতে হবে।
পরিবহণ ক্ষেত্রের এজেন্ট: গাড়ি সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য (ব্লু-বুক বা স্মার্ট কার্ড), গাড়ি বিমা, পাবলিক ভেহিক্ল দফতর থেকে গাড়ি ঠিক আছে কি না, তার প্রমাণ হিসেবে সার্টিফিকেট অফ ফিটনেস ইত্যাদি জমা দিতে হবে।
দাহ্য বা বিস্ফোরোক বস্তু: ফায়ার লাইসেন্স বা ডিরেক্টরেট অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল ফায়ার সার্ভিসেস-এর অনুমোদন এবং বন্দুক/ বারুদ/ বাজি ইত্যাদির জন্য এক্সপ্লোসিভ লাইসেন্সও লাগবে।
ওষুধের দোকান: পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট আইনের আওতায় রেজিস্ট্রেশনের (টি আর ফর্ম নম্বর ৭) জন্য টাকা জমা দেওয়ার রসিদ দিতে হবে।
নার্সিংহোম/ হাসপাতাল/ প্যাথোলজিক্যাল ল্যাবরেটরি/ ডায়াগনোস্টিক সেন্টার: পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট আইনের আওতায় লাইসেন্স বা অনুমতিপত্র দিতে হবে।
ক্লিয়ারিং/ ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট: সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রকের (কাস্টমস/ এক্সাইজ ইত্যাদি) কাছ থেকে নেওয়া এজেন্সি সার্টিফিকেট পেশ করতে হবে।
গান বা নাচকে পেশা করলে: রেশন কার্ডের কপি/ পাসপোর্ট/ ভোটার আইডেন্টিটি কার্ড/ প্যান কার্ড/ দু’টি পাসপোর্ট সাইজের ফোটো/ যদি কোনও সংস্থা গান বা নাচের পেশাদার হিসেবে তাঁদের নিযুক্ত করতে চান, তা হলে নিয়োগকারী সংস্থার অনুমোদন এবং তাদের ট্রেড লাইসেন্স লাগবে।
রেশনের দোকান/ অন্যান্য সরকারি বিপণি: দিতে হবে খাদ্য দফতর-সহ অন্যান্য নিয়ন্ত্রকের অনুমোদন।
লাইসেন্স পেতে
• আবেদনপত্র সংগ্রহ করুন।
• ব্যবসার জায়গা ও তার মালিকানার তথ্য-প্রমাণ-সহ সেটি জমা দিন সংশ্লিষ্ট দফতরে।
• যিনি জমা নেবেন, তিনি প্রাথমিক যাচাইয়ের পর সেটি পাঠাবেন লাইসেন্স অফিসারের কাছে।
• লাইসেন্স অফিসার ব্যবসার যোগ্যতা বিচার করে তা পাঠাবেন তাঁর অধীনে থাকা লাইসেন্স অফিসার
বা ইন্সপেক্টর বা বেলিফের কাছে।
• বেলিফ বা লাইসেন্স ইন্সপেক্টর ব্যবসার প্রস্তাবিত এলাকা পরিদর্শন করবেন। ফের খতিয়ে দেখবেন প্রদত্ত তথ্য।
• সব ঠিকঠাক আছে মনে করলে তাঁরা সঙ্গে সঙ্গেই লাইসেন্স দিতে পারেন। কিংবা তাঁদেরই সুপারিশে
লাইসেন্স দফতরের কাউন্টার থেকে তা দেওয়া হতে পারে।
• টাকা বেলিফ বা লাইসেন্স ইন্সপেক্টরের মাধ্যমে অথবা সরাসরি কাউন্টারে জমা করতে পারেন।
• সাধারণত সাত দিনের মধ্যে নতুন লাইসেন্স দেওয়ার কথা। তবে অনেক সময় সঙ্গে সঙ্গেই দিয়ে দেওয়া হয়।
• যদি লাইসেন্স পেতে দেরি হয়, তবে সংশ্লিষ্ট লাইসেন্স অফিসার বা ডেপুটি লাইসেন্স অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

লেখক আইনজীবী ও কর বিশেষজ্ঞ


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.