মোটরবাইকের মতো হ্যান্ডেল ধরে চালক সামনে সওয়ার। পিছনের পাটাতনে অন্তত জনা দশেক আরোহী কিংবা বিস্তর পসরা নিয়ে ছুটছে ভ্যানগাড়ি, কানফাটানো ভট ভট শব্দ ছড়িয়ে। কটু গন্ধের কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে চারপাশ।
গ্রামবাংলায় যান-দূষণের জন্য যার বদনাম সবচেয়ে বেশি, মোটরচালিত এই তিন চাকার ভ্যান-রিকশা (পরিচিত নাম, ভ্যানো)-কে এ বার বৈধতা দিতে চলেছে রাজ্য সরকার। যে খবর শুনে বিজ্ঞানী-পরিবেশবিদেরা প্রমাদ গুনতে শুরু করেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) সম্প্রতি বায়ু-দূষণকে ক্যানসারের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তার পরেও বায়ু-দূষণের এত বড় একটি উৎসকে বৈধতাদানের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা।
বস্তুত গ্রামে-গঞ্জে তো বটেই, এমনকী কিছু আধা শহর-মফস্সলেও এই মুহূর্তে বাস-ট্রেকারের বিকল্প হিসেবে গণ পরিবহণের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে ভ্যানো। কিন্তু মোটরচালিত ত্রিচক্র যানটির আদৌ কোনও প্রশাসনিক অনুমোদন নেই। নেই নাম্বার প্লেট, পারমিট, বা চালক লাইসেন্সের বালাই। যে যেমন ইচ্ছে, ভ্যান-রিকশায় মোটর লাগিয়ে যাত্রীবহনের ব্যবসায় নেমে পড়ছেন বলে অভিযোগ। তবে এ বার রাজ্য সরকার ভ্যানো-কে স্বীকৃতিদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারি মহলের দাবি, অটোর মতো ভ্যানোরও ‘রুট’ বেঁধে দেওয়া হবে, যাত্রীসংখ্যাও নির্দিষ্ট গণ্ডি ছাড়াতে পারবে না। |
অর্থাৎ, ভ্যানো ছুটবে পুরোপুরি নিয়মানুগ পথেই। প্রশাসন সূত্রের খবর, গত পঞ্চায়েত ভোট ও তার পরে বেশ ক’টি পুরভোটের প্রচারে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিক বার ঘোষণা করেছিলেন, ভ্যানোকে বৈধতা দেওয়া হবে। প্রক্রিয়াটি যাতে দ্রুত শুরু হয়, সে জন্য সেপ্টেম্বরের শেষে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। নির্দেশ পেয়ে প্রথমে পরিবহণ-কর্তারা ও পরে পরিবহণ সংক্রান্ত মন্ত্রিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা আলাদা আলাদা বৈঠকে বসেন পুজোর আগে। দু’টিতেই ভ্যানোয় বৈধতাদানের প্রস্তাবে সিলমোহর পড়েছে। আপাতত মুখ্যমন্ত্রীর চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষা। সেই অনুমোদন এলেই আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হবে।
এবং মুখ্যমন্ত্রীর সবুজ সঙ্কেত খুব শিগগিরই মিলবে বলে আশা করছেন রাজ্য পরিবহণ দফতরের কর্তারা। অন্য দিকে অশনি সঙ্কেত দেখছেন বিজ্ঞানী-পরিবেশবিদেরা। যাঁদের আশঙ্কা, স্বীকৃতির তকমায় বলীয়ান হয়ে ভ্যানোর দাপাদাপি আরও বাড়বে, ফলে পরিমণ্ডলে দূষণ ছড়াবে আরও বেশি মাত্রায়।
ভ্যানোয় এত দূষণ কেন?
বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা: ভ্যানো ‘কাটা তেল’-এ চলে, যা তৈরি হয় চুরি করা ডিজেলের সঙ্গে কেরোসিন ও মিথেন মিশিয়ে। স্বভাবতই ‘কাটা তেলের’ দাম কম। কিন্তু তা দূষণ ছড়ায় অনেক বেশি। অন্যান্য যানের তুলনায় তার ধোঁয়ায় থাকে দ্বিগুণ সিসা ও কার্বন মনোক্সাইড। পরিবেশবিদদের আরও দাবি: ভ্যানোর মতো গাড়িতে বসানো কম ক্ষমতা (অশ্বশক্তি বা হর্সপাওয়ার)-র ইঞ্জিনের উপরে বেশি চাপ পড়ে বলেও তার দূষণ-ক্ষমতা সাংঘাতিক। মানবশরীর ও পরিবেশের উপরে এর ক্ষতিকর প্রভাব বহু গুণ বেশি। পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তের বক্তব্য, প্রচুর ভ্যানো চালানো হয় চোরাই মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন বসিয়ে। শব্দ-দূষণের মতো তা প্রচুর মাত্রায় বায়ু-দূষণও সৃষ্টি করে। “এ হেন একটি যানকে রাজ্য সরকার স্বীকৃতি দিলে খুবই অন্যায় হবে।” বলছেন তিনি। পরিবেশ-প্রযুক্তিবিদ সোমেন্দ্রমোহন ঘোষ অবশ্য মনে করেন, দূষণ এড়িয়েও ভ্যানো চালানো যেতে পারে। তাঁর কথায়, “প্রযুক্তির সাহায্যে ভ্যানোয় ব্যবহৃত কাটা তেল যদি পুরোপুরি বাষ্পীভূত করা যায়, তা হলে দূষণের মাত্রা অনেকটা কমানো সম্ভব।”
কিন্তু তেমন প্রযুক্তি অদূর ভবিষ্যতে বলবৎ হওয়ার ইঙ্গিত নেই। সরকারের অভিমত কী?
পরিবহণমন্ত্রী মদনবাবু কিংবা মন্ত্রিগোষ্ঠীর প্রধান তথা শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ভ্যানো-র দূষণ প্রসঙ্গে কেউ কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে তাকে বৈধতাদানের সমর্থনে কিছু ‘যুক্তি’র কথা শোনা গিয়েছে প্রশাসনের অন্দরমহলে। কী রকম?
প্রশাসন-সূত্রের খবর: সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্ট জানিয়ে দিয়েছে, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নম্বর বা চালকের লাইসেন্স না-থাকায় ভ্যানো চালানোর অনুমতি দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, আইনি স্বীকৃতিহীন যানের কোনও যাত্রী দুর্ঘটনায় হতাহত হলে বিমার ক্ষতিপূরণ মিলবে না। এ ব্যাপারে অবিলম্বে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। আর তাতে ভর করেই নিজের যুক্তি সাজাচ্ছে রাজ্য। “ভ্যানো নিষিদ্ধ করার কথা হাইকোর্ট কখনও বলেনি। তাই ভ্যানোকে বৈধ করারই পথে হাঁটছে সরকার। সিদ্ধান্তটি কার্যকর হলে কোর্টের তোলা প্রশ্নগুলোর সুরাহা হবে।” বলছেন সরকারের এক শীর্ষ কর্তা। পরিবহণ দফতরের হিসেব উদ্ধৃত করে তাঁর দাবি, “রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে ৭৫ হাজারের বেশি ভ্যানো চলে। বহু মানুষের রুটি-রুজি জড়িয়ে। তাই একে নিষিদ্ধ করা সম্ভব নয়।”
কিন্তু স্বীকৃতিহীন কোনও যান বেশি সংখ্যায় চললেই তাকে সরকারি বৈধতা দিয়ে দেওয়াটা কি যুক্তিসম্মত?
পরিবেশবিদ ও পরিবেশ-বিজ্ঞানীদের একাংশ প্রশ্নটি তুলেছেন। সরকারি পদক্ষেপকে ‘অনভিপ্রেত’ হিসেবেও অভিহিত করেছেন কেউ কেউ। পরিবেশবিদদের একটি মহলের আক্ষেপ, “চালক বা মালিকেরা তো আছেনই, বিভিন্ন মফস্সল এলাকায় ভ্যানো তৈরির বিস্তর কারখানাও গজিয়ে উঠেছে। সেখানেও বহু মানুষ নিযুক্ত। এক ধাক্কায় এত লোককে বেকার করে দেওয়ার ঝুঁকি সরকার নিতে চাইছে না। এখানে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা কাজ করছে।” প্রশাসনিক মহলে আবার ভিন্ন একটা তত্ত্বও আলোচিত হচ্ছে। পরিবহণ-কর্তাদের একাংশ বলছেন, গত ক’বছর ধরে গোটা রাজ্যে সরকারি-বেসরকারি বাসের সংখ্যা কমছে। জ্বালানি-মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভাড়া না-বাড়ায় বহু মালিক বাস বসিয়ে দিচ্ছেন। এমতাবস্থায় শহরে যেমন যাতায়াতের অন্যতম ভরসা হয়ে উঠেছে অটোরিকশা, তেমন গ্রামের ‘লাইফলাইন’ হয়ে উঠেছে ভ্যানো। “পরিস্থিতি বুঝে সরকারও ভ্যানোর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।’’ মন্তব্য এক কর্তার।
সরকারি প্রয়াসকে স্বাগত জানিয়েছে তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন। আইএনটিটিইউসি’র রাজ্য সভানেত্রী দোলা সেন বলেন, “পরিবহণ ক্ষেত্রে বাম আমলে যে যে অনিয়ম হয়েছে, সেগুলি আইনের আওতায় নিয়ে আসা বর্তমান সরকারের লক্ষ্য। ভ্যানো-কে নিয়মের আওতায় আনার উদ্যোগ প্রশংসনীয়।” বিষয়টিকে ঘিরে উদ্ভুত যাবতীয় সংশয়ের সমাধান করে, সব বিধি মেনেই সরকার ভ্যানোয় অনুমোদনদানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছেন দোলাদেবী।
পরিবহণ দফতর অবশ্য ভ্যানো-পারমিটের দায়িত্ব নিজের হাতে রাখছে না। মন্ত্রিগোষ্ঠীর বৈঠকে স্থির হয়েছে, ওই পারমিট দেবে সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েত বা পুরসভা। কোন রুটে কতগুলো ভ্যানো চলবে, কোথায় কত যাত্রী তোলা হবে, তা-ও তারা বেঁধে দেবে। সোমেন্দ্রমোহনবাবু জানাচ্ছেন, ভ্যানোর ইঞ্জিন এক অশ্বশক্তির কম হওয়ায় তার পারমিট দেওয়ার অধিকার পরিবহণ দফতরের নেই। তাই স্থানীয় প্রশাসনকে সে ভার নিতে হবে।
পারমিট বাবদ ভ্যানোপিছু পাঁচশো টাকা ‘ফি’ নেওয়ারও প্রস্তাব দিয়েছে মন্ত্রিগোষ্ঠী। |
মারণ মিশেল |
• ভ্যান-রিকশায় আধা অশ্বশক্তির ইঞ্জিন জুড়ে তৈরি হচ্ছে মোটর ভ্যান, সংক্ষেপে ভ্যানো
• বসানো হচ্ছে জল তোলার পাম্পসেট কিংবা চোরাই মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন
• জ্বালানি বলতে মূলত ‘কাটা তেল।’ ডিজেলে কেরোসিন ও মিথেনের ভেজাল
• দাম লিটারপিছু মোটামুটি ৩০ টাকা। এক লিটার ভরলেই ৪০ কিলোমিটার
• ডিজেল-পাম্পের মতো দড়িতে জোরে টান দিলেই ঘরঘর শব্দে ইঞ্জিন চালু
• বায়ু-দূষণের আড়ত। কালো ধোঁয়ায় মাত্রাতিরিক্ত সিসা ও কার্বন-মনোক্সাইড। প্রভূত শব্দদূষণও
• দুই ২৪ পরগনা ও মেদিনীপুরের গ্রামাঞ্চলে জনপ্রিয়তার শিখরে ভ্যানো |
|