এক দিকে স্বর্গোদ্বারের শ্মশানে শবদেহ পুড়ছে। সমুদ্রের হাওয়ার সঙ্গে মিশে বাতাসে ঘুরপাক খাচ্ছে চিতার ধোঁয়া ও ছাই। ক’পা দূরেই সমুদ্রতীর জুড়ে খোলা খাবারের সারি সারি দোকান, পর্যটকের গিজগিজে ভিড়।
ওড়িশার তীর্থস্থান তথা ভ্রমণকেন্দ্র পুরীতে এ অতি চেনা ছবি। সেখানকার সর্বব্যাপী দূষণের একটা খণ্ডচিত্রও। শহরের অসংখ্য বাড়ি, লজ-হোটেল থেকে দূষিত জল-সহ বিভিন্ন বর্জ্য পুরসভার নিকাশি নালা বেয়ে অহরহ সাগরে গিয়ে মিশছে। উপরন্তু পথে-ঘাটে ডাঁই করা কঠিন বর্জ্যের প্রায় ৫০ % প্লাস্টিক, তার চাপে দমবন্ধ হয়ে পরিবেশের নাভিশ্বাস। বস্তুতই পুরীর জল-স্থল-বায়ু, সর্বত্র দূষণের থাবা। যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সুরাহার প্রথম ধাপ হিসেবে আট সদস্যের একটি উচ্চ-পর্যায়ের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিল নয়াদিল্লির জাতীয় পরিবেশ আদালত (ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল)।
পুরীর পর্যটক ও জগন্নাথ মন্দিরের দর্শনার্থীদের একটা বড় অংশ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি। আর পুরীর পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য জাতীয় পরিবেশ আদালতে পেশ করে প্রতিবিধান চেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গেরই পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত। তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই মঙ্গলবার এই নির্দেশ। বিচারপতি স্বতন্ত্র কুমারের নেতৃত্বে বিচারপতি বিএস রেড্ডি ও দুই বিশেষজ্ঞ ডি কে অগ্রবাল এবং আর সি রেড্ডিকে নিয়ে গড়া জাতীয় পরিবেশ আদালতের বেঞ্চ এ দিন জানিয়েছে, কমিটির সদস্যেরা পুরী গিয়ে পরিবেশগত সমস্ত দিক খতিয়ে দেখবেন। আগামী ছ’সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট দাখিল করতে হবে। কমিটির চেয়ারম্যান কে হবেন, বেঞ্চ তা-ও স্থির করে দিয়েছে। তিনি ওড়িশা প্রশাসনের শীর্ষ আমলা, অর্থাৎ স্বয়ং মুখ্যসচিব। |
সুভাষবাবু আদালতে বলেন, কোনও ধর্মস্থানকে কেন্দ্র করে বিশ্বের কোথাও এত দূষণ হয় না, যেমনটা পুরীতে হচ্ছে। তাঁর দাবি, পুরীর মন্দিরে রোজ এক লক্ষ মানুষের রান্না হয়, তিনশো কাঠের উনুনে। সমস্ত উনুনের ধোঁয়া বাতাসে মিশছে। আবার উপকূল-আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সমুদ্রতট দখল করে গজিয়ে উঠেছে সার সার হোটেল। “নিয়ম ভাঙার খেসারত এ বার দিতে হচ্ছে।” মন্তব্য করেন তিনি। ক’দিন আগে আছড়ে পড়া ঘূর্ণিঝড় পিলিনের উল্লেখ করে সুভাষবাবু বলেন, “ঝড়ের সময়ে সাগরের ঢেউ পুরীর কয়েকটি হোটেলের দোতলা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। গোটা রাস্তা বালিতে ঢেকে যায়। আইন ভাঙার পরিণতিতে প্রকৃতির রোষে মানুষের জীবন ও সম্পত্তি বিপন্ন হয়ে পড়ছে।”
পুরীতে দূষণের বাড়বাড়ন্তে জাতীয় পরিবেশ আদালতের উদ্বেগও এ দিন প্রকাশ পেয়েছে। বেঞ্চের মতে, পুরী-পরিবেশের অবক্ষয় নিয়ে ওড়িশা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের যে রিপোর্ট, তাতে বিপদের ইঙ্গিত স্পষ্ট। রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, পুরীর নিকাশি নালার জলে বিভিন্ন বিষাক্ত উপাদানের উপস্থিতি অনুমোদিত মাত্রার কয়েকশো গুণ। আবার স্বর্গোদ্বারের বাতাসে বিভিন্ন উপাদানের পরিমাণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে কোথাও পাঁচ গুণ, কোথাও বা সাত গুণ বেশি! সুভাষবাবুর কথায়, “স্বর্গোদ্বারের শ্মশানের ছাই হামেশা ঝোড়ো বাতাসে উড়ে গিয়ে সমুদ্রতীরে পর্যটকদের খাবারে গিয়ে পড়ছে। ধোঁয়া থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এটা ভয়ানক। পরিত্যক্ত পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল, ক্যারিব্যাগের পাহাড় প্লাস্টিকের শহর বানিয়েছে।”
ওড়িশা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের রিপোর্টও বলছে, কঠিন বর্জ্য শোধন ও বিনষ্ট করতে পুরী পুরসভার যে বন্দোবস্ত, তা আদৌ সন্তোষজনক নয়। তা সত্ত্বেও রাজ্য প্রশাসনের একাংশের তরফে পুরীর ‘সন্তোষজনক’ পরিবেশ-চিত্র তুলে ধরার প্রয়াস দেখে জাতীয় পরিবেশ আদালত ক্ষুব্ধ। এ প্রসঙ্গে বেঞ্চের বক্তব্য, “আমরা আশা করব, পুরীর পরিবেশের আরও অবনতি ঠেকিয়ে তাকে ঠিকঠাক অবস্থায় ফেরানোর জন্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ-সহ সব পক্ষ উপযুক্ত পদক্ষেপ করবে।”
তবে দূষণের বাড়বাড়ন্তের জন্য শুধু পুরী পুরসভা নয়, জগন্নাথ মন্দিরের পরিচালন ব্যবস্থার দিকেও আঙুল তুলেছে আদালত। সেই সঙ্গে বলে দিয়েছে, কমিটিকে কী কী যাচাই করতে হবে। সেগুলো হল: আবেদনকারী সুভাষবাবুর আবেদনে এবং ওড়িশা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের রিপোর্টে উল্লিখিত যাবতীয় বিষয়, স্বর্গোদ্বার ও জগন্নাথ মন্দিরে দূষণ নিয়ন্ত্রণের উপায় ও পদ্ধতি, পর্যটক ও বাসিন্দাদের থেকে ‘দূষণ-মূল্য’ আদায়ের বাস্তবতা ইত্যাদি। উপকূল অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ আইন ভঙ্গের সমস্ত অভিযোগ কমিটিকে খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি সেগুলির ব্যাপারে রাজ্য প্রশাসন কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে, কমিটিকে তা-ও যাচাই করতে বলেছে জাতীয় পরিবেশ আদালত।
৫ ডিসেম্বর ফের শুনানি হবে। |