বলা হয়, উন্নতিশীল দেশগুলিতে দুর্নীতির প্রকোপ বেশি। কথাটা ভুল নয়, তবে অসম্পূর্ণ।
উন্নত দেশগুলিতে আইনসম্মত দুর্নীতি বেশি, উন্নয়নশীল দুনিয়ায় বেআইনি দুর্নীতি প্রবল।
বিবেক দেবরায় |
দুর্নীতি ইদানীং নিয়মিত সংবাদের শিরোনামে। আজ এই লেখায় দুর্নীতির কথা বলব। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল সংস্থা ১৯৯৫ সাল থেকে দুর্নীতির একটা আন্তর্জাতিক হিসেব কষে আসছে। নানা সমীক্ষার ভিত্তিতে তারা দেখে, কোন দেশকে কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত বলে মনে করা হয়। প্রতি বছর একটি রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়, দুর্নীতির ক্রমানুসারে বিভিন্ন দেশকে চিহ্নিত করা হয়। ২০১২’র রিপোর্ট অনুসারে, দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে প্রথম তিনটি স্থানে আছে ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড। উল্টো দিকে, সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত তিনটি দেশ: আফগানিস্তান, উত্তর কোরিয়া ও সোমালিয়া। ভারত? ১৭৪টি দেশের মধ্যে ৯৪। শ্লাঘার ব্যাপার নয়।
রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশন আছে। তার পূর্বকথায় রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব লিখেছিলেন, “দুর্নীতি এক গভীর ব্যাধি। সমাজকে তা ভিতর থেকে কুরে কুরে খায়। দুর্নীতি গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনকে দুর্বল করে, মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটায়, বাজারকে বিকৃত করে, জীবনের মান নষ্ট করে, নানা রকম অপরাধ, সন্ত্রাস এবং নিরাপত্তার অন্য নানা শত্রুর শক্তিবৃদ্ধি ঘটায়। এই দুরাচার ছোট বা বড়, ধনী এবং দরিদ্র, সব দেশেই দেখা যায়, কিন্তু উন্নতিশীল দেশেই দুর্নীতির প্রভাব সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ সম্পদ দুর্নীতির কারণে বিপথে চালিত হয়, তার ফলে দরিদ্র মানুষের বিপুল ক্ষতি হয়। সরকারের অত্যাবশ্যক পরিষেবা সরবরাহের সামর্থ্য দুর্নীতির প্রকোপে ব্যাহত হয়, অসাম্য এবং অন্যায় উৎসাহিত হয়, নিরুৎসাহ হয় বিদেশি অনুদান ও বিনিয়োগ।” |
দুর্নীতির দায়। লালুপ্রসাদ। রাঁচি, সেপ্টেম্বর ২০১৩। ছবি: এ এফ পি। |
বাস্তবিকই, উন্নয়নকে যে ভাবেই মাপা হোক, যে দেশগুলি তুলনায় উন্নত, তাদের বেশির ভাগই তুলনায় দুর্নীতিমুক্তও বটে। ব্যতিক্রম আছে, কিন্তু তা ব্যতিক্রমই। দুর্নীতি এবং উন্নয়নের মধ্যে একটা পরিষ্কার সম্পর্ক আছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, সেই সম্পর্কের কার্যকারণ সূত্রটি কোন দিকে কাজ করে? দুর্নীতির মাত্রা কম বলে উন্নয়ন উৎসাহিত হয়, না কি উন্নত দেশে দুর্নীতি সম্পর্কে সচেতনতা বেশি বলে তার নিবারণ এবং প্রতিরোধও অনেক বেশি কার্যকর? প্রশ্নটা সংগত, তবে আপাতত আমরা সেই আলোচনায় যাব না। আমরা বরং দেখব, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য কী ধরনের উদ্যোগ করা হয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের কনভেনশনটিতে দুর্নীতি দমনের জন্য নানা আন্তর্জাতিক উদ্যোগের অঙ্গীকার করা হয়েছে। ২০০৫ সালে এই কনভেনশন কার্যকর হয়। এ পর্যন্ত ১৪০টি দেশে এতে সই করেছে। ভারত সই করেছে ২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে, যদিও দেশের আইনসভায় তা অনুমোদিত হয়েছে অনেক পরে, ২০১১’র মে মাসে।
দুর্নীতি অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। কিন্তু আইনে এই অপরাধের কোনও পাইকারি সংজ্ঞা নেই। এই প্রসঙ্গে দ্বিতীয় প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনের চার নম্বর রিপোর্টটির কথা উল্লেখ করা যায়। এই রিপোর্টটির শিরোনাম ‘এথিকস ইন গভর্নান্স’ বা শাসনের নৈতিকতা। ভারতে দুর্নীতি দমনের আইনি উদ্যোগগুলির কী ভাবে বিবর্তন ঘটেছে, এই রিপোর্টে তার একটা চমৎকার বিবরণী আছে। একেবারে শুরুতে ছিল ১৮৬০ সালে প্রণীত ভারতীয় দণ্ডবিধি (ইন্ডিয়ান পিনাল কোড বা আই পি সি)। এই বিধানের কয়েকটি ধারায় সরকারি কর্মীদের দুর্নীতির বিচার হত। ১৯৪৭ সালে পাওয়া গেল দুর্নীতি নিবারণ আইন (প্রিভেনশন অব কোরাপশন অ্যাক্ট বা পি সি এ)। আই পি সি’র অন্তর্ভুক্ত দুর্নীতিমূলক অপরাধগুলি ছাড়াও এখানে এক নতুন ধরনের অন্যায় যোগ করা হল: সরকারি কর্তব্য নির্বাহের ক্ষেত্রে অন্যায় আচরণ। পরবর্তী কালে দুর্নীতির সংজ্ঞা প্রসারিত করার জন্য আরও নানা আইন ও সংশোধনী আনা হল। বফর্স নিয়ে শোরগোলের পরে ১৯৮৮ সালে পি সি এ’র সংশোধন করে এই সমস্ত আইন ও ধারাকে তার আওতায় নিয়ে এসে একটা সংহত রূপ দেওয়া হল। মনে রাখা ভাল, বেনামি লেনদেন নিবারণ আইন (১৯৮৮) এবং কালো টাকা সাদা করা সংক্রান্ত আইন (২০০২) পরোক্ষ ভাবে দুর্নীতি নিবারণী বন্দোবস্তের মধ্যেই পড়ে।
পি সি এ কিন্তু দুর্নীতির কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেয়নি। এই আইনের বিভিন্ন ধারায় একটা জিনিসের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। কোনও সরকারি কর্মী যদি আইনসংগত প্রাপ্যের অতিরিক্ত কিছু পান এবং তার বিনিময়ে কাউকে কোনও অন্যায় সুযোগ দেন বা কাউকে কোনও ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করেন, তা হলে তাঁকে শাস্তি দেওয়া যাবে। দেশের আইনে দুর্নীতিকে ঠিক কী ভাবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তার সূক্ষ্মবিচারে না গিয়ে আমরা এখানে একটা জিনিস লক্ষ করতে চাই। দুর্নীতিকে দেশের আইনে প্রধানত সরকারি দুর্নীতি হিসেবে দেখা হয়েছে। সরকারি কর্মীরা যে দুর্নীতি করেন, সেটাই এখানে প্রধান বিচার্য। একে অনেক সময় আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতিও বলা হয়। অর্থনীতির আলোচনাতেও সচরাচর এই ধারাই অনুসরণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু ইদানীং বেসরকারি পরিসরের দুর্নীতি নিয়েও আগের চেয়ে অনেক বেশি আলোচনা হচ্ছে। আশা করা যায়, ভারতীয় আইনও ক্রমশ এ দিকে নজর দেবে।
তবে একটা কথা মনে রাখা দরকার। দুর্নীতি মানেই বেআইনি কাজ নয়। অনেক দুর্নীতির ঘটনায় নিশ্চয়ই আইন লঙ্ঘন করা হয়, কিন্তু আইন না ভেঙেও দুর্নীতি সম্ভব। আসলে, নৈতিকতা আইনের সীমায় সীমিত নয়। যাকে অপরাধ বলে গণ্য করা হয়, অপরাধের সংজ্ঞায় তা অনেক সময় ধরা পড়ে না। ‘কোরাপশন’ শব্দটি লক্ষণীয়। এই শব্দটিতে বিকৃত করা বা ধ্বংস করার একটা ক্ষমতা নিহিত আছে। আইনের মধ্যে থেকেও সেই ক্ষমতা ব্যবহার করা সম্ভব। যেমন, নির্বাচনের ফলকে প্রভাবিত করাটা সব সময় বেআইনি না হতে পারে। বিশেষ স্বার্থগোষ্ঠীর তরফে লবি করা, প্রভাব খাটানো বা পরিচিতি কাজে লাগানো অনেক ক্ষেত্রেই বেআইনি নয়। কিংবা, আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থায় ২০০৮-এর বিপর্যয়ের পরে লগ্নির বাজারে অনেক অনৈতিক ক্রিয়াকলাপের কথা জানা গেছে, যেগুলি বহু ক্ষেত্রে আইনের সীমার মধ্যেই ঘটেছে। প্রসঙ্গত, অনেক সময়েই বলা হয়, উন্নতিশীল দেশগুলিতে উন্নত দেশের চেয়ে দুর্নীতির প্রকোপ বেশি। কথাটা ভুল নয়, তবে অসম্পূর্ণ। আসলে ব্যাপারটা বোধহয় এই যে, উন্নত দেশগুলিতে আইনসম্মত দুর্নীতি বেশি, উন্নয়নশীল দুনিয়ায় বেআইনি দুর্নীতির দাপট প্রবল। তবে, আইনও এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না, কালক্রমে বদলায়।
|