সুধীর কক্কর প্রখ্যাত মনোবিশ্লেষক। তাঁর কথায় আমরা প্রগাঢ় কৌতূহল বোধ করি, ভাবনার রসদ খুঁজে পাই। রবীন্দ্রনাথের ছবির জগৎকে সুধীর মনোবিশ্লেষণের আলোয় দেখতে চেয়েছেন। (‘মহৎ স্রষ্টারা একই সঙ্গে নারী ও পুরুষ’, ২৯-৯) রবীন্দ্রচিত্রকলায় অবচেতনের ইশারা নিয়ে এর আগে অনেক কথা হয়েছে। পাণ্ডুলিপির কাটাকুটিতে ফুটে ওঠা বিচিত্র প্যাটার্ন আর জান্তব আকরগুলির মধ্যে অবচেতন তথা মনোবিকলনের দিকটি দেশি-বিদেশি একাধিক সমালোচক বলার চেষ্টা করেছেন। তা নিয়ে বিতর্কও হয়েছে। শিবনারায়ণ রায় বা আর্চারের মতো আলোচকরা আর একটু এগিয়ে এসে অবদমিত যৌনতার সঙ্গে রবি ঠাকুরের ছবির গিঁট বাঁধতে চেয়েছেন। বিশেষ করে, তাঁর নারীপ্রতিমার বিন্যাসে, চিত্রপটের ভূমি থেকে সোজাসুজি ওপরে ওঠা স্তম্ভাকৃতির কাপড়ে জড়ানো বাহুহীন নারীমূর্তির সঙ্গে কেউ কেউ শিবলিঙ্গ তথা উদ্যত পুরুষাঙ্গের তুলনা করেছেন, যেমন আর্চার। কেউ বলেছেন, তাঁর চিত্রকলা আজীবন ব্রাহ্ম অনুশাসন আর কঠোর শৃঙ্খলায় অবগাহিত জীবনের বিরুদ্ধে তীব্র জেহাদ, যেখানে খসে পড়েছে চিত্রীর অবদমিত মনোজগতের যাবতীয় অন্ধকারের অর্গল।
কক্কর অবশ্য সে কথা তোলেননি। তিনি রবীন্দ্রচিত্রের ‘কোথাও কোথাও’ রং-রেখার দুর্বলতার কথা বলেছেন। কিন্তু কোনও শিল্পীর প্রত্যেকটি কাজই কি সর্বদা সমান উচ্চতা স্পর্শ করতে পারে? বরং রবীন্দ্রনাথ স্বশিক্ষিত পথে তাঁর সীমাবদ্ধতাটুকু কী ভাবে নিজের শিল্পশৈলীতে রূপান্তরিত করে নেন, সেটা কি তলিয়ে দেখার নয়? কবি ক্রমে ছবিকর হয়ে উঠেছেন এমন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বড় কম নেই। কিন্তু জীবনের প্রান্তে পৌঁছে বিশ্বখ্যাত কবির চিত্রমালা একই সঙ্গে বিশ্বশিল্পের আধুনিক আন্দোলনকে জোরালো ভাবে স্পর্শ করে আছে, এমন নজির সহসা চোখে পড়ে না।
সুধীরের দৃষ্টি সে দিকে নয়। তিনি কবির ছবিতে নারীপ্রতিমার ‘ডিম্বাকার মুখ’-এর আদলে গড়ে ওঠা ফর্ম-এ ‘নারীর মধ্যে পৌরুষ বা পুরুষের মধ্যে নারীত্ব’ আবিষ্কার করতে চান। বলেন, ‘মহৎ স্রষ্টারা একই সঙ্গে নারী ও পুরুষ।’ এও তো সত্যি কথা। কিন্তু খুবই কি নতুন? এটা না-হলে কোনও কবি বা গল্পকারের লেখায় চারপাশের আনন্দ-যন্ত্রণার সংসার প্রতিবিম্বিত হবে কী করে? আর এ কি সৃষ্টিশীল মানুষের মধ্যেই আছে? অন্যদের অন্তরে এই অনুভব নেই? সেই ছেলেবেলায় কত বার পড়েছি, শুনেছি, মহাপুরুষের চরিত্র ‘বজ্রাদপি কঠোরাণি, মৃদুনি কুসুমাদপি’। মনের গভীরে এই সুরটি না-বাজলে কেউ কি বড় কাজ করতে পারে? এটাই ‘অ্যান্ড্রোজিনাস’ শব্দটির ভিতরের সারকথা নয় কি? কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ছবিতে তা কতটা প্রাসঙ্গিক?
মনোবিশ্লেষণের ছাঁকনিতে রবীন্দ্রচিত্রের জগৎটি ছেঁকে নেওয়ার সময় বিশ শতকের আধুনিক শিল্পের আন্দোলনের দিকে একটু নজর দিতেই হয়। সুধীর হয়তো খেয়াল করেননি, বিশ শতকের চিত্রে বা ভাস্কর্যে মানুষের মুখের আদলে ওভাল শেপ এসেছিল কিউবিজম, এক্সপ্রেশনিজম তথা প্রিমিটিভ আর্টের হাত ধরে। অসামান্য সব শিল্পীর আর্ট ফর্ম ক্রমে সহজ-সরল হতে হতে পৌঁছেছিল ওই জ্যামিতিক আকারের সংক্ষিপ্ত মূল নকশায়। বিশ শতকে বিশ্বযুদ্ধোত্তর শিল্পকলায় সৌন্দর্যের সংজ্ঞা যে ভাবে বদলে যাচ্ছিল তা তো রবীন্দ্রনাথের অজানা ছিল না। ‘পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারি’-র ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে এমন সব আশ্চর্য ভাবনার ঢল। তাই তাঁর ছবির দরজা খুলতে মনস্তত্ত্বের চাবি তেমন জোরালো গ্রিন সিগনাল হয়ে ওঠে না। দৃষ্টির বৈভব নিয়ে আমাদের সমসাময়িক দৃশ্যরূপের দরজায় দাঁড়াতে হয়।
ছবিতে চোখ আঁকতে গিয়ে নতুন বৌঠানের কথা মনে পড়ে, কবি এমন কথা নিজ মুখে বলেছেন বটে। আর সেটাকে একমাত্র সত্য হিসাবে ধরলে আমাদের কাজও খানিকটা সহজ হয়। কিন্তু তাতে আমাদের অনুসন্ধানী মন সত্যিই খুশি হয়ে উঠবে কি? কবির ‘না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর’ মাঝেও ডুব দিতে হয় আমাদের।
সুশোভন অধিকারী। শান্তিনিকেতন |