প্রবন্ধ ১...
নন্দীগ্রাম পেরেছে, পশ্চিমবঙ্গ পারবে না কেন
শৌচাগারের শোচনীয় অভাবের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শৌচালয়ের ও দেবালয়ের তুলনামূলক গুরুত্বের প্রসঙ্গ এনে ফেলায় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশকে বিজেপির সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। বৃত্তটি সম্পূর্ণ হল যখন নরেন্দ্র মোদী সম্প্রতি রমেশের বাক্যটিকেই সামান্য অদলবদল করে উপস্থাপন করলেন, মোদ্দা কথাটি একই রেখে। শৌচালয়ের প্রয়োজনীয়তা যে দেবালয়ের থেকে কোনও অংশে কম নয়, এই কথাটির মধ্যে এমন একটি চমকদার প্রগতিশীলতার বিচ্ছুরণ রয়েছে যে মোদীও লোভ সামলাতে পারলেন না। নির্বাচন-পূর্ববর্তী অতিসক্রিয়তার আবহাওয়ায় নিত্যনতুন চমকপ্রদ বাক্যবন্ধের প্রয়োজন, লোভ সামলানো কি সহজ কথা? রাজনীতিকরা যে উদ্দেশ্যেই শৌচাগারের প্রসঙ্গ এনে ফেলুন না কেন, বিষয়টিতে যে কিঞ্চিৎ আলোকপাত হচ্ছে এই ঢের।
বছর আটেক আগের কথা। ধারাবাহিক শিক্ষাকেন্দ্রগুলির অবস্থা জানতে গ্রামাঞ্চলে ঘুরছিলাম। সাক্ষরতা প্রসার অভিযানে বয়স্কদের সাক্ষর করে তোলার প্রয়োজনে এই কেন্দ্রগুলি চালু হয়েছিল। সেখানে বয়স্কদের জড়ো করা ও সাক্ষর করে তোলার কাজটি করতেন ‘প্রেরক’ ও ‘সহ-প্রেরক’। অতি সামান্য সাম্মানিকেরও ব্যবস্থা ছিল এঁদের জন্যে, যা তাঁরা মাসের পর মাস পেতেন না। এই কেন্দ্রগুলিকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন সামাজিক প্রচারমূলক কাজের কথাও ভাবা হয়েছিল, স্থানীয় সংস্কৃতিকে তার সঙ্গে মিলিয়ে সংস্কৃতি বলতে গানবাজনা, কোথাও হারমোনিয়ম, কোথাও তার সঙ্গে তবলা কিংবা খোল-মাদলও কিনে দেওয়া হয়েছিল।
‘শৌচাগার’। ধাপা, কলকাতা, ২০১০। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।
এমন একটি শিক্ষাকেন্দ্রে সন্ধ্যায় যখন লোকজন জড়ো হলেন, কথোপকথন চলছে, এমন সময়ে এক মাতব্বর গোছের ভদ্রলোক বললেন, ‘গান হোক’। একটি লাজুক যুবক হারমোনিয়মটা টেনে নিয়ে জিগ্যেস করল, ‘শৌচাগারের গানটা গাই’? সম্মতি পেয়ে সে গান ধরল। সদ্য-বিবাহিত বধূটি শ্বশুরবাড়িতে এসে যদি দেখে সে-বাড়িতে শৌচাগার নেই, কী রকম বিড়ম্বিত যে সে হতে পারে, এবং শ্বশুরবাড়ির ইজ্জতও যে তার ফলে ভূলুণ্ঠিত হয় এই কথাগুলিই যুবকটি যথেষ্ট আবেগ সহযোগে গেয়ে যাচ্ছিল। পঞ্চায়েতের সাহায্যে সামান্য খরচায় কী ভাবে শৌচাগার বানানো যায়, তার ব্যাখ্যা দিতে দিতে গান এগিয়ে চলে। গান শেষ হলে মাতব্বর ভদ্রলোককে জিগ্যেস করে বসি, আপনার বাড়িতে শৌচাগার আছে? লাজুক মুখে বলেন, ‘আছে একখান, তবে ব্যাটাছেলেরা মাঠেই যায়।’
শৌচাগারের গান যুবকটি শিখেছিল ‘টোটাল স্যানিটেশন ক্যাম্পেন’-এর (টি এস সি) প্রয়োজনে। শুধু গান নয়, পুতুলনাচ, পথনাটিকা, পদযাত্রা সব কিছু ব্যবহার করেই প্রচার চালানো হয়েছিল। আশা ছিল, এ ভাবেই শৌচাগার নির্মাণে মানুষের আগ্রহ তৈরি করা যাবে। স্বল্প ব্যয়ে শৌচাগার নির্মাণ প্রযুক্তিও সেই সঙ্গে আনা হল। গ্রামে গ্রামে ‘স্যানিটারি মার্ট’ তৈরি হল, যারা স্বল্পমূল্যে পায়খানার প্যান বানিয়ে বিক্রি করতে লাগল। পশ্চিমবঙ্গে এই উদ্যোগ কিছুটা সফল হয়েছিল বলা যায়। পূর্ব মেদিনীপুর, হাওড়া ও উত্তর চব্বিশ পরগনায় শৌচাগারহীন পরিবারের সংখ্যা অনেকটাই কমিয়ে ফেলা গেছে। অবশ্য শৌচাগারের গান শুনেই ঠিক কতগুলি পরিবার শৌচাগার বানানোয় উদ্যোগী হয়েছিল, সে তথ্য জানা সম্ভব নয়। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে এ জাতীয় প্রচার, পঞ্চায়েতের উদ্যোগ, কিছু অসরকারি সংগঠনের কাজকর্ম এই সব মিলিয়ে কিছুটা ফল তো ফলেছিলই। পশ্চিমবঙ্গের ৩২৩৯টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ১০৭৭টি পঞ্চায়েত ‘নির্মল গ্রাম’ পুরস্কার পেয়েছে এ পর্যন্ত, যার অধিকাংশই জুটে গিয়েছিল টি এস সি-র প্রথম ক’বছরের মধ্যেই। শতাংশের হিসেবে রাজ্যের মোট গ্রাম পঞ্চায়েতের ৩৩.৩ শতাংশ পঞ্চায়েত পেয়েছে এই পুরস্কার। কেরলের ১০০ শতাংশ ও মহারাষ্ট্রের ৩৪ শতাংশ বাদ দিলে আর কোনও রাজ্যে এমন সাফল্য আসেনি। দেশের অন্তত অর্ধেক রাজ্যে এ সংখ্যা দশ শতাংশ ছাড়ায়নি।
একটি চমকপ্রদ তথ্য দেওয়া যায় এ প্রসঙ্গে। সংবাদ শিরোনামে আসার কয়েক বছর আগেই অন্য এক পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলেছিল নন্দীগ্রাম। নন্দীগ্রাম-দুই ব্লক দেশের মধ্যে প্রথম ‘নির্মল ব্লক’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। প্রত্যেক পরিবারে স্যানিটারি পায়খানা থাকলে তবেই নির্মল ব্লক, নির্মল গ্রাম বা নির্মল জেলার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। শৌচাগার বাবদে নন্দীগ্রাম তথা পূর্ব মেদিনীপুরের এই সাফল্যের পিছনে ছিল বিশেষ উদ্যোগ। ১৯৯০ সালে ইউনিসেফ, রাজ্য সরকার ও রামকৃষ্ণ মিশন লোকশিক্ষা পরিষদ মিলে পূর্ব মেদিনীপুরের প্রতিটি গৃহে শৌচাগার নির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে পরীক্ষামূলক ভাবে এক প্রকল্প শুরু করে। স্যানিটারি মার্ট-এর মাধ্যমে সামান্য দামে পায়খানার প্যান বিক্রির ব্যবস্থার কথা তখনই ভাবা হয়। পরে ২০০২ সালে যখন ভারত সরকার দেশ জুড়ে টি এস সি চালু করে, তা প্রায় পুরোপুরি মেদিনীপুর মডেলকেই অনুসরণ করে। অর্থাৎ, শৌচাগারের প্রসারে পশ্চিমবঙ্গ অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। অথচ ২০১১’র জনগণনায় দেখছি, শৌচাগার নেই এমন পরিবারের সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গে এখনও প্রায় ৩৯ শতাংশ, এমনকী রবীন্দ্রনাথের বীরভূমেও ৭৫ শতাংশ পরিবার প্রাতঃকৃত্য সারেন ‘মাঠে’। একই রাজ্যে এমন চূড়ান্ত বৈপরীত্য কেন? পূর্ব মেদিনীপুর যা করতে পেরেছে, অন্য জেলাগুলি তা পারল না কেন? টি এস সি প্রকল্প তো এক দশকের উপর চলেছে। কোথায় গেল শৌচাগারের গানওলা?
গৃহসংলগ্ন শৌচাগারের অভাবের ফলে মহিলাদের যে পুরুষদের থেকে ঢের বেশি ভুগতে হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অসুবিধা কিংবা অস্বস্তির প্রশ্নটি ছাপিয়েও গুরুত্ব দিতেই হবে শৌচাগারের অভাবের ফলে উদ্ভূত শারীরিক অসুস্থতাকে। দিবালোকে ‘মাঠে’ যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা এড়াতে মহিলারা যে-সব পদ্ধতি বাধ্য হয়েই অনুসরণ করেন, তা তাঁদের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে, যার দীর্ঘকালীন পরিণতি ভাল নয়। এ ছাড়া যত্রতত্র মলত্যাগ সামগ্রিক ভাবে অসুস্থতার কারণ হতে পারে, কারণ মলের সঙ্গে মিশে থাকা জীবাণু নানা ভাবে খাদ্য বা পানীয় জলের সংস্পর্শে এসে তাকে দূষিত করে, উদরাময়-জাতীয় রোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়, বিশেষত শিশুদের। বার বার এই রোগের আক্রমণে পাকযন্ত্র ও অন্ত্রের পরিপাকক্ষমতাও কমে যায়, বড় হওয়ার পরে যার প্রভাব থেকে যায়। খাবার থেকে খাদ্যগুণ আহরণের পথেও তা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শিশুদের অপুষ্টির এই কারণটির উপর ইদানীং গবেষকদের দৃষ্টি পড়েছে। অপুষ্টি মানেই খাদ্যাভাব নয়, শৌচাগারের অভাবও তার অন্যতম কারণ হতে পারে এই ধারণার সমর্থনে তথ্যভিত্তি পাওয়া যাচ্ছে।
বয়স অনুসারে বাচ্চাদের উচ্চতা ও ওজন থেকে তাদের স্বাস্থ্য, বিশেষত পুষ্টি সম্পর্কে জানা যায়। জীবনের প্রথম কয়েক বছরে পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাব সরাসরি বাচ্চার উচ্চতায় প্রতিফলিত হয়। যে পুষ্টির অভাব তাকে শৈশবে বাড়তে দেয়নি, সেই অভাবই দীর্ঘকালে তার অন্য শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলিকেও অনেকটা নির্ধারণ করে দেয়। যেমন ভবিষ্যৎ কর্মজীবনে মানুষ কতটা চটপটে বোধবুদ্ধিসম্পন্ন ও কর্মক্ষম হবে, তার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় শৈশবের এই ঘাটতি থেকে। ভারতীয় শিশুদের গড়পড়তা উচ্চতা পৃথিবীর মধ্যে হ্রস্বতম। উচ্চতা যেহেতু পুষ্টির প্রকাশ, সাধারণ ভাবে পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবকেই অপুষ্টির কারণ হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু শুধু খাদ্যাভাব বা দারিদ্র দিয়ে এর পুরোপুরি ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। আফ্রিকার দেশগুলিতে সাধারণ ভাবে দারিদ্র ভারতের তুলনায় বেশি। কিন্তু সেখানকার শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি ভারতীয় শিশুদের তুলনায় কম। শৌচাগার ব্যবহারের পার্থক্য এর একটা কারণ হতে পারে। এই কার্যকারণ সম্পর্কের কথা কমবেশি আমাদের জানা ছিল বটে, তবে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডিন স্পিয়ার্স সাম্প্রতিক গবেষণায় অত্যন্ত শক্তপোক্ত গবেষণাপদ্ধতি প্রয়োগ করে এই সম্পর্কটিকে জোরালো ভাবে দেখিয়েছেন। তাই শৌচাগারের অভাবে শ্বশুরবাড়ির ইজ্জত নববধূর কাছে ভূলুণ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা ছাড়াও আরও কিছু গভীর সামাজিক ক্ষতির সম্ভাবনা রয়ে যায়, যে ক্ষতির পরিণতি স্বাস্থ্যহীন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
কেরলের ১০০ শতাংশ পঞ্চায়েতের নির্মল গ্রাম হয়ে ওঠাকে যদি নিতান্ত সৃষ্টিছাড়া বলেও মনে করি, ঘরের কাছে পূর্ব মেদিনীপুরের দৃষ্টান্ত উড়িয়ে দিই কী করে? মনে রাখতে হবে, ১৯৯০-এ যখন শৌচাগার প্রকল্প শুরু হয়, তখন সে জেলায় পাঁচ শতাংশ গৃহেও শৌচাগার ছিল না। পূর্ব মেদিনীপুরের অভিজ্ঞতাকে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম কিংবা উত্তর দিনাজপুরে ঠেলে নিয়ে চলা এমন কী অসম্ভব কাজ? পঞ্চায়েত নির্বাচন-পরবর্তী কালে ‘দখলে রাখল’ আর ‘ছিনিয়ে নিল’ গোছের কাড়াকাড়িমূলক শব্দবন্ধের তুফান পেরিয়ে যখন একটু থিতু হওয়ার অবকাশ আসবে, তখন উন্নয়নের এই ‘অকিঞ্চিৎকর’ প্রশ্নগুলিকে একটু সামনে ঠেলে দেওয়া যায় না?

ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ ইন কলকাতা’র অধিকর্তা। মতামত ব্যক্তিগত।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.