কোন বিশ্ববিদ্যালয় কী রকম, তাহা যাচাই করিবার একটি প্রথা আছে। বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন কাজটি করিয়া থাকে। এই বিচারের একটি মান্য পদ্ধতিও রহিয়াছে। পদ্ধতিটি নিখুঁত, এমন কথা হলফ করিয়া বলা কঠিন। কোন বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বৎসরে কয়টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হইল, তাহাই সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিক্তি মাপিয়া বলিয়া দিতে পারে, এমন দাবি বাড়াবাড়ি হইবে। কিন্তু, এই মান যাচাইয়ের পদ্ধতিগুলিকে যদি একেবারে উড়াইয়া না দেওয়া হয়, তাহা হইলে যে অনস্বীকার্য সত্যটি প্রকট হইয়া উঠে, তাহা হইল, কোনও মাপকাঠিতেই ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বিশ্বমানের ধারেকাছেও পৌঁছাইতে পারে না। এমনকী, ভারতের অতি গর্বের ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিগুলিও নহে। ‘এই জাতীয় ক্রমতালিকা কোনও অর্থ বহন করে না’, অথবা ‘ভারতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি মার্কিন ছক মানিয়া চলে না বলিয়াই সেই মাপকাঠিতে পাশ করিতে পারে না’ জাতীয় অজুহাত ব্যবহার করিয়া লাভ নাই। বরং, সত্যটি স্বীকার করিয়া লওয়া ভাল গোটা দুনিয়া যখন বড় বড় পা ফেলিয়া ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হইতেছে, ভারত তখন কলিকাতার বাস কন্ডাকটরদের উপদেশ শিরোধার্য করিয়া ক্রমেই পিছন দিকে আগাইয়া যাইতেছে। চেষ্টা করিলে যে পারা যায়, তাহার দুইটি মোক্ষম উদাহরণ: সিঙ্গাপুর ও চিন। ত্রিশ বৎসর পূর্বেও এই দেশগুলির তুলনায় ভারত অনেক অগ্রসর ছিল। এখন ভারত এত পিছনে পড়িয়া গিয়াছে যে আর তুলনাই চলে না।
কেন ভারতের উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রগুলি এমন ভাবে পিছাইয়া পড়িল, তাহার অনেক কারণ আছে। প্রথমত, দেশের প্রায় সব অগ্রগণ্য প্রতিষ্ঠানই সরকারি, শিক্ষকদের চাকুরি হারাইবার ভয় নাই। সত্য বলিতে, শিক্ষকদের মূল্যায়নের কোনও সন্তোষজনক ও নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থাই ভারতীয় শিক্ষাক্ষেত্রে নাই। দ্বিতীয়ত, সরকারি লালফিতার দৌলতে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় হইতে শিক্ষক ভাঙাইয়া আনাও এক রকম অসম্ভব। তৃতীয়ত, এক বিশেষ গোত্রের মানুষের বাটপাড়ের ভয় থাকে না। যেহেতু বহু পূর্বেই আন্তর্জাতিক শিক্ষা মানচিত্র হইতে ভারতের নাম কাটা গিয়াছে, ফলে গবেষণাকে বিশ্বমানে তুলিবার তাগিদ গবেষকদেরও নাই, শিক্ষকদেরও নাই। যেমন চলিতেছে, চলিলেই হয় ইহাই সর্বজনীন মানসিকতা। অতএব, আন্তর্জাতিক স্তরে কোনও প্রবন্ধ প্রকাশিত হইল কি না, অন্যান্য গবেষকরা নিজেদের কাজে সেই প্রবন্ধের উল্লেখ করিলেন কি না এগুলি আর ভারতীয় শিক্ষামহলে বিশেষ বিবেচ্য নহে।
ভারতের আরও একটি ব্যাধি হইল অকর্তব্যের প্রতি আকর্ষণ। যে প্রতিষ্ঠানের একমাত্র কাজ হওয়া উচিত প্রযুক্তিবিদ্যার চর্চা, সেখানে মহাসমারোহে ভাষাতত্ত্ব পড়ানো হইতেছে। যে প্রতিষ্ঠানটি ‘লিবারাল আর্টস’-এর চর্চার জন্য নির্দিষ্ট, সেখানে অর্থনীতি পড়াইবার ঝোঁক অদম্য। এই প্রবণতায় অর্থনীতির যতখানি ক্ষতি, নাট্যশাস্ত্রের ক্ষতি সমধিক। এবং, সম্মিলিত পরিণামে, ভারতের ক্ষতি সর্বাধিক। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিজের নিজের ক্ষেত্রে উৎকর্ষ অর্জনের চেষ্টা করিলে রাজকোষ হইতে ব্যয়িত অর্থের প্রতি কিঞ্চিৎ সুবিচার হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মানও খানিক বাড়িতে পারে। তবে তাহার জন্য শিক্ষানীতির রূপকারদের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব ছাড়িয়া শিক্ষার উৎকর্ষে মনোযোগ করিতে হইবে। তাহার আশা কতটুকু? কপিল সিব্বালরা কিন্তু সব রাজনৈতিক দলেই বিরাজমান। |