সবে সন্ধে হয়েছে। সারাদিন মাঠের কাজ করে একটা তাঁবুতে খেতে বসেছিলেন তাঁরা। পাশেই তাঁবুর ধারে সব্জি বিক্রি করছিলেন এক ব্যক্তি। হঠাৎই জোর আওয়াজ আর সেই সঙ্গে তীব্র আলোর ঝলকানি। কিছু ক্ষণ পর দেখা গেল মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছেন ক’জন। বাকিরা প্রাণহীন। এ দিক ও দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে হাত-পায়ের টুকরো।
২০১২ সালের ৬ জুলাই পাকিস্তানের উপজাতি অধ্যুষিত ওয়াজিরিস্তান প্রদেশের ঘটনা। আহতদের উদ্ধার করতে ছুটে গিয়েছিলেন আশপাশের লোকজন। ফের সেই আওয়াজ আর আলোর ঝলকানি। সে দিন রাতে এই ঘটনায় ১৪ বছরের একটি ছেলে-সহ ১৮ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন। যাঁরা সবাই নিরীহ গ্রামবাসী। যদিও আমেরিকার দাবি ছিল, নিহতেরা সবাই জঙ্গি। |
মঙ্গলবার অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। যার মধ্যে পাকিস্তান ও ইয়েমেনে মার্কিন ড্রোন হানার এ রকম অসংখ্য ঘটনার কথা বলা রয়েছে। এর বিভিন্ন ঘটনা মাঝে মধ্যেই খবরের শিরোনামে আসে। প্রতিবাদ জানায় সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার। কিন্তু বেশির ভাগ সময়েই আমেরিকার তরফে ড্রোন হানায় সাধারণ মানুষের নিহত হওয়ার ঘটনা স্বীকার করা হয় না। অনেক সময়ে ড্রোন হানার তথ্যও স্বীকার করতে চায় না আমেরিকা।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দাবি, ২০১২-র জানুয়ারি থেকে ২০১৩-র চলতি মাস পর্যন্ত শুধু ওয়াজিরিস্তানেই ন’টা মার্কিন ড্রোন হানার খবর পাওয়া গিয়েছে যেগুলোয় নিহতেরা কেউই জঙ্গি বা জঙ্গিদের পরিবারের কেউ নন। শুধু তা-ই নয়, এ রকম ড্রোন হানায় নিহতদের মধ্যে অধিকাংশই শিশু আর মহিলা যাঁরা হয়তো তখন ক্ষেতখামারে কাজ করছিলেন।
২০১২ সালের ২ সেপ্টেম্বর। ইয়েমেনের সারার গ্রামে মার্কিন ড্রোন হানায় একটি বাসে থাকা ১২ জন যাত্রী নিহত হন। আমেরিকার দাবি ছিল, ওই বাসে করে আল কায়দা জঙ্গিরা যাচ্ছিল। যদিও পরে জানা যায়, ওই বাসে সাধারণ গ্রামবাসীরা ছিলেন। এই ঘটনায় নিহতদের মধ্যে এক অন্তঃস্বত্ত্বা মহিলা আর তিনটি শিশুও ছিল। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার সংগঠনের একটি রিপোর্টে প্রকাশ, গত এক দশকে আড়াই হাজারের মতো পাকিস্তানের নাগরিক মারা গিয়েছেন ড্রোন হানায়। পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে অন্তত ৪০০ জন সাধারণ নাগরিক। আর অন্তত ২০০ জন সন্দেহভাজনের তালিকায় থাকলেও তাঁদের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনও অভিযোগ ছিল না।
সংস্থার তরফে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে, এ ভাবে নির্বিচারে ড্রোন হানা চালাতে গিয়ে ভীষণ ভাবে যুদ্ধের নিয়মকানুন ভাঙছে আমেরিকা। যার ফল হচ্ছে মারাত্মক।
ছোটবেলায় এ ভাবে অনাথ হয়ে যাওয়া ছেলে-মেয়েদের মধ্যে আমেরিকার বিরুদ্ধে তৈরি হচ্ছে প্রবল ঘৃণা। দেশের সরকারের নিস্তেজ প্রতিবাদে আপনা থেকেই তাদের শিশুমন সরকারবিরোধী কাজে উৎসাহ পাচ্ছে। এদের অনেকেই পরে আল কায়দার মতো জঙ্গি সংগঠনে নাম লেখাচ্ছে। সংস্থার মতে, আমেরিকার এ রকম কাজে উৎসাহ পেয়ে অন্য দেশ যদি নিয়ম লঙ্ঘন করে তখন কারও কিছু বলার থাকবে না। আর তার ফল হবে মারাত্মক।
এই রিপোর্টটা এমন একটা সময়ে প্রকাশ পেল ঠিক যার পরের দিন অর্থাৎ বুধবার বারাক ওবামার সঙ্গে দেখা করবেন পাক প্রেসিডেন্ট নওয়াজ শরিফ। যে দেশের অধিকাংশ মানুষই এই ড্রোন হানার প্রবল বিরোধী। রিপোর্টে প্রকাশ, এক সময়ে তালিবান হানার ভয়ে কাঁপত দেশের উপজাতি এলাকার বাসিন্দারা। এখনও সেই একই ভয়ে কাঁপছেন তাঁরা। তবে তালিবান নয়, ড্রোন হানার ভয়ে। পাক বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র এজাজ আহমেদ জানিয়েছেন, ওবামার সঙ্গে সাক্ষাতে এই প্রসঙ্গও উঠবে।
তবে আমেরিকার তরফে এই রিপোর্ট নিয়ে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র ক্যাটলিন হেডেন বরং গত মে মাসেই ড্রোন হামলা নিয়ে ওবামার বক্তৃতার কথা উল্লেখ করেছেন। সেখানে ওবামা আশ্বাস দিয়েছিলেন, এ বার থেকে যত ক্ষণ না আমেরিকা নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে তত ক্ষণ পর্যন্ত ড্রোন হানায় সায় দেবে না আমেরিকা। এবং সাধারণ নাগরিক কোনও ভাবেই যাতে আহত না হন সে দিকেও নজর রাখা হবে। কিন্তু সেই আশ্বাস যে নিতান্তই কথার কথা এই রিপোর্টে সেই কথাটাই উঠে আসছে। |