কলকাতার তৃণমূল ভবন থেকে আগেই জেলার নেতাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, পুরপ্রধান বাছার ব্যাপারে রাজ্য নেতৃত্বের ফয়সালাই চূড়ান্ত। তা সত্ত্বেও তীব্র গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে মঙ্গলবার বর্ধমানের গুসকরা পুরসভায় জয়ী সদস্যদের শপথগ্রহণ ভেস্তে গেল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুমতি নিয়ে প্রধান ও উপপ্রধান পদে যাঁদের নাম বাছাই করা হয়েছিল, স্থানীয় নেতা-কর্মীদের একাংশের বাধায় তাঁদের পদে বসানো গেল না।
গত বারের পুরপ্রধান চঞ্চল গড়াই এবং উপ-পুরপ্রধান মল্লিকা চোঙদার ফের জিতে আসা সত্ত্বেও দু’জনের কাউকেই আর ওই দুই পদের জন্য বাছা হয়নি। শিকে ছেঁড়েনি আর এক নেতা নিত্যানন্দ চট্টোপাধ্যায়েরও। দল সূত্রের খবর, কৃষিমন্ত্রী মলয় ঘটক সাদা খামে যে চিঠি নিয়ে আসেন তাতে পুরপ্রধান হিসেবে গীতারানি ঘোষ ও উপ-পুরপ্রধান হিসেবে বুর্ধেন্দু রায় নামে তুলনায় কম প্রভাবশালী দুই নেতা-নেত্রীর নাম ছিল। খানিক বাদেই গোলমাল বেধে যায়।
এ দিন দুপুর ১২টা নাগাদ গুসকরার বিদ্যাসাগর হলে শপথগ্রহণ শুরু হওয়ার কথা ছিল। নিত্যানন্দবাবু ও মল্লিকাদেবীর অনুগামীরা হল ভরিয়ে মহকুমাশাসককে সভা শুরু করার জন্য চাপ দিতে থাকেন। যদিও পুরপ্রধান পদে যাঁর শপথ নেওয়ার কথা ছিল বলে দল সূত্রের খবর, ১১ নম্বরে জয়ী সেই গীতারানি ঘোষ হলে আসেননি। আসেননি চঞ্চলবাবুও। সামান্য দূরে পুরসভার অতিথিশালায় মলয়বাবু এবং গুসকরার দলীয় পর্যবেক্ষক অনুব্রত মণ্ডলের সঙ্গে আগাগোড়া বসে ছিলেন তিনি। দুপুরে হলে পৌঁছে চার বারের কাউন্সিলর মল্লিকাদেবী বলেন, “গীতারানি ঘোষকে পুরপ্রধান এবং ৪ নম্বরে জয়ী বুর্ধেন্দু রায়কে উপপ্রধান করার জন্য অতিথিশালায় বসে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তা মানতে পারব না বলে এসেছি। রাজ্য নেতৃত্বের কাছ থেকে আসা পুরপ্রধানের নাম লেখা খাম মুখ খোলা অবস্থায় আমাদের কাছে এসে পৌঁছল কেন?”
মলয়বাবু অবশ্য গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা মানতে চাননি। তাঁর দাবি, “শপথগ্রহণ যেখানে হওয়ার কথা ছিল, সেখানে জনতা ঢুকে পড়ে। তার জন্য আমাদের কয়েক জন কাউন্সিলার ঢুকতে পারেননি। তাই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান করা যায়নি।” মল্লিকাদেবী দীর্ঘদিন ধরেই অনুব্রত মণ্ডলের অনুগামী বলে পরিচিত। গোষ্ঠী রাজনীতিতে তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ চঞ্চলবাবুও বর্তমানে একই শিবিরে। অনুব্রতর দাবি, “সিপিএমের লোকেরা ওখানে ঢুকে পড়ায় অনুষ্ঠান বাতিল করতে হয়।”
গুসকরার ১৬টি ওয়ার্ডের মধ্যে পাঁচটি সিপিএম এবং বাকি সব তৃণমূল জিতেছে। সিপিএমের সব কাউন্সিলর ছাড়াও তৃণমূলের ছ’জন জয়ী সদস্য শপথ নিতে এসেছিলেন। কিন্তু কার্যত গোটা হলই দখল করে বসেছিলেন ৩ নম্বর ওয়ার্ডে জয়ী নিত্যানন্দবাবুর অনুগামীরা। পরে ৪ নম্বরে জয়ী বুর্ধেন্দু রায় হলে আসেন। তাঁর দাবি, “আমায় অনুব্রতবাবুর লোকেরা অতিথিশালায় গিয়ে দেখা করতে বলেছিল। পাছে আমায় দিয়ে জোর করে কোনও কিছুতে সই করিয়ে নেয়, তাই যাইনি। দলের সমর্থকেরাও আমায় ওখানে যেতে দেননি।”
বর্ধমান (দক্ষিণ) মহকুমাশাসক প্রদীপ আচার্যের উদ্দেশে নিত্যানন্দবাবু বলতে থাকেন, “সভার কোরাম হয়ে গিয়েছে। শপথগ্রহণ শুরু করতে যে দেরি করছেন, তা সংবিধান-বিরোধী।” মল্লিকাদেবীও তাঁকে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দেন। চাপে পড়ে জেলাশাসক সৌমিত্র মোহনের সঙ্গে পরামর্শও করেন তিনি। হলে এবং হলের বাইরে তখন প্রবল হই-হট্টগোল চলছে। দুপুর সওয়া ২টো নাগাদ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনন্দ রায় প্রচুর পুলিশ ও র্যাফ নিয়ে এসে মঞ্চ ঘিরে ফেলেন। মহকুমাশাসক ঘোষণা করেন, “আইন-শৃঙ্খলাজনিত কারণে শপথগ্রহণ স্থগিত রাখা হল।”
সঙ্গে-সঙ্গে নিত্যানন্দ ও মল্লিকার অনুগামীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। স্লোগান উঠতে থাকে নিত্যানন্দবাবু বা বুর্ধেন্দুবাবুর মধ্যে একজনকে পুরপ্রধান করতে হবে। সভা স্থগিত করা যাবে না। আইনশৃঙ্খলার কী ধরনের অবনতি হয়েছে, তা জানাতে হবে বলেও দাবি ওঠে। শেষ পর্যন্ত মহকুমাশাসক ফের ঘোষণা করেন, অনিবার্য পরিস্থিতিতে শপথগ্রহণ বাতিল করা হয়েছে।
মল্লিকাদেবীর বক্তব্য, “কোনও দলের প্রতিনিধি নন মহকুমাশাসক। কোরাম যখন হয়ে গিয়েছে, তখন শপথগ্রহণ হবে না কেন? আমাদের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি তাঁর কাছে বিষয়টি জানতে চাইছি।” শপথ নিতে এলেন না কেন? গীতারানি ঘোষের জবাব, “কেন গেলাম না তা মলয় ঘটককে জিজ্ঞাসা করুন।” মলয়বাবু অবশ্য বলেন, “যত লোক ঢুকে পড়েছিল, বিপদ হতে পারত। পুলিশকে বলি, ভিড় সরিয়ে দিতে। পুলিশ বলল, লাঠিচার্জ করতে হবে। কিন্তু তাতে বিপত্তি বাড়ত।”
আসলে কি গোষ্ঠীদ্বন্দ্বেই আটকে গেল সব? অনুব্রতর দাবি, “না না! কোথাও কোনও গোলমাল নেই।” গুসকরার পুরপ্রধান কে হবেন? অনুব্রত বলেন, “সেটা রাজ্য নেতৃত্বই ঠিক করবেন। আমি বলতে পারব না।” বিকেলে বিশাল মিছিল বের করেন চঞ্চল-অনুগামীরা। তার সামনে হাসিমুখে হাঁটতে-হাঁটতে প্রাক্তন পুরপ্রধান বলেন, “কে খলনায়ক, কে খলনায়িকা, গুসকরার মানুষ সবই বুঝে গিয়েছেন। আমার আর আলাদা করে বলার কিছু নেই।”
|