শহরে না থাকলেও মঙ্গলবার বিকেলে ডুয়ার্সের বাড়ির টিভি সুইচ অন করবেন অঞ্জন মিত্র। দেখবেন যুবভারতীর এএফসি কাপ সেমিফাইনালের ‘ডু অর ডাই’ ম্যাচ। সোমবার রাতে ডুয়ার্স থেকে ফোনে মোহনবাগান সচিব বললেন, “মঙ্গলবার কোনও মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল নয়। শুধু দেশ।”
দিল্লিতে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের সঙ্গে বৈঠকে ব্যস্ত থাকায় ইস্টবেঙ্গল-কুয়েত এসসি মহারণ দেখা হবে না মহমেডান সভাপতি সুলতান আহমেদের। আনন্দবাজারের কাছে তাঁর আক্ষেপ, “ম্যাচটা দেখা না হলেও হৃদয় থাকবে কলকাতায়। তবে আমার ক্লাব কর্তারা স্টেডিয়ামে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে চেঁচাবে।” যুবভারতীর মহাযুদ্ধ কোনও ভাবেই ছাড়বেন না ইউনাইটেড স্পোর্টস কর্তা নবাব ভট্টাচার্যও।
নেপথ্যে মেহতাবদের ঐতিহাসিক ম্যাচ। আর সেটাই কোথাও গিয়ে যেন অন্তত এক দিনের জন্য ভুলিয়ে দিয়েছে ময়দানি শত্রুতা, গোটা বছরের রেষারেষি। আজ শহরে সবুজ-মেরুন কিছু নেই। আলাদা করে কেউ খুঁজে পাবে না সাদা-কালো বা কোনও বেগুনি-হলুদ জার্সিকে।
আজ মঙ্গলবার শহরের একটাই স্টেশনযুবভারতী।
আজ মঙ্গলবার শহরের একটাই রংলাল-হলুদ। |
আর্মান্দো কোলাসো, করিম বেঞ্চারিফা, সুভাষ ভৌমিকরাও কি দেখবেন না? আজ পর্যন্ত যে ইতিহাস কেউ ছুঁয়ে দেখতে পারেননি, যে টুর্নামেন্টের আর্মান্দো কোলাসোর ডেম্পোকে সেমিফাইনালে উঠতে দেখেই এত দিন সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে ভারতবর্ষকে, ওই ‘দেওয়াল’ ভাঙতে চাই আজ ২-০। একটাও না খেয়ে লাল-হলুদের দু’টো গোল কুয়েত এসসি-র জালে জড়িয়ে দেওয়া মানে, এএফসি ফাইনালের টিকিট! কিন্তু কোনও ভাবেই গোল খাওয়া চলবে না। একটা গোল হজম মানে কিন্তু জিততে হবে ৩-১।
অতএব চাই ‘গোলাজো’! চোখ ধাঁধানো গোল।
অতএব চাই ‘ট্যাকল ট্যাকটিক্সে’ কুয়েত বধ!
কত শলাপরমর্শ, কত আলোচনাই না চলল গোটা সোমবার ধরে। টোটকার ছড়াছড়ি। ইস্টবেঙ্গলের ব্রাজিল কোচের প্রার্থনা। অসহ্য দাঁতের ব্যথায় ছটফট করতে করতে জেমস মোগার হুঙ্কার। কোনও কিছু তো বাদ নেই।
দুপুরে একটি চ্যানেলে প্রিভিউ করতে এসে অতীত ময়দানের ‘বেকেনবাওয়ার’ গৌতম সরকার বলছিলেন, “পিয়ং ইয়ংকে একশো সাতাশটা ট্যাকল করে শেষ করে দিয়েছিলাম। জোয়াকিমরা ওটাই করুক না, দেখব কুয়েত কী করে!” মোগা আবার এ দিন সকালেই ছুটলেন দাঁতের ডাক্তারের কাছে। তার আগে বলে গেলেন, “ওদের দুর্বলতাও জানি। মাঠেই সব দেখা যাবে। শুধু গোল খাওয়া চলবে না।” মার্কোস ফালোপার মুখে এ দিন যত না বেশি ইংরেজি, তার চেয়ে বেশি স্প্যানিশ। গোলকে বলছেন, ‘গোলাজো’। বারবার বলে চলেছেন, “প্লিজ প্রে ফর ইট। প্রে ফর গোলাজো।” ফালোপা আতঙ্কে ভুগছেন ‘মারাকানাজো’ নিয়ে। ব্যাপারটা কী? ড্র করলেই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, এই অবস্থা থেকে মারাকানায় ১-০ এগিয়ে গিয়েও আবেগ বশীভূত হয়ে শেষে ১-২ হার। যে ম্যাচ সে দিনের পর থেকে পরিচিত ‘মারাকানাজো’ বলে। ব্রাজিল ফুটবলের ‘হিরোশিমা’ বলে। ফালোপার আজ ‘গোলাজো’ না হয়ে সাধারণ গোলে জিতলেও চলবে, কিন্তু কোনও ভাবেই ‘মারাকানাজো’ চলবে না।
ফালোপা যতই বলুন, আবেগের কাছে চব্বিশ ঘণ্টা আগে থেকেই হেরে যাচ্ছে যুক্তি। পরিসংখ্যান বলছে, কুয়েত এসসি শেষ ৮২ ম্যাচে দু’গোলের ব্যবধানে হেরেছে মোটে দু’বার। মহাশক্তিধর এই টিমের সঙ্গে পারবে নাকি ইস্টবেঙ্গল? প্রশ্ন করুন, অদ্ভুত উত্তর পাবেন মুহূর্তে। পরিসংখ্যানের পাল্টা হচ্ছে ফিল্ড টার্ফ। লাল-হলুদ শিবির থেকে বলা হচ্ছে, যুবভারতীর টার্ফ নাকি ঝামেলায় ফেলবেই ফেলবে জেমাদের। কুয়েত এসসি-র রোমানিয়ান কোচ মারিন ইয়োন, “‘আমরা ওদের জানি। আমরা এমনিই দু’গোলে এগিয়ে, তা ছাড়া আমরা এশিয়া সেরা,” বলে যাওয়ার মিনিট কয়েকের মধ্যে তার ‘প্রতিষেধকের’ খোঁজ পাওয়া গেল। সত্তর হাজারের ‘সিংহ গর্জন’। মানে, যুবভারতীর গ্যালারি। মানে, মার্কোস ফালোপার ‘দ্বাদশ ব্যক্তি’! |
টিমের বিরুদ্ধে টিম, জেমা বনাম প্রথম এফসি কাপে নামা অভিষেক, রজারিনহো বনাম মেহতাবসমষ্টি কিংবা নানাবিধ ব্যক্তিগত যুদ্ধেও বিপক্ষকে বিশেষ পাত্তা দেওয়া হচ্ছে না। ইস্টবেঙ্গলের যে ‘চতুর্ভুজ স্ট্র্যাটেজি’-র সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে তা এ রকম: এক) কুয়েতের আল বুরাইকি, জেমা আর ব্রাজিলীয় রোজারিনহোর আক্রমণের ত্রিভুজ ভাঙতে রক্ষণে ‘জোনাল মার্কিং’ করবেন অর্ণব-উগা। তাঁদের আগে ‘কোবরা ট্যাকল’ নিয়ে তৈরি থাকবেন অধিনায়ক মেহতাব। দুই) লাল-হলুদের ডান দিক দিয়ে আক্রমণে আসা জেমার জন্য ডাবল কভারিং-এর ফাঁদ পাতবেন জোয়াকিম, অভিষেক। এক জনকেই কাটালেই চলে আসবেন আর একজন। বাঁ দিকেও একই কৌশল নেবেন সৌমিক-ডিকা। তিন) মাঝমাঠকে জমাট করতে বিপক্ষের আক্রমণের সময় নেমে আসবেন কেভিন লোবো আর চিডি। চার) কুয়েত রক্ষণকে মিনিট কুড়ি দেখে ওভারল্যাপে উঠবেন দুই সাইডব্যাক। উঠবেন উইং হাফ এবং লোবোও।
ফালোপার মাঠের যুদ্ধ জেতার ফর্মুলা: ৪-১-৩-১-১।
ফালোপার মানসিক যুদ্ধ জেতার ফর্মুলা: “আটলান্টা অলিম্পিকে নাইজিরিয়া কাউন্টার অ্যাটাক দিয়ে রোমারিওর ব্রাজিলকে ফাইনালে শেষ করে দিয়েছিল। কানুরা পারলে আমরা কেন পারব না?”
এবং ‘আমরাও পারব’ এই ভরসা থেকেই ফালোপার সংসারে কেউ ‘কাফু’, কেউ ‘কানু’। অভিষেক দাস বা জেমস মোগাদের ইদানীং যে নাম ধরে ডাকা শুরু করেছেন ইস্টবেঙ্গল কোচ। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলে আজ বোধহয় কোনও ‘কাফু’ বা ‘কানু’-র চেয়েও অনেক বেশি করে একটা ‘ষষ্ঠী দুলে’ দরকার। প্রয়োজন আসিয়ান জয়ের সেই আত্মবিশ্বাসকে যা সময়-সময় মহাশক্তিধরদেরও সিংহাসনচ্যুত করে ছাড়ে।
দশ বছর আগে আসিয়ান ফাইনালে বেক তেরো সাসানার চাইম্যানকে যা বলেছিলেন ষষ্ঠী, সেটা মোটামুটি ভারতীয় ফুটবলের প্রবাদে ঢুকে পড়েছে। কে ভুলেছে ‘ইউ চাইম্যান, আই ষষ্ঠীর’ হুঙ্কার?
দশ বছর পর দরজায় আরও একটা ইতিহাস। বেক তেরো সাসানার বদলে কুয়েত এসসি। আসমুদ্র হিমাচল দেখতে চায় কোনও এক মেহতাব বা অর্ণব আজ জেমাকে বলে যাচ্ছেন, ‘ইউ জেমা, আই...।’
আশাবাদে আপত্তি নেই। মেহতাব যে বলে দিলেন, “আজ জীবন দিয়ে দেব!” |