নবান্ন-র সেন্ট্রাল গেটে ঢোকার মুখে ভিআইপি লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী বললেন, “আর কে আছেন, চলে আসুন!” শুনেই লাইনের একেবারে শেষে দাঁড়ানো তিন সরকারি কর্মী দৌড়ে উঠে পড়লেন। লিফট চলল বারো তলার উদ্দেশে। সোমবার ঘড়িতে তখন বেলা সাড়ে বারোটা।
পুজোর পরে কাজে ফেরার প্রথম দিনে ওই তিন জনই সবার শেষে অফিসে ঢুকেছেন। তাঁদের এক জন অর্থ দফতরের কর্মী। সোনারপুরে বাড়ি। সকাল আটটায় বেরিয়ে নবান্নে লিফটের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন দশটার কিছু আগে। কিন্তু যে সময়ে সোনারপুর থেকে হাওড়ায় পৌঁছেছিলেন, কার্যত তার চেয়ে বেশি সময় লেগেছে এক তলা থেকে দশ তলায় পৌঁছতে!
কারণ? সেই নবান্নের লিফট-বিভ্রাট, যা গোড়া থেকেই ভুগিয়ে আসছে পূর্ত দফতরকে। |
নবান্নে লিফট বিভ্রাট দেখে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী। সোমবার। —নিজস্ব চিত্র। |
এবং এই বিভ্রাট যে আরও ক’দিন চলবে, কার্যত তা ধরে নিয়েই নবান্নে হাজিরার কড়াকড়ি অনেকটাই শিথিল করেছেন দফতরের আধিকারিকেরা।
স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা বলেন, “বাস্তবটা মানতে হবে। বহু কর্মীর বয়স হয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়বেন। তখন আর এক বিপত্তি হবে।” সেই নিয়মেই অর্থ দফতরের ওই কর্মীর হাজিরা খাতায় এ দিন লাল দাগ পড়েনি। দফতরে বসে হাঁফ ছেড়ে ওই কর্মী বললেন, “ভাগ্যিস মুখ্যমন্ত্রী নিজের লিফট ছেড়ে দিলেন! না হলে আরও পরে পৌঁছতাম!”
পূর্ত দফতর জানাচ্ছে, নবান্নের পাঁচটা লিফটের মধ্যে দু’টোর গতি অতীব শ্লথ। হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়ার জন্য যেমন মন্থর লিফট থাকে, ওই দু’টি তেমনই। মূলত মালপত্র তোলা-নামানোর জন্যই সেগুলি তৈরি হয়েছিল। বাকি তিনটি লিফট-এর একটি মুখ্যমন্ত্রী-সহ ভিআইপিদের জন্য বরাদ্দ করেছে পূর্ত দফতর। বাকি দু’টি জনসাধারণের। এ দিন সকালে তারই একটিতে যান্ত্রিক গোলযোগ ধরা পড়ে। পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে ওঠে, যখন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একটি মন্থর লিফটও বন্ধ করে রাখা হয়েছে। সেটির গতি বাড়ানোর কাজ করছেন সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মীরা। এরই জেরে বেলা যত গড়িয়েছে, সব লিফটের সামনে মানুষের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। তার উপরে সাড়ে ১১টা থেকে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি পড়তে থাকায় কর্মীদের যে লাইন এত দিন ভবনের বাইরে চলে যেত, তা এ দিন পাক খেয়েছে একতলাতেই। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ায় যে এক সময় ভিড় সরিয়ে হাঁটাচলার পথ করে দিতে হয় পুলিশকে।
এর মধ্যেই বেলা পৌনে ১২টা নাগাদ মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ি এসে দাঁড়ায় সেন্ট্রাল গেটের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে পরিস্থিতি আঁচ করে তিনি দাঁড়িয়ে পড়েন ভিআইপি লিফটের সামনে। কর্তব্যরত পুলিশকর্তাদের ডেকে জিজ্ঞেস করেন, “এত লোক দাঁড়িয়ে কেন? লিফট চলছে না?” সামগ্রিক পরিস্থিতির কথা জেনে এর পরে মমতা বলেন, “সবাই উঠে যাক। তার পরে আমি উঠব।” মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনে সক্রিয় হয়ে ওঠেন রাজ্য প্রশাসনের কর্তারা। খবর পেয়ে নীচে নেমে আসেন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র। পিছুপিছু পূর্তসচিব ইন্দিবর পাণ্ডেও। ছুটে আসেন কলকাতা ও রাজ্য পুলিশের কর্তারা। তার আগেই অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা রক্ষীরা লিফটের জন্য অপেক্ষমান জনতার লাইন নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে তুলে নেন। সরকারি সূত্রের খবর, সেখানে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী পূর্তসচিবকে রীতিমতো ধমক দিয়ে লিফটের এই হাল কেন, তা জানতে চান। মুখ্যমন্ত্রী লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন শুনে চলে আসেন পূর্তমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষ দস্তিদারও। তবে মমতার কাছাকাছি যাননি। দফতরের ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে আগাগোড়াই একটু দূরে, ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে তাঁকে।
বেলা পৌনে ১২টা থেকে লিফটের সামনেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর উপস্থিতিতেই লাইনে দাঁড়ানো সরকারি কর্মীদের একাধিক দলে ভাগ করে লিফটে উঠিয়ে দেয় পুলিশ। সাড়ে ১২টা নাগাদ অপেক্ষমান শেষ তিন জন কর্মীকে লিফটে উঠিয়ে জায়গা ছাড়েন মুখ্যমন্ত্রী। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠার সময় মমতা দেখেন, মূল ভবনে যাওয়ার রাস্তায় কোনও পাপোশ নেই। ভেজা পায়ে টাইলসের মেঝেতে যে কোনও সময় আছাড় খেয়ে পড়তে পারেন লোকজন। পূর্তসচিবকে নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী, অবিলম্বে পা মোছার ব্যবস্থা করতে হবে। সেই শুনে আর এক প্রস্ত ছোটাছুটি শুরু করেন পূর্ত দফতরের কর্মীরা।
এর পরেও অবশ্য লিফট-বিভ্রাট পিছু ছাড়েনি নবান্নের। পূর্ত দফতর জানাচ্ছে, বেলার দিকে চালু একটি লিফটে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেওয়ায় কোথাও না থেমে সেটি ওঠানামা শুরু করে। এর ফলে ভিতরে আটকে থাকা যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। সেখানে ছিলেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রও। এগারো তলায় নিজের ঘরে যাবেন বলে এক তলায় লিফটে উঠেছিলেন তিনি। কিন্তু সেটি চার তলায় পৌঁছে বার দুয়েক ফের এক তলায় নেমে এলে শেষে লিফট থেকেই নেমে পড়েন অর্থমন্ত্রী। পরে উল্টো দিকের ভিআইপি লিফটে চেপে নিজের ঘরে পৌঁছন। একই অবস্থায় পড়েন কর্মিবর্গ ও প্রশাসনিক সংস্কার দফতরের সচিব অজিতরঞ্জন বর্ধনও। সাত তলায় দশ মিনিট দাঁড়িয়ে শুধু লিফটের ওঠানামা দেখে শেষে হেঁটেই নীচে নামেন তিনি। |