এই গ্রামে মেয়ের কাছে হার মেনে যান স্বয়ং উমাও।
জলঙ্গির গা ঘেঁষা তেহট্টের প্রান্তিক জনপদ কুষ্টিয়া। দুর্গাপুজো নয়, এ গ্রামের সবথেকে বড় উৎসব লক্ষ্মীপুজো। আর সেই পুজো উপলক্ষে প্রতিবারের মতো এবারেও জলঙ্গিতে বাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন গ্রামের মানুষ। শনিবার দুপুরে নদীর পাড়ে পা রাখতেই টের পাওয়া গেল উৎসবের আসল মেজাজ। কড়া রোদ উপেক্ষা করেই জল থইথই জলঙ্গীর দু’পাড়ে ভিড় যেন উপচে পড়ছে। কুষ্টিয়া তো বটেই আশপাশের গ্রাম থেকে সেই সকাল থেকে পিলপিল করে লোক জমতে শুরু করেছে। নদীর পাড়ে বসেছে বিরাট মেলা।
গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ কৃষিজীবী। প্রবীণ ব্যক্তিদের কথায়, “সেই কবে থেকে আমরাও শুনে আসছি এ গ্রামে দুর্গার থেকে লক্ষ্মীর কদরই বেশি। সেই ধারা আজও অক্ষুণ্ণ রয়েছে।” স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আগে এখানে বাইচ হত না। প্রায় ত্রিশ বছর আগে গ্রামের মানুষ একবার বাইচ দেখতে গিয়েছিলেন নাকাশিপাড়ার কলমার বিলে। সেখান থেকে ফিরে এসে কয়েকজন প্রস্তাব দেন যে কুষ্টিয়াতেও লক্ষ্মীপুজোর সময় জলঙ্গিতে বাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করলে কেমন হয়। সে প্রস্তাবে রাজিও হয়ে যান সকলেই। তারপর থেকেই লক্ষ্মীপুজোর সময় এই বাইচ প্রতিযোগিতা শুরু হয়। তখন প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসাবে দেওয়া হত নারকেল, গামছা। আর তাতেই ব্যাপক সাড়া পড়ে গিয়েছিল। |
পাশের গ্রাম চাঁদেরঘাট থেকে বাইচ দেখতে এসে নস্টালজিক হয়ে পড়েছিলেন তুহিন মণ্ডল। তিনি বলেন, “ছেলেবেলায় বাবা মায়ের হাত ধরে এই নদীতে বাইচ দেখতে আসতাম। এখানে এলেই পুরনো সেই দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে যায়।” তিনি বলেন, “তখন নদী রীতিমত ফুলে ফেঁপে থাকত। নদীর সঙ্গে অন্যান্য এলাকার খাল, বিলেরও যোগ ছিল। ফলে আশপাশের বহু এলাকা থেকে অনেক নৌকা আসত এই বাইচ প্রতিযোগিতায়। খাল, বিল, নদীর এখন যা অবস্থা তাতে আগের মতো বেশি নৌকা এখন আর আসতে পারে না ঠিকই। তবে সেই আবেগে কিন্তু কোনও ভাঁটা পড়েনি।”
বাইচ কমিটির সম্পাদক প্রদীপ মণ্ডল বলেন, “লক্ষ্মীপুজোর এই ক’টা দিনের দিনের জন্য বছরভর অপেক্ষায় থাকেন এলাকার মানুষ। কর্মসূত্রে বাইরে থাকা গ্রামের মানুষ বাড়ি ফেরেন এই সময়। শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি চলে আসেন গ্রামের মেয়েরাও। পুজোর সবথেকে বড় আকর্ষণ এই বাইচ। নৌকার সংখ্যাও আগের থেকে এখন অনেক কমে গিয়েছে। তবুও আমরা পুরনো এই ঐতিহ্যকে আপ্রাণ বাঁচিয়ে রাখতে চাই।” হাঁসপুকুরিয়ার নীলোৎপল দত্ত বলেন, “এই বাইচ এখন আর শুধু কুষ্টিয়ার উৎসব নয়। একে ঘিরে মেতে ওঠেন সব সম্প্রদায়ের মানুষ।”
পড়ন্ত বিকেলে নদীর দু’পাড়ে ভিড়টা আরও জমাট বাঁধতে থাকে। হেঁইয়ো হেঁইয়ো শব্দ করে পাশাপাশি ছুটে চলে নৌকাগুলো। নদীর পাড়ের মঞ্চের মাইক থেকে ভেসে আসে নানা সতর্ক বার্তা। খুদে নাতনির হাত ধরে ভিড় ঠেলে আরও একটু সামনের দিকে এগিয়ে যান এক বৃদ্ধা। শেষ বিকেলেও উৎসবের এই টুকরো মুহূর্তগুলো যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। |