বর্ষার ঘোলা জলে ফুলে ফেঁপে ওঠা এক গেরুয়া নদী। অলকা। পশ্চিম পাড়ে ভাঙাচোরা মন্দির। মন্দিরের এবড়োখেবড়ো চত্বরে এক চিলতে জায়গা সাফ করে অতি যত্নে নিকানো হয়েছে। তকতকে সেই উঠোনের মাঝখানে পাতা দুধসাদা ফরাস। চারপাশে সবুজ ফসলে ভরা খেত। ফরাসে জনাকয়েক বাউল। পরনে রঙিন আলখাল্লা। হাতে এতকারা, দুবকি, খমক। এক সুর থেকে আর এক সুরে। ভেসে আসছে - ‘গুরু, দোহাই তোমার, মনকে আমার লও গো সুপথে...।’ লালনগীতির সুরে ভেঙে যাচ্ছে কার্তিকের প্রথম সকালের নৈঃশব্দ।
নদিয়ার হরিহরক্ষেত্র। চারপাশে ছড়ানো অবিশ্বাস্য সব লালন মূর্তি। ভিড় জমিয়েছেন লালন সাঁইয়ের পড়শিরা। ‘মানুষ সত্যের’ কথককে তাঁর তিরোধানের দিনে স্মরণ করতে গঙ্গাবাস যেন সত্যি সত্যিই আরশিনগর হয়ে উঠেছিল। পয়লা কার্তিক, রবিবার সেখানেই বসেছিল লালন ফকিরের ১২৪তম প্রয়াণ বার্ষিকীতে সাধুসঙ্গের আসর। নগর কোলাহল থেকে দূরে গভীর নির্জন সেই আসরে হাজির ছিলেন মনসুর ফকির, অর্জুন খ্যাপা, গোলাম ফকিরের মতো মানুষরা। |
আয়োজনে ‘লালনায়ণ’। যাঁর উদ্যোগে এই নিভৃত স্মরণ আয়োজন তিনি লালমোহন গুড়িয়া। পেশার সঙ্গে নেশার এক আশ্চর্য বৈপরীত্যের মানুষ লালমোহনবাবু। তাঁরই তৈরি সংগঠন, ‘লালনায়ণ’ বেশ কয়েক বছর ধরে লালন ফকিরকে নিয়ে উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ করে চলেছে। রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মী লালমোহনবাবু গত পঁচিশ বছর ধরে ফেলে দেওয়া কাঠকুঠো আর গাছের শিকড় দিয়ে গড়ে তুলেছেন হাজার খানেকেরও বেশি লালন মূর্তি। পাঁচ ইঞ্চি থেকে পাঁচ ফুট উচ্চতার ওই মূর্তি রাজ্য ও সর্বভারতীয় পর্যায়ে নানা পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছে। সেই লালমোহনবাবুরই উদ্যোগ লালন ফকিরের মৃত্যু বার্ষিকীর এই অনুষ্ঠান। তাঁর আক্ষেপ, “দু’শো বছর ধরে লালনের গান আমাদের জীবনের চলমান ঐতিহ্য। আমরা তাঁকে আপন করতে পারিনি। কিন্তু অবিভক্ত বাংলাদেশের যে নদিয়া জেলায় তিনি জন্মেছিলেন সেই নদিয়াও তাঁকে সেভাবে মনে রাখেনি।”
লালন ফকিরের গোটা জীবনটাই বড় আলো আঁধারিতে ভরা। ১৮৯০ সালে লালন ফকিরের মৃত্যু সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর অত্যন্ত কাছের মানুষ মীর মোশারফ হোসেন সম্পাদিক পাক্ষিক পত্রিকা, ‘হিতকরী’তে। আর এক লালন ঘনিষ্ঠ কাঙাল হরিনাথের ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ থেকেও জানতে পারা যায় যে, ১৮৯০ সালে ১১৬ বছর বয়সে লালন মারা যান। দিনটা ছিল শুক্রবার। মৃত্যুর দিন ভোর পর্যন্ত লালন তাঁর শিষ্যদের নিয়ে গানবাজনা করেন। তারপর এক সময় তিনি শিষ্যদের বলেন- ‘আমি চলিলাম।’ তাঁর মৃত্যুর বারো দিন পর ‘হিতকরী’তেই প্রথম ছাপা অক্ষরে লালনের মৃত্যু সংবাদ প্রকাশিত হয়। নদিয়ার প্রাক্তন জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক অলোক সান্যাল বলেন, “অন্য পেশার মানুষ হয়েও লালমোহন গুড়িয়া যে ভাবে লালনচর্চা করে চলেছেন তা সাধুবাদের যোগ্য।”
রবিবার বেলা যত গড়িয়েছে ততই লালনময় হয়ে উঠেছে হরিহরক্ষেত্র। একতারাতে আঙুল চালাতে চালাতে কখনও গোলাম ফকির গেয়ে উঠছেন- ‘আপন জন্মের কথা যে জানে রে ভাই...।’ কার্তিকের বেলা দ্রুত ফুরিয়ে আসে। অলকার উপরে জমতে থাকা কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বাউল বলে চলেন, “এগোতে থাকুন সাঁই। চলার পথেই আবার ঠিক দেখা হয়ে যাবে। কোন পথ যে কোথায় পৌঁছয়, কে বলতে পারে!” |