|
|
|
|
কবিগুরুর ওড়িশা যাত্রা স্মরণ মহিষাদলে
অমিত কর মহাপাত্র • মহিষাদল |
আজ সোমবার, যুবক রবীন্দ্রনাথের ওড়িশা-যাত্রা উদ্যাপন করছে মহিষাদল।
১৩ অগ্রহায়ণ ১৩৭৩ সালে প্রকাশিত ‘পিতৃস্মৃতি’ বইয়ে কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “জমিদারি পরিদর্শন করার জন্য বাবাকে প্রায়ই ঘুরে বেড়াতে হত। জমিদারিগুলি ছিল ছড়ানো। নদিয়া, পাবনা, রাজশাহি বাংলার এই তিন জেলা ছাড়াও ওড়িশার কটক জেলায় সেগুলি অবস্থিত ছিল। ... কত না গ্রাম্য জীবনের দৃশ্য, যুগের পর যুগ যার কোনো পরিবর্তন নেই নির্বিকার, শান্ত সমাহিত অথচ শ্রমশীল বাবা বোটে বসে দেখতে দেখতে চলতেন। জলপথ তাঁর এত ভাল লাগত যে কলকাতা থেকে কয়েকবার তিনি খাল দিয়ে বোটে করে বারাবর কটক পর্যন্ত গিয়েছিলেন।”
জমিদারি দেখভালের কাজে কবি রবীন্দ্রনাথের সেই ওড়িশা যাত্রা সম্পন্ন হয়েছিল ১৮৯৭ সালের ২১ অক্টোবরে তৎকালীন অভিভক্ত মেদিনীপুরের নানা অংশ দিয়ে। যার মধ্যে অন্যতম ছিল অধুনা মহিষাদল। ১১৭তম বর্ষে সেই দিনটিকে কবির সেই সময়ে লেখা কবিতা, কাব্যনাট্য পাঠের মধ্য দিয়ে উদযাপনের আয়োজন করেছে সাংস্কৃতিক সংস্থা ‘শ্রুতিশৈলি’। উঠোন ছুঁয়ে রবির তরী শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে দিনটির স্মৃতিচারণ করা হবে। সংস্থার সম্পাদক অরিজিৎ বসুর কথায়, “মহিষাদলের ইতিহাস, জল-মাটি কবির ওই ভ্রমণের ফলে সমৃদ্ধ হয়েছে। বছর তিনেক আগে আনন্দবাজারের এক প্রতিবেদন পড়ে বিষয়টি আমাদের নজরে আসে। তারপরই দিনটিকে স্মরণে রাখতে আমরা অনুষ্ঠান করার কথা ভাবি। এ বার প্রথম হলেও প্রতি বছর আমরা এই দিনটি উদ্যাপন করব।” |
এই হিজলি টাইডাল ক্যানাল ধরেই ওড়িশা গিয়েছিলেন কবি।
চলছে আজকের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। —নিজস্ব চিত্র। |
১৮৮৯ সালের ডিসেম্বর থেকে বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্দেশে ১৮ বছরের যুবক রবীন্দ্রনাথকে পারিবারিক জমিদারির তদারকির দায়িত্ব নিতে হয়। এই সূত্রে তিনি ১৮৯১ সালের অগস্টে প্রথমবার স্টিমারে চেপে ওড়িশা যাত্রা করেন তিনি। কবি দ্বিতীয়বার ওড়িশা যান ১৮৯৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। সে বার সঙ্গী ছিলেন ভাইপো বলেন্দ্রনাথ। এই দু’বারই তিনি যান নদী ও সমুদ্রপথে স্টিমারযোগে। কলকাতা থেকে যাত্রা শুরু করে উলুবেড়িয়া, ফলতা, গেঁওখালি, হুগলির মোহনা হয়ে ওড়িশা। এই দু’বারই তিনি অধুনা পূর্ব মেদিনীপুরের ভূখণ্ড লাগোয়া জলপথ ধরে গেলেও জেলার মধ্যে ঢোকেননি। তিনি প্রথম পর্বে ওড়িশায় গিয়ে পাণ্ডুয়ায় এক সপ্তাহ থাকার সময় কুঠিবাড়িতে বসে লিখেছিলেন কাব্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’। দ্বিতীয় যাত্রায় (১৮৯৩) ওড়িশার তালদণ্ডা খালপথে লিখেছিলেন ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থের তিনটি কবিতা ‘অনাদৃতা’, ‘নদীপথে’ (প্রথম নাম ছিল খালপথে) এবং ‘দেউল’। জাহাজে কলকাতা ফেরার সময় বৈতরণী নদীতে লিখেছিলেন ওই কাব্যগ্রন্থেরই আরও একটি কবিতা ‘বিশ্বনৃত্য’।
প্রথম দুবার স্টিমারে গেলেও, ১৮৯৭ সালের অক্টোবরে তৃতীয়বার তিনি পূর্ব মেদিনীপুরের খালপথ ধরেই ওড়িশা যান। সে বার যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল জমিদারির ভাগ-বাটোয়ারা করা। কবির অন্যতম দুই জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ও প্রশান্তকুমার পালের গ্রন্থসূত্র অনুযায়ী, ওড়িশার জমিদারি তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথকে দিয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। হেমেন-এর অকালমৃত্যুর পর এজমালিতে সেই জমিদারির দেখভাল করা হচ্ছিল। পরে হেমেন্দ্রমাথের পুত্ররা সাবালক হলে তাঁদের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে রবীন্দ্রনাথের উপর। কবি সেই উদ্দেশে আসা যাত্রাপথের বিবরণ লিখেছেন ‘কুন্তলীন’ পঞ্জিকায়। সেই বিবরণ অনুযায়ী, ১৮ অক্টোবর তিনি কলকাতা থেকে রাজগঞ্জ আসেন। পর দিন রাজগঞ্জ থেকে উলুবেড়িয়া খাল দিয়ে দামোদর পর্যন্ত আসেন। ২০ অক্টোবর কাঁটাপুকুর হয়ে রূপনারায়ণ নদী দিয়ে গেঁওখালি এসে হিজলি টাইডাল ক্যানালে প্রবেশ করেন। ওই দিন মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছিল। পর দিন হলদি ও রসুলপুর নদী পেরিয়ে ওড়িশা কোস্ট ক্যানালে প্রবেশ করেন। সে দিনই নৌকায় বসে লেখেন ‘কথা’ কাব্যগ্রন্থের ‘শ্রেষ্ঠভিক্ষা’ নামের বিখ্যাত কবিতাটি। ২২ অক্টোবর কবি লিখছেন, “প্রায় ৬০ মাইল আসা গেছে, দিন মেঘাবৃত, অত্যন্ত গুমোট।” ওই দিনই লেখেন ‘প্রতিনিধি’ নামক কবিতাটি। পরে ২৫ অক্টোবর ব্রাহ্মণী নদীতে লেখেন ‘পতিতা’ ও ২৯ অক্টোবর আলভা খালে লেখেন ‘দেবতার গ্রাস’ নামক কবিতাটি। রবিজীবনীকার প্রশান্তকুমার পালের ধারনা, সমগ্র যাত্রা পথে কবির সঙ্গী ছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ।
জেলার বাসিন্দা তথা রবীন্দ্র গবেষক প্রবালকান্তি হাজরা মনে করেন, “খালপথের নির্জনতায় গ্রামজীবন দেখে লেখার রসদ খুঁজে পাওয়ার লক্ষ্যেই হয়ত তৃতীয় বার নৌকা নিয়ে খালপথ ধরেন কবি। ওই সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকায় বিপদ এড়াতে তিনি নদী ও সমুদ্রপথ হয়ত এড়াতে চেয়েছিলেন। তা ছাড়া নতুন পথ চেনার আগ্রহও তাঁর ছিল।” তবে, এরপর কবি নদী বা খালপথে আর কখনও ওড়িশা যাননি।
মহিষাদল ছুঁয়ে ২১ অক্টোবরে ওই যাত্রাই সোমবার প্রথমবার উদযাপিত হওয়ার কথা। এই উপলক্ষে হিজলি টাইডাল ক্যানালে রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি-সহ নৌকা ভাসানো হবে। তখনকার সময়ে লেখা রচনাগুলি নিয়ে নানা স্বাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভাও আয়োজিত হবে। এলাকার বাসিন্দা শিক্ষিকা শিখা ঘোষ, অধ্যাপক বাদলকুমার বেরা-এমন ইতিহাস জানতে পেরে আপ্লুত। শিখা ঘোষের কথায়, “বিশ্বকবির স্মৃতিধন্য এই খাল। এলাকাবাসী হিসাবে এটা আমাদের গর্বের। কবির এই সাময়িক সংসর্গে মহিষাদল ধন্য হয়েছে।”
জেলার তথ্য সংস্কৃতি আধিকারিক তপন তরফদার এমন অভিনব উদ্যোগে খুশি। তিনি বলেন, “প্রশংসনীয় উদ্যোগ। বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। ভবিষ্যতে দিনটি উদ্যাপনে যথাযথ ভূমিকা নেওয়া হবে।”
সব মিলিয়ে রবীন্দ্র-যাত্রা-তর্পণ ঘিরে স্মৃতিমেদুর মহিষাদল। |
|
|
|
|
|