তিনি কি বিশ্ব ফুটবলের ইন্দ্রজিৎ! নাকি কর্ণ!
মেসি, রোনাল্ডো, নেইমারদের সঙ্গেই রয়েছেন তিনি। কিন্তু আলাদা ভাবে। আলাদা আঙ্গিকে। প্রচারের সার্চলাইটের ফোকাস তাঁকে সে ভাবে ছুঁয়ে যায় না। মারাদোনা-পেলেদের ফুটবল মহাকাব্যেও তিনি উপেক্ষিত। বিতর্কিতও বটে। কিন্তু অলৌকিক গোলের অভিধান খুললে তাঁর নাম এঁদের বেশির ভাগের চেয়েই এগিয়ে।
ফুটবল বিশ্বও নতুন সহস্রাব্দে অলৌকিক গোলের নায়ক হিসাবে এক জনকেই চিহ্নিত করছে বারবার। সাগরপারের প্রচারমাধ্যমও সুইডেনের সেই জ্লাটান ইব্রাহিমোভিচের প্রশস্তি গাইতে গিয়ে বলছে, বিস্ময় গোলের ‘প্রিন্স চার্মিং’ তিনিই এক এবং অনবদ্য ইব্রা। আর সে সব গোলের নামও সব অদ্ভুত। গত বছর ইংল্যান্ড গোলকিপার জো হার্ট যেমন কাবু হয়ে গিয়েছিলেন ইব্রাহিমোভিচের ‘প্রপেলার কিক’-এর কাছে। অসহায়ের মতো দেখেছিলেন শূন্যে ভাসমান ইব্রার কিক কী অদ্ভুত ভাবেই না জালে জড়িয়ে গেল!
এ বারও সংবাদ শিরোনামে সেই ইব্রাহিমোভিচ। শনিবার রাতে ফরাসি লিগে বাস্তিয়া-র বিরুদ্ধে ইব্রাহিমোভিচের ‘স্করপিয়ন কিক’ ফের দুলিয়ে দিয়েছে সাও পাওলো থেকে সাইতামা। যে ‘স্করপিয়ন কিক’-এর পেটেন্ট এত দিন নিজের জিম্মায় রেখে দিয়েছিলেন ’৯০-এর ইতালি বিশ্বকাপে নজর কাড়া কলম্বিয়ান গোলকিপার রেনে ইগুয়েতা, শনিবার রাত থেকে ইব্রার গোল তাতে ভাগ বসাল!
বাস্তিয়ার রক্ষণে যখন বল ধরছেন ইব্রা, তখন তাঁর গায়ের সঙ্গে সেঁটে রয়েছে মার্কার।শরীরে ডাকটিকিটের মতো লেগে থাকা ওই মার্কারকে নিয়েই বাঁ পায়ে শরীরে যাবতীয় ভারসাম্য রেখে শূন্যে ভাসিয়ে দিলেন ডান পা। যে ভাবে ‘স্করপিয়ন’ বা কাঁকড়াবিছে তার হুল পিছনে তুলে ধরে, ঠিক সে ভাবেই ইব্রাহিমোভিচের ব্যাক হিল। শরীরের যাবতীয় ভরকেন্দ্র তখন তাঁর বাঁ পায়ের পাতায়। আর সেই বল অর্ধবৃত্তের কক্ষপথে ভাসতে ভাসতে জড়িয়ে গেল বাস্তিয়ার গোলে। অবাক বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখলেন বাস্তিয়া গোলকিপার। কমেন্ট্রি বক্সে দশ সেকেন্ডের মতো চুপ ভাষ্যকাররাও। তার পরেই গোলের উল্লাসে চিল-চিৎকার। |
অবিশ্বাস্য, আরও এক বার... |
সতীর্থের পাস থেকে বল পাচ্ছেন। |
চলতি বলেই ব্যাক হিল। |
বল গোলের দিকে। |
স্তম্ভিত রক্ষণ দেখছে অবিশ্বাস্য গোল। |
|
কী ভাবে প্যারিস সাঁ জাঁ-র জার্সি গায়ে এই ‘এলাম-দেখলাম-জয় করলাম’ মার্কা গোলটা করলেন ইব্রা, তা নিয়ে কাটাছেঁড়া শুরু হয়ে গিয়েছে খেলা শেষের সঙ্গে সঙ্গেই। কেউ বলছেন, “এটা অবিশ্বাস্য। ইব্রা মানুষ নয়। ফুটবলের নিনজা।” আবার কেউ বলছেন, “মাধ্যাকর্ষণকে পকেটে নিয়ে ঘোরেন বলেই যখন-তখন শূন্যে ভাসমান বল নিয়ে অলৌকিক সব কাণ্ডকারখানার সঙ্গে গোল করে যান বার্সেলোনায় মেসির একদা সতীর্থ।” আর এই আলোচনা থেকেই বেরিয়ে এসেছে ইব্রার অন্য আর এক গুণের প্রকাশ। সতেরো বছরে তায়কোন্ডোর ব্ল্যাক বেল্ট পাওয়া এই তারকা ফুটবলের সঙ্গে মার্শাল আর্টের মিশেল ঘটাচ্ছেন বলেও গোলের পোস্টমর্টেম রিপোর্টে জানিয়েছেন কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ। তাঁরা আবার এই গোলকে বলছেন, ‘তায়কোন্ডো কিক’।
গোলটা দেখার পর উইম্বলডন চ্যাম্পিয়ন অ্যান্ডি মারের টুইট, “বাস্তিয়ার বিরুদ্ধে ইব্রাহিমোভিচের গোলটা কেউ দেখেছেন? না দেখলে একটা বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার শরিক হওয়া হল না আপনার।”
শুধু কী সাগরপারে! ভারতের ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়েও আছড়ে পড়েছেন ইব্রাহিমোভিচ। এ দেশের ফুটবলে যিনি অবিশ্বাস্য সব গোল করে কিংবদন্তি, সেই আইএম বিজয়ন ত্রিশূরের বাড়ি থেকে শনিবার রাতের গোল সম্পর্কে বলতে গিয়ে ষোলো বছরের কিশোরের মতো আবেগে ভেসে গেলেন। অনেকটা যে ভাবে এক যুগ আগে ক্যাচ লুফতে শূন্যে ভাসমান দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটার জন্টি রোডসকে পরিচয় করাতে গিয়ে ভাষ্যকার বলেছিলেন, “এটা কি ফ্লাইং সসার? এটা কি সুপারম্যান? না এটা জন্টি রোডস’’ টেলিফোনে আনন্দবাজারকে ঠিক সেই সুরেই ভারতীয় ফুটবলের আইএমভি বললেন, “মেসি-রোনাল্ডোরা আমার কাছে মানুষ। পেলে-মারাদোনাও। কিন্তু ইব্রাহিমোভিচের গোল দেখে আমার মনে হয় ও অন্য গ্রহ থেকে আসা কোনও ফুটবলার। অবিশ্বাস্য!” আট-নয়ের দশকে ময়দানে দারুণ সব গোল করা শিশির ঘোষও বলছেন, “পেলে, মারাদোনা, মেসিদের প্ল্যাটফর্মে না থেকেও ইব্রাহিমোভিচ নিজেই ফুটবলের একটা অজানা অধ্যায়। একটা মিসিং লিঙ্ক।” আর বিশ্ব ফুটবলের তাবড় তাবড় বিশেষজ্ঞ বলছেন, “জ্লাটান হল পুরোদস্তুর সেন্টার ফরোয়ার্ড। যে শূন্যে, মাটিতে সব জায়গাতেই বলকে নিজের চাকর বানিয়ে রাখতে ভালবাসে।”
ভাগ্যিস! সুইডেনের মালমো বন্দরে অভাবের তাড়নায় কাজ করতে আসা বছর পনেরোর ছেলেটাকে ভাগিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর ম্যানেজার। বলেছিলেন, “তুমি গিয়ে ফুটবল খেলো। এক দিন তোমার স্মারক বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই একটা আস্ত জাহাজ লাগবে।” তার জেরেই তো আজ ফুটবল বিশ্ব ইব্রাহিমোভিচ-সভ্যতার সামনে দাঁড়িয়ে।
আয়াখসে খেলার সময়ই ইব্রাহিমোভিচের স্কিল দেখে ফুটবল কলমচিদের জগতে চালু হয়ে যায় ‘জ্লাটান ফ্লিক’-এর কথা। সেই আয়াখসেই সতীর্থ ফান দার ভার্টকে মারধর করে বিতর্কের শিরোনামে। বার্সেলোনায় থাকার সময় কোচ গুয়ার্দিওলার সঙ্গে ঝামেলা। কোচকে কিটস ছুড়ে বিদ্রুপ। মেসি সম্পর্কে আত্মজীবনীতে কটূক্তি। বিস্ময়-গোলের পাশাপাশি বিতর্কও লেগে আছে ইব্রার জীবনে। মহম্মদ আলির ভক্ত ইব্রাহিমোভিচ যদিও মনে করেন তিনি নিজে সরল মনের মানুষ। বলেন, “আলির মতোই আমি নিজের বিশ্বাসে অটল থাকি। সেখান থেকে সরি না।”
মাঠেও বলকে অলৌকিক কায়দায় গোলে ঢোকানোর সময় নিজের প্রতি বিশ্বাস হারান না বলেই বোধহয় আজ নিজেই নিজের উপমা ইব্রাহিমোভিচ। |