উন্নয়নের সংজ্ঞা কী, সেই বিষয়ে তর্কের শেষ নাই। পশ্চিমবঙ্গে কয়েক বছর আগে ‘কৃষি হইতে শিল্প’র পথে অভিযানকে উন্নয়ন বলিয়া অভিহিত করিয়াছিলেন তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং তাঁহার সরকার। কথাটি যে ফেলিয়া দিবার নয়, তাহা কাণ্ডজ্ঞানই বলিয়া দেয়। পশ্চিমবঙ্গের শিল্পায়নের অভাব ও ত্রুটি লইয়া ইতিমধ্যে বিস্তর আলোচনা হইয়াছে। কিন্তু কথাটির গুরুত্ব সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটেও কোনও অংশে কম সত্য নহে। ভারতীয় অর্থনীতির সংকট বা বিপদ গত কয়েক মাসে বহু-আলোচিত। কী সেই সংকটের মূলে, কী ভাবেই বা সেই বিপদ কাটানো সম্ভব, তাহার বহু ব্যাখ্যা শোনা গিয়াছে, কিন্তু সেই আলোচনায় একটি মূল সমস্যার কথা বিশেষ বলাই হয় নাই। তাহা শিল্পায়নের সমস্যা। আরও নির্দিষ্ট করিয়া বলিলে ‘ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি’ বা উৎপাদন শিল্পের সমস্যা।
ভারতীয় অর্থনীতির যে অগ্রগতি গত দুই দশকে ঘটিয়াছে, তাহাকে পরিষেবা-নির্ভর অগ্রগতি বলিলে ভুল হয় না। তুলনায় উৎপাদন শিল্পে ভারতের অগ্রগতি নিতান্ত সীমিত। জাতীয় আয়ে উৎপাদন শিল্পের অবদান কুড়ি শতাংশের আশেপাশেই ঘোরাফেরা করিতেছে। কিছু ঐতিহাসিক বা ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রকে বাদ দিলে শিল্পজাত পণ্যের দুনিয়ায় ভারতের স্থান নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর। পেট্রোলিয়ম আমদানির খরচ বাদ দিলে ভারতের বাণিজ্যিক ঘাটতির এক বিপুল অংশের পিছনে দায়ী চিনা পণ্য আমদানির খরচ। শিল্প উৎপাদনে ভারত যদি তাহার প্রতিবেশী দেশটির তুল্য দক্ষতা ও সাফল্য অর্জন করিতে পারিত, বাণিজ্য ঘাটতির এই বিভীষিকা দেখা দিত না। কেন চিন পারিয়াছে, ভারত পারে নাই? উত্তর সহজ। শিল্পের দক্ষতার জন্য যাহা প্রয়োজনীয়, ভারত তাহার সুব্যবস্থা করিতে পারে নাই। পরিবহণ বা বিদ্যুতের মতো অত্যাবশ্যক পরিকাঠামোর সরবরাহও অনিয়মিত, ব্যয়বহুল ও নিকৃষ্ট মানের। একটি উদাহরণ: ভারতে পণ্যবাহী ট্রাকের গড়পড়তা গতি চিনের দ্বিগুণ। অন্য দিকে, আইনি এবং প্রশাসনিক বাধা ও বিভিন্ন স্তরের দুর্নীতি কোনও কাজই সুষ্ঠু ভাবে ও দ্রুত গতিতে সম্পন্ন হইতে দেয় না। জমি বা কয়লা খনির অধিকার পাইবার সমস্যা, অনমনীয় এবং অচল শ্রম আইন, ‘ইনস্পেক্টর রাজ’-এর দৌরাত্ম্য শিল্প-উদ্যোগীর সমস্যার অন্ত নাই।
এই সমস্ত সমস্যার সহিত রহিয়াছে একটি গভীর, মৌলিক এবং দীর্ঘমেয়াদি সংকট। শিক্ষার সংকট। বর্তমান দুনিয়ায় উৎপাদন শিল্পে কর্মী হিসাবে দক্ষতা অর্জনের জন্য শিক্ষা অত্যাবশ্যক। অন্তত মাধ্যমিক স্তর অবধি শিক্ষা না থাকিলে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা প্রায়শ অসম্ভব। পশ্চিম দুনিয়ার বাহিরে আধুনিক শিল্পের অগ্রগতিতে প্রথম চমকপ্রদ সাফল্য অর্জন করে জাপান। ইহার পিছনে বিরাট ভূমিকা ছিল শিক্ষার বিস্তারে সে দেশের বিপুল সাফল্যের, যে শিক্ষাবিস্তার প্রক্রিয়া উনিশ শতকে শুরু হইয়া বিশ শতকের প্রথম দুই দশকের মধ্যেই কার্যত সম্পন্ন হয়। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শিল্প-সফল দেশগুলি এই সত্যকেই কাজে লাগাইয়াছে। চিনও। বুনিয়াদি শিক্ষার দৌড়ে ভারত আজও হাঁটি হাঁটি পা পা করিতেছে। মাধ্যমিক শিক্ষার ভিতটি সীমিত এবং দুর্বল, শ্রমিক-কর্মীদের দক্ষতাও সমানুপাতে সীমিত এবং দুর্বল। এই মৌলিক সমস্যাগুলির সমাধান করিতে না পারিলে উৎপাদনের দক্ষতা আসিবে না। ভিত শক্ত না হইলে ইমারত দাঁড়ায় না। |