সমাধানের মধ্যেই সমস্যা। আপাতদৃষ্টিতে বোধ হইতেছে, আমেরিকায় ‘শাটডাউন’ সংক্রান্ত অচলাবস্থার নিরসন হইল। কিন্তু, সত্যই কি হইল? আমেরিকার অম্বেডকররা যখন কলম ধরিয়াছিলেন, তখন তাঁহাদের প্রধান চিন্তা ছিল কী ভাবে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রায় একচ্ছত্র ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ওই দেশে নাগরিকরা কোনও দলকে নহে, এক জন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নির্বাচন করেন। ভারতে একটি দল নির্বাচিত হয়। বাঙালিরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচন করেন নাই, করিয়াছেন তৃণমূল কংগ্রেস দলটিকে। সেই দলের নেত্রী হিসাবে মমতা এখন রাজ্যপ্রধান। শুধু তিনি নহেন, তাঁহার মন্ত্রিসভার সদস্যরাও দলীয় প্রতিনিধি হিসাবে রাজ্যের আইনসভার নির্বাচিত সদস্য। আমেরিকানরা কিন্তু ব্যক্তি বারাক ওবামাকে নির্বাচন করিয়াছেন। আর ওবামার মন্ত্রিসভা জনগণের দ্বারা নিযুক্ত নয়, তাঁহাদের নিয়োগ করিয়াছেন এক জন ব্যক্তি এ ক্ষেত্রে বারাক ওবামা। সংবিধান রচয়িতারা সচেতন ছিলেন যে এক জন ব্যক্তির এই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা মঙ্গলজনক না-ও হইতে পারে। অতএব, তাঁহারা ক্ষমতায় রাশ টানিয়া দিয়াছিলেন স্বাধীন আইনসভার মাধ্যমে। প্রায়শই সে দেশে দেখা যায়, রাষ্ট্রপতি এবং আইনসভা বিপরীত ধারণার পন্থী। ভূত সরিষার মধ্যেই। সমস্যাটাই সৃষ্ট। সচেতন ভাবেই।
মার্কিন ব্যবস্থার আকর্ষণ এইখানেই। এক দিকে অপরিসীম ক্ষমতা এক ব্যক্তির হাতে, অপর দিকে সেই ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রায় একই রকম ক্ষমতাবান আইনসভা। প্রশাসন উদ্যোগ করিতে পারে, কিন্তু আইনসভার অনুমোদন না পাইলে তাহা খাতায়-কলমেই থাকিয়া যাইবে। যেহেতু প্রেসিডেন্ট তাঁহার দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্বাচিত হন না, অতএব আইনসভার উভয় কক্ষেই যে তাঁহার দলেরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকিবে, সেই নিশ্চয়তাও নাই। এখনই যেমন সেনেটে রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। গণতন্ত্রের আবশ্যিক বহুমতের শর্তটি, অতএব, পূর্ণ হয়। প্রেসিডেন্ট ও তাঁহার মন্ত্রিসভা, এবং সেনেট ও কংগ্রেস এই দুইটি প্রতিষ্ঠান পরস্পরের সহিত সাযুজ্য রাখিয়া নিজের নিজের কাজ করে, এবং সেই কাজ চরিত্রগত ভাবেই একে অপরের অধিকারের সীমা বাঁধিয়া দেয় এবং তাহাকে সম্মান করে। প্রেসিডেন্ট ইচ্ছা করিলেই আইন পাশ করিতে পারেন না। আবার, আইনসভার দুই-তৃতীয়াংশের কম সদস্য যদি কোনও বিলে সম্মতিও জানান, প্রেসিডেন্টের সম্মতি ব্যতিরেকে তাহা আইনে পরিণত হইতে পারে না। গণতন্ত্র এই পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণে বিশ্বাসী। এর ফলে সব সিদ্ধান্তকেই নানা তর্কের সম্মুখীন হইতে হয়। ইহাতে ধারণা অনেক স্পষ্ট হয়, বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি আলোচিত হয়, যাহার ফল সিদ্ধান্ত অনেক বেশি সমৃদ্ধ, সেই কারণেই গণতান্ত্রিক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই অচলাবস্থায় কোনও শঙ্কার কারণ নাই, উল্লাসের হেতু আছে। সত্য, ওয়াশিংটন ডিসি-র পরিবর্তে বেজিং-এ কখনও এমন ঘটনা ঘটিত না। লন্ডন কিংবা নয়াদিল্লিতেও নহে। কিন্তু, তাহাতে গণতন্ত্রের পরাজয় প্রমাণিত হয় না, তাহার মহিমাও খর্ব হয় না। অতএব, যাঁহারা প্রজাতন্ত্রী চিনের দিকে মুখ করিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতের ন্যায় দেশে গণতন্ত্রের ‘বাহুল্য’ বিষয়ে হাহুতাশ করেন, ‘শাটডাউন’ সংকটে তাঁহাদের উল্লসিত হইবার বিশেষ কারণ নাই। ওবামা হয়তো নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল থাকিতে পারিয়াছেন, কিন্তু তাহার জন্য তাঁহাকে পরিশ্রম করিতে হইয়াছে। মতবিরোধীদের সঙ্গে আলোচনায় বসিতে হইয়াছে। ভবিষ্যতে জানা যাইবে, তাহার জন্য কী দেওয়া-নেওয়া হইয়াছে। মনে হইতে পারে, ওবামা অনেকটাই পাইয়াছেন। তাহার জন্য তাঁহাকে কিছু দিতেও হইয়াছে। তাহা বাজেটে না হইলেও, অন্যত্র ধরা পড়িবে। কিন্তু এই দেওয়া-নেওয়ার মধ্যেই মার্কিন গণতন্ত্রের শক্তি। তাহা পরস্পরের মতের প্রতি শ্রদ্ধার প্রকাশ। |