|
|
|
|
বাবা নেপথ্যে
কন্যা মঞ্চে |
বাবার নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
এ বার তিনি শুধুই অনুবাদক ও নির্দেশক। আর তাঁর কন্যা
পৌলোমী চট্টোপাধ্যায় পরপর দু’দিন আলাদা স্বাদের দুই নাটকে।
সেই মহড়া দেখে
এলেন গৌতম চক্রবর্তী |
চার বছরের দুর্বিপাক কাটিয়ে অবশেষে আগামী রবিবার মঞ্চে আসছে ‘সবজান্তা।’
মার্কিন নাট্যকার জ্যাক পোপ্লওয়েলের বিখ্যাত কমেডি-থ্রিলার ‘বিজিবডি’। অফিসে খুন! মাঝবয়সি কেয়ারটেকার ভদ্রমহিলাকে নিয়ে সকলে বিরক্ত, তিনি সব ব্যাপারে অহেতুক নাক গলান। শেষে ওই মহিলার বুদ্ধিতেই ধরা পড়ে খুনি।
বছর কয়েক আগে, আমেরিকায় বেড়াতে গিয়ে নাটকের বইটি কিনেছিলেন দীপা চট্টোপাধ্যায়। ইচ্ছে ছিল, তাঁর চেনা একটি ছোট দলে নাটকটি অভিনীত হবে। সেই মতো অনুবাদ শুরুও করেন। কিছু দূর এগোনোর পর নানা ব্যস্ততায় অনুবাদ শিকেয়। অসমাপ্ত অনুবাদের এই দুর্বিপাক এড়ানো গেল দীপার স্বামীদেবতার কল্যাণে। ইতিমধ্যে নাটকটি তিনি পড়ে ফেলেছেন। এবং এত চমৎকার লেগেছে যে, নিজেই ‘সবজান্তা’ নাম দিয়ে অনুবাদ করে ফেলেন। ভদ্রলোকের নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
অনুবাদ তো হল। কিন্তু মজাদার থ্রিলারে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের উপযোগী রোল নেই। পরিচালনাও করবেন না তিনি। ঠিক হল, বিরক্তিকর মহিলার চরিত্রে নামবেন তাঁর কন্যা পৌলোমী চট্টোপাধ্যায়। মুখ্য পুরুষচরিত্র, সর্দিতে হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো করা পুলিশ অফিসারের চরিত্রে বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী। পরিচালনায় রমাপ্রসাদ বণিক। শুরু হল মঞ্চায়নের পালা। |
|
কিন্তু পরিচালক অসুস্থ। সেরে ওঠার পর ২০১০ সালে এক দিন অ্যাকাডেমি-চত্বরে দাঁড়িয়ে পরিচালক জানালেন, ‘আর দেরি নয়। ডেট ঠিক করে ফেলেছি।’ ঠিক হল, কলাকুশলীদের মোবাইলে তারিখগুলি এসএমএস করে দেবেন পরিচালক। সেই বার্তা আর আসেনি। তার আগেই চলে গেলেন রমাপ্রসাদ বণিক।
বিশ্বজিৎ অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পরিচালকের অকস্মাৎ মৃত্যুর পর তাঁর সম্পাদিত কপিটিও খুঁজে পাওয়া গেল না। দুর্বিপাক তখন থেকেই ‘সবজান্তা’র পিছু ছাড়েনি। এই বছরের মাঝামাঝি আচমকা খুঁজে পাওয়া গেল সেই স্ক্রিপ্ট। আর দেরি নয়! এ বার খোদ অনুবাদকই নেমে পড়লেন নির্দেশকের ভূমিকায়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশনাতেই আগামী রবিবার, ২৭ অক্টোবর তপন থিয়েটারে নামছে ‘সবজান্তা’। মুখ্য পুরুষচরিত্রে এ বার দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পর অ্যাকাডেমি, মধুসূদন, গিরিশ...যেখানে ডেট পাওয়া যাবে!
আগুনটা কোথায় লাগবে? তপন না অ্যাকাডেমি?...সৌমিত্র ভুরু কুঁচকে তাকালেন। বলা যায়, কমেডি-নাটক নিয়ে দুর্বিপাক তাঁর জীবনে এ বারই প্রথম নয়। তাঁর নির্দেশনায় কমেডি নাটক ‘ঘটকবিদায়’ চলার সময়েই পুড়ে গিয়েছিল স্টার থিয়েটার।
ঘটকবিদায়ে আগুন, ‘চন্দনপুরের চোর’ও তো তেমন চলেনি। “আরে, ‘চন্দনপুরের চোর’য়ের গল্পটা অন্য। প্রযোজকদের সঙ্গে অনুপের (অনুপকুমার) একটা চুক্তি ছিল। ফলে অনুপ লিড রোলে, আমি সেকেন্ড হিরো। অনুপকে বললাম, নর্মাল অ্যাক্টিং কর। অনুপও খুশি হয়ে বলল, বাঁচালি ভাই। কোনও ডিরেক্টর এমন বলে না, সবাই লাউড করতে বলে। বোধহয় অনুপের স্বাভাবিক অভিনয় লোকের ভাল লাগেনি। তার পর তো চলেই গেল,” স্মৃতি হাতড়ালেন সৌমিত্র। ওই জন্যই কমেডি করেন না? অনুবাদক হাসলেন, “ভাল কমেডি পাই কোথায়? আমি তো নাট্যকার নই। একটা নাটক বেছে, তাকে অবলম্বন করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।” কিন্তু লোকে নেবে এই নাটক? সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এক বারও মঞ্চে আসবেন না, শুধুই অনুবাদক ও পরিচালক হিসেবে নেপথ্যে থাকলে মেনে নেবে দর্শক? “আগে চাপ ছিল। দর্শক ভাবত, সৌমিত্রের নাটক মানেই তিনি মঞ্চে আসবেন, নাটকে একটা সাবস্ট্যান্স থাকবে। কিন্তু এখন বোধ হয় মেনে নেবে।” |
|
গৌতম হালদারের অভিনয়ের ছন্দে নিজেকে ভাসিয়ে দিচ্ছি।
নতুন কিছু খেলতে না পারলে আর মজা কোথায়?
পৌলোমী চট্টোপাধ্যায় |
|
তিনি নেপথ্যে, কিন্তু সামনের উইংসে আলোকিত হয়ে উঠছেন তাঁর কন্যা এবং পৌলোমী চট্টোপাধ্যায়। রবিবার কমেডি-থ্রিলারে। তার পর ২৪ ঘণ্টা কাটতে-না-কাটতে সোমবারই অ্যাকাডেমিতে নামছে বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় আলবেয়ার কাম্যুর ‘ক্যালিগুলা’। “আমি বেঁচে আছি, কারণ আমি অন্যকে মারতে পারছি। এই ধ্বংস, এই ঘৃণা যা আমাকে অবিরত ঘিরে রাখে সেটাই আমার সুখ, আমার মুক্তিও সেটাই,” বলে কাম্যুর নায়ক। ক্যালিগুলার রক্ষিতা ক্যাসিওনিয়ার ভূমিকায় পৌলোমী। ক্যালিগুলা: গৌতম হালদার।
হাল আমলের বাংলা থিয়েটারে নিঃশব্দ বদল এই জায়গাটাতেই। একই অভিনেত্রী পরপর দু’দিন আলাদা মেজাজের দুই নাটকে। অথচ, বছর পাঁচেক আগেও পৌলোমীর পরিচয় ছিল, শুধু সৌমিত্রকন্যা। বাবার নাটকেই সুযোগ পান। কিন্তু বছর দুয়েক আগে ব্রাত্য বসুর লেখা ‘সুপারিকিলার’ বা অবন্তী চক্রবর্তীর ‘ইচ্ছের অলিগলি’ নাটকে আচমকা ঘটে যায় প্রতিভার বিস্ফোরণ। “ওই দুটো নাটক আজও আমার প্রিয়। বাপি না থাকার সুবিধে পুরো উশুল করতে পেরেছিলাম, কৃতিত্বে কেউ ভাগ বসাতে পারেনি,” হাসছেন পৌলোমী। ‘সুপারিকিলা’র নাটকে পৌলোমীর সঙ্গে ছিলেন সুপ্রিয় দত্ত। সেই দাপুটে মঞ্চাভিনেতা এখন সিনেমার জনপ্রিয় ভিলেন। কিন্তু ‘মেঘনাদ’ গৌতম হালদার? তিনি শুধুই মেথড-অ্যাক্টিংয়ে বিশ্বাসী নন। অভিনয়ের মধ্যে আচমকা ঘটিয়ে দেন বিভিন্ন মাত্রায় স্বরক্ষেপণ আর শরীরী ছন্দের বিস্ফোরণ!
পৌলোমী ঘাবড়াচ্ছেন না, “এখানে আমি গৌতমের অভিনয়ের ছন্দে নিজেকে ভাসিয়ে দিচ্ছি, সেটাই চ্যালেঞ্জ। নতুন কিছু খেলতে না পারলে আর মজা কোথায়?”
কন্যা মঞ্চের মজায়। আর অভিনেতা পিতা শুধুই অনুবাদক এবং নির্দেশক। মঞ্চে না উঠতে পারায় অভিনেতার মনে সত্যিই নেই কোনও ক্ষোভ? আইসিসিআরে সৌমিত্রের সাম্প্রতিক চিত্রপ্রদর্শনীর কথা মনে পড়ে গেল। “আপনার অনেক ছবিতেই দেখছিলাম ঔজ্জ্বল্যহীন ডার্ক লাল, কালো রং,” আড্ডায় বলেই ফেললাম। “আমার মনের মধ্যে কোথাও ডার্কনেস আছে। সেটাই প্রকাশ পেয়েছিল বলছেন?” স্মিত হাসিতে উদ্ভাসিত হলেন তিনি, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। |
|
|
|
|
|