ছোটবেলায় খাল-বিল-নদীতে বাপ-ঠাকুরদাদের বাইচ প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে দেখতেন। দেশভাগের পর এ পার বাংলায় এসেও সেই স্মৃতি মুছে যায়নি। তাই বছর ৩৩ আগে বনগাঁর বাগদা ব্লকের পূর্ব হুদা গ্রামের বাসিন্দারা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে বাইচ প্রতিযোগিতা শুরু করেছিলেন। সেই থেকে প্রতি বছরই লক্ষ্মী পুজো উপলক্ষে গ্রামের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া কোদালিয়া নদীতে নৌ-বাইচের আসর বসছে। এ বারও বসেছিল। বাইচ প্রতিযোগিতা দেখতে শনিবার কোদালিয়ার দু’পাড়ে ভিড় উপচে পড়ে।
উদ্যোক্তাদের তরফে নীতীশ মণ্ডল, কমল রায়, লোকেশ বিশ্বাসরা বলেন, “ওপার বাংলার ঐতিহ্য নৌ-বাইচ। সেই পরম্পরা, ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে এবং নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে বাইচ প্রতিযোগিতা শুরু করা হয়েছিল। আজও একে ঘিরে এলাকাবাসীর উত্সাহ অটুট।” |
কোদালিয়া নদীতে বাইচ প্রতিযোগিতা। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।
|
নদী অবশ্য এখন কচুরিপানাতেই মজে থাকে অধিকাংশ সময়। পুজো এগিয়ে এলে গ্রামের বাসিন্দারা নিজেরাই কচুরিপানা পরিষ্কার করেন। এ বারও সকলে মিলে নেমে পড়েছিলেন কচুরিপানা সরাতে। ১ কিলোমিটার নদীপথ থেকে টেনে কচুরিপানা সরিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। শনিবারের বাইচ প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে আশপাশের এলাকা, এমনকী দূর-দূরান্ত থেকেও প্রচুর লোকজন এসেছিলেন। যেমন, নদিয়ার ঘুগরাগাছি এলাকা থেকে এসেছিলেন উনষাট বছরের সনাতন বল। কথায়-কথায় জানালেন, তাঁর দেশের বাড়ি ছিল ফরিদপুরে। বললেন, “ছোটবেলায় বাবাকে দেখতাম মধুমতী নদীতে বাইচ প্রতিযোগিতায় নামতে। বাবার কাছেই নৌকা চালানো শিখেছি। বাপ-ঠাকুরদার কথা ভেবেই প্রতিযোগিতায় নামি।” নদিয়ার রূপদাহ থেকে এসেছিলেন বৈদ্যনাথ বিশ্বাস, বিষ্ণুপদ বিশ্বাসরা। তাঁদের বাড়ি ছিল যশোহরে। বৈদ্যনাথবাবু বলেন, “এই খেলার মধ্যে আমরা শিকড়ের গন্ধ খুঁজে পাই।”
প্রতিযোগিতায় যোগ না দিলেও অনেকে আসেন শুধু দেখতেপুরনো দিনের স্মৃতিতে ডুব দিতে। এদিন নদীর ধারে বাইচ প্রতিযোগিতা দেখতে-দেখতে চোখ ভিজে আসছিল বছর বাহাত্তরের ধনঞ্জয় বৈরাগীর। তিনি বলেন, “ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে। আমাদের গোপালগঞ্জে বাড়ি ছিল। ওখানে আরও বড় নৌকা বেরতো। এখানে আকারে অনেকটা ছোট। তবুও হুবহু সেই ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠছে।”
নৌ-বাইচের পাশাপাশি লক্ষ্মীপুজোকে ঘিরেও এলাকায় উন্মাদনা রয়েছে। স্থানীয় তরুণ সঙ্ঘের পরিচালনায় ৩৩ বছর ধরে লক্ষ্মীপুজো হয়ে আসছে গ্রামে। ৭ দিন ধরে মেলা বসে। গ্রামীণ মেলার পাশাপাশি বিচিত্রানুষ্ঠান, বাউল গান, লোকসংস্কৃতির আসর বসে। সব মিলিয়ে যেন মিলনের উত্সব চলছে পূর্ব হুদা গ্রামে। |