প্রবন্ধ ২...
নিজের জোরে পারবেন তো?


আপনি কি নাটকটার রিভিউ করছেন?
হ্যাঁ, কেন?
না, মানে যদি আমাকে একটু শুনিয়ে নেন, কী লিখলেন?
সে কী! রিভিউ তো শোনানোর কথা নয়!
আসলে কী জানেন, নেগেটিভ রিভিউ হলে প্লিজ রিভিউ করতে হবে না।


থিয়েটারের দুনিয়ার এক বিশিষ্ট মানুষ আর এক সাংবাদিকের দূরালাপ। ব্যতিক্রমী আলাপ, এমন কথা মনে করার কোনও কারণ নেই। সিনেমার মতোই, আমাদের নাটকের দুনিয়াতেও এখন ‘হাইপ’ যতটা মূল্যবান, বিরূপ সমালোচনা যাতে না হয় সেটাও সমান জরুরি। ‘প্রিভিউ হলে খুব ভাল, যত হয় তত ভাল, কিন্তু প্লিজ নেগেটিভ সমালোচনা করবেন না’, এই আবদার ইদানীং মোটেই বিরল নয়।
‘হাইপ’ চাওয়াটা দোষের নয়। মাথা ঘামিয়ে, বিস্তর কাঠ এবং খড় পুড়িয়ে, রীতিমতো ঘাম ঝরিয়ে যে নাটকটা জন্ম নেয়, কাল নিরবধি, পৃথ্বী বিপুলা বলে বসে থাকলে তার চলে না। চটজলদি বিক্রি চাই। তা সে যে ভাবেই হোক। সুখের কথা, বাংলা নাটক এখন বিক্রি হয় বেশ ভাল। থিয়েটারে পাঁচশো, এমনকী হাজার টাকার টিকিটও বিক্রি হয়ে প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ হয়ে গেল, এমনও ঘটেছে, ঘটছে ইদানীং। এই ‘পরিবর্তন’ স্বাগত। কেবল সরকারি অনুদানে নির্ভর করে থেকে পার্টির ব্যানারে দিনবদলের বার্তা দেওয়াটাই যে নাটকের দায় নয়, সেই সত্যটা বুঝেছে বাংলা থিয়েটার। বৃহত্তর দর্শকের মনোরঞ্জনের দায় নেওয়ার মতো সাবালক হয়েছে তথাকথিত গ্রুপ থিয়েটার। তার জন্য, তথাকথিত গ্রুপ থিয়েটারের নিয়মকানুনকে তোয়াক্কা না করার মতো সাবালক হয়েছে। বিষয়টা নজর করার মতো।
কিন্তু এই সাবালকের একটা বড় নির্ভরতার জায়গা হয়ে উঠছে গণমাধ্যম। শিল্পের পক্ষে এটা আশঙ্কারও বটে। ষাট-সত্তর-আশির বাংলা নাটক গণমাধ্যমের এমন পাশে-দাঁড়ানো পায়নি। সে কালে ‘সমালোচনা’ই ছিল নাটক সম্পর্কে সম্ভাব্য দর্শককে জানানোর একমাত্র জায়গা। এন্টারটেনমেন্ট নিউজ, পেজ থ্রি-র এমন রমরমা তখনও শুরু হয়নি, শুরু হওয়ার পরেও বহু কাল পর্যন্ত সিনেমাই ছিল তার প্রধান দখলদার। ফলে তখন রিভিউ-এর উপরেই নির্ভর করতে হত নাটককে।

থিয়েটার ওয়ার্কশপ-এর ‘চাকভাঙা মধু’ নাটকের একটি মুহূর্ত।
তবু কি প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ হয়নি? হয়েছে, দীর্ঘ দিন ধরে হয়েছে। ‘গ্যালিলিয়ো’ বা ‘মুদ্রারাক্ষস’-এ শম্ভু মিত্রকে দেখার টিকিট পেতে সারা রাত লাইনে দাঁড়ানোর ছবি মনে আছে অনেকেরই। সে না হয় ‘সুপারস্টার’-এর টান, কিন্তু বহুরূপী, নান্দীকার, পি এল টি, থিয়েটার ওয়ার্কশপ, সুন্দরম, আরও নানা গ্রুপের বিভিন্ন নাটক দেখতে দর্শকরা ভিড় করেছেন নিয়মিত। কিন্তু সে দিন গণমাধ্যমের সঙ্গে থিয়েটারের সম্পর্কটা আজকের মতো নির্ভরতার সম্পর্ক হয়ে ওঠেনি। নাটক সমালোচনা তখনও মাঝে মাঝেই নাট্যপরিচালকের পীড়ার কারণ হয়েছে, কিন্তু তাকে নাটকের সাফল্য বা ব্যর্থতার প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হত না। সেই সমালোচনার যাথার্থ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে, কিন্তু নাটকের সাফল্য তার ওপর পুরোটা নির্ভর করত না। শম্ভু মিত্রের রক্তকরবী সম্পর্কেও লেখা হয়েছিল, ‘বিশু পাগলার মুখে শ্লোগান চলো ভাই, লড়াইয়ে যাই, এটার মধ্যে শুধু স্থূলত্বই ফুটে ওঠেনি, আগাগোড়া এদের অভিনয়ভঙ্গী ও দৃশ্য পরিবেশ থেকে মনে করে তখন এতটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, রবীন্দ্রনাথ যেখানে শ্রেণীবিদ্বেষ পরিহার করে গিয়েছেন এবং যাবার জন্য নির্দেশও দিয়েছেন, বহুরূপী তা তো টেনে এনেছেনই, অধিকন্তু একটা বিশেষ রাষ্ট্রের প্রতি মানুষকে সংগ্রামী হয়ে ওঠার জন্য উদ্দীপ্ত করারও চেষ্টা করেছেন। শেষ পর্যন্ত তাই অভিনয়টি রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী না হয়ে বহুরূপীর রক্তকরবীতে পরিণত হয়েছে।’
তা সত্ত্বেও ‘রক্তকরবী’ সাফল্য পেয়েছে। চটজলদি প্রথম কয়েকটা শো প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ হওয়ার ‘সাফল্য’ নয়, দীর্ঘ দিন ধরে ধারাবাহিক সাফল্য। পরবর্তী কালে বড় প্রাতিষ্ঠানিক গণমাধ্যমের সমালোচকের সঙ্গে থিয়েটারের বিরোধ কত দূর যেতে পারে তার ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হয়ে আছে শম্ভু মিত্র-ধরণী ঘোষ সংবাদ। তবু কখনও গণমাধ্যমের উপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠেনি বাংলা থিয়েটার।
ছবিটা এখন বদলে গিয়েছে। গ্রুপ থিয়েটার অনেক ঝাঁ-চকচকে হয়েছে মনোরঞ্জনের মূল ধারায় ঢুকতে চেয়ে। একের পরে এক উপভোগ্য থিয়েটারের জন্ম হচ্ছে নানা ধরনের, নানা বিষয়ের। বাংলায় নাটকেরই দর্শক বলে কোনও বিশেষ শ্রেণি নেই আর দর্শকসমাজেও, বরং গণমাধ্যমের প্রচার টেনে আনছে অনেক নতুন দর্শককে, যাঁরা হয়তো একদা তথাকথিত কমার্শিয়াল থিয়েটারেরই দর্শক ছিলেন। সেই দর্শকের একাংশ হয়তো অস্থানে হাততালি দিয়ে চূড়ান্ত রসভঙ্গ ঘটান, অভিনেতাকে নয়, মন্ত্রীকে দেখতে আসেন মঞ্চে। তবু, আসেন তো! বাংলা থিয়েটারের বড় লাভ সেটা।
তবু, একটা খটকা রয়েই যাচ্ছে। পরিকল্পনার স্তর থেকে মহড়া হয়ে প্রথম অভিনয় পর্যন্ত কিছু প্রযোজনা যে নিরন্তর গণমাধ্যমের ‘হাইপ’ পেয়েছে, সেটা একেবারে সরিয়ে নিলে ছবিটা বদলে যাবে না তো?
যদি না বদলায়, সেটাই হবে বাংলা থিয়েটারের যথার্থ সুদিন। সেই সুদিনে, সত্যি ওই সংলাপটা গল্প হয়ে যাবে। সিনেমার মতো।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.